ওপার বাংলা থেকে অপার বিস্ময়ে এই বাংলাদেশের দিকে তাকানো এক ভারতীয় হোস্টেল জীবন+ পি টি এস ডি পর্ব ১ হোস্টেল জীবন+ পি টি এস ডি পর্ব ২
আগের পর্বে বলেছি রুটিনের কথা; এই পর্বে বলব ছাত্রদের কথা। আমার একটা মূলগত অসুবিধা ছিল যে আমার সঙ্গে মাত্র তিনজন নতুন ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল।
কাজেই পুরোনো ছাত্রদের কাছে আমরা ছিলাম উড়ে এসে জুড়ে বসার দল। তার ওপর আমি পড়াশুনাটাও ভালবাসতাম, দুঃখের বিষয় আমার ঘরের বাকি রুমমেটদের একজন বাদে কেউই ঠিক বইপ্রেমী ছিল না। রুমের যে প্রতিনিধি ছিল (সেবক বলে একটা গালভরা নাম ছিল) সে বিশাল বড়ঘরের ছেলে, তখনই তার বাড়িতে দুটো ল্যাপটপ, দামী ক্যামেরা ফোন; এদিকে পড়াশুনাতে মা সরস্বতীর বাহন; কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে তাকে দরিদ্র মেধাবী ছাত্র হিসেবে ধরা হত।
( এরকম আরো একজন ছিল, তার বাবা প্রায় ১০০ একর জমির মালিক, সে নিজে ফোর থেকে সেভেনে উঠতে সাত বছর লাগিয়েছে, সেও দরিদ্র মেধাবী)।
কাজেই এরকম ছেলেরা পড়াশুনাটাকে একটা জোক হিসাবেই দেখত, তাদের কাছে যে জিনিস আলোচ্য ছিল, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে হিসেবে আমার সেখানে স্থান ছিল না। মন হাঁপিয়ে উঠছিল।
একটা কথা বলা হয় নি, আমাদের ব্যাচে তিনজন বাংলাদেশীও ছিল, একজন খুবই সুভদ্র ছিল এবং আমার দেখা হাতেগোনা কয়েকজন ছাত্রের মধ্যে ও একজন যে আমাকে কখনও বুলি করেনি। বাংলা ভাষার ওপর তার মত দখল আমি খুব কম লোকেরই দেখেছি।
এখনও তার সঙ্গে আলাপ আছে। জানলে খুশী হবেন যে সে এখন ভারত তথা বিশ্বের সেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি টি আই এফ আর-এ পদার্থবিজ্ঞানী হবার ইন্টারভিউ তে ডাক পেয়েছে।
বাকী দুজনের মধ্যে একজনের বাবা বাংলাদেশে স্বাস্থ্য দপ্তরে খুব উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন, আরেকজন খুব ভাল ফুটবল খেলত। তবে এদের সঙ্গে আমার সেরকম আত্মিক যোগ স্থাপিত হয়নি।
যাই হোক, ভালয় মন্দয় মিশিয়ে প্রথম পনেরোটা দিন কাটল, তারপর বাবা একদিন দেখা করতে এলেন, আমি বুঝে গেছিলাম যে এখানে এক বছর কাটানো প্রা্য় অসম্ভব, বাবাকে বললাম যেন এখান থেকে আমাকে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়।
বাবাকে প্রায় রাজীও করিয়ে এনেছিলাম, কিন্তু বাদ সাধলেন স্কুলের হেডমাস্টার মহাশয়, তিনি একটি আইনের দোহাই দিয়ে (পরে জেনেছিলাম, আইনটি ১৯৯৮ সালেই বাতিল হয়ে গেছে) আমাকে যেতে দিলেন না। পরে জানতে পারি যে ওঁদের মনে হয়েছিল আমি হয়ত মাধ্যমিকে র্যাংক করতে পারি, তাই আমাকে আটকে রাখতে চেয়েছিলেন। (এইখানে বলে নিই, আমি সত্যিই মাধ্যমিকে এবং এইচ এসে টপ দশে র্যাংক করেছিলাম তবে অবশ্যই ওখান থেকে নয়)।
