ওপার বাংলা থেকে অপার বিস্ময়ে এই বাংলাদেশের দিকে তাকানো এক ভারতীয় হোস্টেল জীবন+ পি টি এস ডি পর্ব ১
প্রথমেই আমি নিজের মানসিক প্রকৃতি সম্পর্কে কিছুটা বলে নিই, তাহলে সেই কনটেক্সট-এ আমার ভাবনাগুলো আপনাদের কাছে ক্লিয়ার হবে। আমি মূলত চাপা স্বভাবের এবং কল্পনাপ্রবণ ভাবুক টাইপের ছেলে, যারা MBTI পছন্দ করে তাদের ভাষায় প্রায় আদর্শ INTP। কিছুটা মা-ঘেষা ছিলাম, বাবাকেও বেশ ভয় পেতাম। ( কেন কে জানে? ছোটবেলায় বাবা আমার গায়ে হাত তুলেছে এমন ঘটনা মনে পড়ে না, বরং ছোটখাটো শাসন মা-ই করত); বন্ধুবান্ধবও বিশেষ ছিল না (সত্যিকথা বলতে কি, দুজন বাদে সেরকম বন্ধু এখনও আমার নেই)।
বুঝতেই পারছেন, এই টাইপের স্বভাব নিয়ে হস্টেলের মত পরিমণ্ডলে চলা মানে সমস্যা অবধারিত।
যাই হোক, অনেক গৌরচন্দ্রিকা হল; এবার আসল কথা্য় আসা যাক।
প্রথম দিনই আমাদের বলা হল সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে একটা মোটা ট্রাঙ্কসহ হস্টেলে চলে আসতে। হস্টেলের নাম ব্রহ্মানন্দ ধাম। একটা ঘর পেলাম, রুমমেট আরো ৮ জন। ঘরের মাপ মোটামুটি ১৫ ফুট বাই ১২ ফুট মত; বাইরের দিকে জানলার ফেসিং আমার বিছানা পড়ল।
বাবা মা সেই দিনই বাড়ি ফিরে গেলেন।
প্রথমেই খটকা লাগল নোটিশবোর্ড পড়ে, বাড়িতে যেমন ইচ্ছা টাইমে যেকোনো কাজ করা যায়, এখানে একদম ঘড়ি ধরে কাজ।
ভোর ৪:৩০-৫:০০- দাঁত মাজা,মুখ ধোওয়া, প্রাতঃকৃত্য ইত্যাদি।
ভোর ৫:০০-৫:৪৫ প্রার্থনা।
ভোর ৬:০০-৭:০০ খেলা/ নোংরা সাফাই/ড্রিল/টয়লেট সাফাই- সপ্তাহ ধরে কাজ ভাগ করা থাকত।
সকাল ৭:০০-৭:১৫ সকালের খাওয়া; পাউরুটি ও পাতলা জ্যাম।
সকাল ৭:১৫- ৯:০০ পড়া- ক্লাসঘরে বসে।
সকাল ৯:০০-১০:০০ স্নান।
সকাল ১০:০০- ১০:৩০ লাঞ্চ।
সকাল ১০:৩০- বিকেল ৪:০০ ক্লাস।
বিকেল ৪:০০- সন্ধ্যা ৬:০০ খেলা।
সন্ধ্যা ৬:১৫-৭:০০ প্রার্থনা।
সন্ধ্যা ৭:০০- ৯:০০ পড়া- আবার ক্লাসঘরে বসে।
রাত ৯:০০-৯:৩০ ডিনার।
রাত ৯:৩০-১০:৩০- ঘুমানোর আগে ধর্মোপদেশ ও রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ আলোচনা।
আপনারা ভাবছেন এ রুটিন তো খুব খারাপ নয়, আচ্ছা এবার আমাকে বলতে দিন-