বাবাকে উনি এমন মিষ্টি ভাষায় বোঝালেন যে বাবা আমাকেই উল্টে কড়া ভাষা্য় ধমকে বললেন যে আমি এখানেই পড়ছি।
আমার অবস্থাটা চিন্তা করুন- একটা নতুন জায়গায় এসেছি; বেশীর ভাগ সহপাঠী আমাকে বিশেষ পছন্দ করেন না, রুটিনের বাঁধনে নিজেকে বন্দী লাগে, আমার পালাবার ইচ্ছা বাবার থ্রু দিয়ে হেডমাস্টার জেনে গেছেন এবং আমার বাবা আমার মতে মত না দিয়ে হেডমাস্টারের মতেই মত দিচ্ছেন।
এরপর টানা তিনমাস ক্লাস হল- সেই নিস্তরঙ্গ জীবন।
তবে এর মধ্যে আমি একটা অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম যার জন্য আমি আগামী সারা জীবন "বোরখা পরো রেপ রোখো" মার্কা স্লোগানের প্রতি সমর্থন হারিয়েছিলাম। আমাদের সপ্তাহে একবার করে নিউজপেপার দেওয়া হত, তাতে কতৃপক্ষ যে সব ছবিকে অশালীন মনে করতেন (যেমন ঐসময় ভারতীয় সেনাবাহিনী মণিপুরে এক তরুণীকে খুন করেছিল, তার প্রতিবাদে কিছু মণিপুরী নারী ইম্ফলে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন, সেই ফটো) সেগুলো কাঁচি দিয়ে কেটে দিতেন। সেগুলো নিয়ে এমনই রসালো আলোচনা হত যে আমার মনে হয় সরাসরি ছবিগুলো দেখতে দিলে কিছুতেই এতটা পারভার্টেড ধারণা মনে ঠাঁই পেত না।
কালীপুজো পশ্চিমবাংলার এক বিরাট উৎসব; সব ধর্মের মানুষই ঐ দিন বাজি পোড়ানো উপভোগ করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের আরাধ্য দেবী মা কালীর পুজায় তাই ওখানে আলাদা সেলিব্রেশন হত, ওখানেই আমার শেষ মোহটুকুও কেটে গেল। প্রচুর গেস্ট, অভিভাবক আসতেন; দেখতাম তাদের খাবার সার্ভ করার দায়িত্ব মহারাজেরা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। শ্রমের মর্যাদা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু যেকোন শ্রম তখনই সম্মানজনক হয় যখন সেটা স্বেচ্ছায় হয়; বাড়িতে কেউ এলে আমি নিজেই খাবারের ডিশ নিয়ে যাই, তখন সেটা স্বেচ্ছায় যাই। কিন্তু এখানে আমার বাবা মা কতৃপক্ষকে বছরে ৩০০০০ টাকা দিয়েছেন আমাকে খাবার সার্ভ করতে, আমাকে দিয়ে খাবার সার্ভ করতে নয়। আর খরচা বাঁচানোর জন্য ছাত্রদের নিয়ে এগুলো করিয়ে নেবার পর কেউ শ্রমের মর্যাদার বাহানা তোলে তখন আমার ব্রেষটের সেই অমর লাইন মনে পড়ে যায়-
" আমাদের সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে বলে সেই নেতারা যারা মুরগীর মাংসে সবচেয়ে আয়েশ করে কামড় বসায়।
"
যাকগে, অনেক লেখার ছিল, লিখলাম না। যেতে যেতে একটা তথ্য দিয়ে যাই- পুরুলিয়ায় গরমকালে তাপমা্ত্রা ৪৮-৫০ ডিগ্রি থাকে এবং ওখানে ঘরে কোন পাখা নেই এবং এক একটা ঘরে ৯ জন থাকে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।