১) ভোর ৪:৩০-৫:০০- দাঁত মাজা,মুখ ধোওয়া, প্রাতঃকৃত্য ইত্যাদি- প্রথম কথা হল যে পুরুলিয়া ভারতের সবচেয়ে চরমভাবাপন্ন জায়গাগুলির একটি; শীতকালে ৩-৪ ডিগ্রিতেও তাপমান নামে। এবং টয়লেটের সংখ্যা ১০জন পিছু একটি। কাজেই আপনার ভাগ্য ভাল থাকলে তবেই আধ ঘন্টার মধ্যে কাজগুলো নামাতে পারবেন। এই ভয়ে অনেকেই বাধ্য হয়ে আরো আগে ৪:০০ নাগাদ উঠত। কিন্তু স্লিপ ডেপ্রিভেশন যে কি মারাত্মক জিনিস সেটা আমি এরকম মাস খানেক করেই বুঝেছিলাম।
২)প্রার্থনা+ধর্মোপদেশ : রামকৃষ্ণ মিশন যাই দাবি করুক না কেন, এটি মূলত হিন্দু সংগঠন ও অবতারবাদে বিশ্বাসী। প্রার্থনাগুলিতেও রামকৃষ্ণকে ভগবানের আসনে বসিয়ে পুজো করা হয়। আমি নিশ্চয়ই ১১/১২ বছর বয়সে আলিম হয়ে যাইনি কিন্তু সবার সঙ্গে এই প্রার্থনায় অংশ নিতে আমার খুব একটা স্বস্তিবোধ হত না। রাতে যখন মহারাজরা রামকৃষ্ণকে নিয়ে আলোচনা করতেন তখন আমি এটুকু একমত হতাম যে তিনি একজন অসাধারণ মানুষ কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মানুষকে "ভগবানের অংশ " হিসেবে ঠিক মানতে পারছিলাম না। সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র ছিল হিন্দু, কাজেই সাহস করে বলতেও পারতাম না।
এমন নয় যে ধর্ম নিয়ে কোনভাবে অপমানিত হয়েছি কিন্তু আপনি যদি ইদুর হন আর আপনার সামনে একটা হাতি থাকে তবে সে হাতি যত দয়ালুই হোক না কেন আপনার ভয় লাগতে বাধ্য।
৩)ক্লাসঘরে বসে পড়া- আগেই বলেছি আমি ইন্ট্রোভার্ট, তাই আমার এক ক্লাসঘরে অন্য ৩০ জনের সঙ্গে স্টাডি সেশনে বসে পড়তে ভাল লাগত না। মনে হত যেন আমি একঘর লোকের সামনে কাপড় চেঞ্জ করছি। আজও ফাকা ঘর না পেলে পড়াশুনা করতে ইচ্ছে করে না।
৪) বদ্ধভাব: আগেই বলেছি যে বাইরে কোথাও যাওয়া পারমিটেড ছিল না, স্কুলের দরজা ছিল বাইরের দুনিয়াকে আটকে রাখার জন্য।
আমার মন হাপিয়ে উঠত। জানলা দিয়ে রেললাইন দেখা যেত, মনে হত ওই রেললাইনের যাত্রীরা মুক্ত, আমি বন্দী।
এবং ৫)ঘুমের অভাব: এটা সবচেয়ে মারাত্মক, রুটিনে দেখবেন দিনে ৩ ঘন্টার কাছাকাছি খেলা/ড্রিলের সময় আছে (স্কিপ করলে শাস্তি অনিবার্য)।
এতক্ষণ খেলার পর আমরা ঘুমাতে পেতাম হার্ডলি ৬ ঘন্টা। স্বাভাবিকভাবেই আমি সন্ধ্যাবেলা স্টাডি রুমে ঘুমিয়ে পড়তাম, তখন পাওনা ছিল সাজা।
(কেউ কেউ অবশ্য ভাল ছিলেন)।
যাই হোক, এ তো গেল পরিবেশগত অশান্তি, পরের পর্বে বলব পিয়ার প্রেসারের কথা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।