সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ... আজকের খবর: সাইবার ক্রাইম ঠেকাতে নামছে বিটিআরসি
দুনিয়া জুড়ে সাইবারপরিসরকে নিয়ন্ত্রণ করবার একটা আশঙ্কাজনক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সোপা (স্টপ অনলাইন পাইরেসি অ্যাক্ট) এবং পিপার (প্রটেক্ট ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অ্যাক্ট) মতো বিল পাশ করানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। বিল দু’টির মূল কথা ছিল প্রথাগত কপিরাইট প্রথা লঙ্ঘন করতে পারে এমন বিদেশি ওয়েবসাইট আমেরিকানরা দেখতে পাবে না। এই আইনটি পাশ হলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে উইকিপিডিয়া ও তার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট, যা মূলত ব্যবহারকারীদের অবদানে গড়ে উঠেছে। এই উদ্যোগের প্রতিবাদে উইকিপিডিয়া গত ১৮ জানুয়ারি, ২০১২ একদিনের জন্য তাদের ইংরেজি ওয়েবসাইটটি ব্ল্যাকআউট করে রেখেছিল।
ফেসবুকের উদ্যোক্তা মার্ক জুকারবার্গ তার স্ট্যাটাসে লিখলেন, “ফেসবুক সোপা ও পিপার বিরোধিতা করছে এবং ইন্টারনেটকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এরকম যেকোনো আইনের বিরোধিতা করবে। পৃথিবীতে আজ সেইসব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রয়োজন যারা ইন্টারনেটবান্ধব। ” এদিকে ভারত সরকার ফেসবুক ও গুগলকে সতর্ক করে দিয়েছে এবং প্রয়োজনে চীনের মতো করে ইন্টারনেটকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। স¤প্রতি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেবার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশেও কিছু আলামত দেখা যাচ্ছে।
বিশেষত এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ জানুয়ারি মাসে বলেছিলেন, আইন করে অশালীন ব্লগারদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দু-একটি ব্লগ কর্তৃপক্ষ নিজেরাও গিলোটিনে গলা এগিয়ে দিয়ে বলছেন সাইবার অপরাধ দমনের নিমিত্তে সাইবার আইন করতে হবে। দেশে ব্লগার গ্রেফতার হয়েছে, ফেসবুকের স্ট্যাটাস নিয়ে আইনের ফ্যাসাদে ফাঁসিয়াছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক।
বিকল্প মাধ্যম হিসেবে বিশ্লেষকরা মধ্য ঊনবিংশ শতাব্দির ব্রিটেনে দৃষ্ট শ্রমজীবীদের বা র্যাডিক্যাল প্রেস কিংবা ১৯৬০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিদৃষ্ট নিও জার্নালিজমের পত্রিকাগুলোর কথা উল্লেখ করেন। পশ্চিমা দেশগুলোতে, যেখানে মূলধারার মাধ্যমগুলো অনেক শক্তিশালী, নানা ধরনের বিকল্প মিডিয়ার অস্তিত্ব আছে।
ধরা যাক ষাটের দশকের হিপিদের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ সংবাদপত্রগুলো। কিংবা একালে স্বল্প বাজেটের সাহিত্য পত্রিকা, র্যাডিকাল রাজনৈতিক মতাদর্শের পত্রিকা অথবা পরিবেশবাদীদের কিংবা নারীবাদীদের কমিউনিটি রেডিও। প্রতিদিনের মূলধারার পত্রিকা যা কাভার করেনা, তা তুলে ধরে যে মাধ্যম, সেটাই বিকল্প মাধ্যম। টিম ও’সুলিভান বলেছেন, বিকল্প মাধ্যম অবশ্যই বিপ্লবী পন্থায় সমাজ পরিবর্তনের ওকালতি করবে। কিন্তু বিকল্প মাধ্যমকে আজ আমরা কীভাবে চিনবো? আমাদের কি নতুন করে বিকল্প মাধ্যম দাঁড় করাতে হবে না এর নিদর্শন ইতোমধ্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি? আজকের সময়ে বিকল্প মাধ্যম সবচেয়ে বেশি পরিদৃষ্ট হচ্ছে সাইবারপরিসরে।
আমাদের দেশে এর খুব বেশি নিদর্শন দেখা না গেলেও ব্লগ ও ফেসবুকে স্বতঃস্ফূর্ত-অপেশাদার নাগরিক সাংবাদিকতার কারণে অনলাইন ক্রমশ বিকল্প মাধ্যম হিসাবে গড়ে উঠছে। প্রথাগত মূলধারার গণমাধ্যমে তথ্যের প্রবাহ একমুখী। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমগুলিতে দ্বিমুখী পদ্ধতিতে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ঘটাচ্ছে। যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় বার্তাপ্রেরক ও গ্রহীতার যে সম্পর্ক তাতে প্রেরক থাকে প্রধান ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় -- মূলধারার গণমাধ্যমে সাংবাদিক ও পাঠক-দর্শক-শ্রোতার সম্পর্ক যেমন। কিন্তু সাইবারপরিসরের যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় প্রেরক-গ্রহীতার সম্পর্ক পাল্টে গিয়েছে।
গ্রহীতাও প্রেরকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। এই পরিবর্তন তাৎপর্যময়। এখন এই বিকল্প মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের ভাবনা ভাবছেন শাসকেরা।
এর কারণ অনুমান-অযোগ্য কোনো বিষয় নয়। আরব বসন্ত এবং অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট-এর মতো আন্দোলনগুলোতে ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক মাধ্যমগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
অন্যদিকে মানবেতিহাসে এই প্রথমবারের মতো নিপীড়িতরা বৈশ্বিকভাবে এক হবার সুযোগ পেয়েছে। অধিকার আদায় এবং সামাজিক পরিবর্তনের জন্য মানুষের একত্রিত হওয়াটা অন্যতম পূর্বশর্ত। আর সাইবারপরিসর হলো সেই পাটাতন, যাতে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষ একত্রিত হয়ে কথা বলছে, প্রতিবাদ কর্মসূচি নির্ধারণ করছে। একথা ঠিক যে অনেক ব্লগার বা ফেসবুক-টুইটার ব্যবহারকারী দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করেন। বাকস্বাধীনতার অপব্যবহার করে ব্যক্তি অবমাননা করে থাকেন, অপরের ক্ষতিসাধন করে থাকেন -- এইভাবে সম্ভাবনাময় একটি মাধ্যমকে কালিমালিপ্ত করে থাকেন।
ব্লগারদের লাগামহীনতার বৈশিষ্ট্য পৃথিবীব্যাপী প্রায় একই। অবশ্য বাংলভাষী প্রতিটি ব্লগ কমিউনিটিরই নীতিমালা আছে, এবং বাকস্বাধীনতার অপব্যবহার একটা সীমা রয়েছে। ফেসবুকেও আপত্তিকর আধেয় নিয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় ও তার ফল পাওয়া যায়। কিন্তু দায়িত্ববোধহীনের বোধোদয়ের জন্য, সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি নেয়া বা ব্লগগুলোতে সুলিখিত নীতিমালা প্রবর্তনের আবেদন ছাড়া, নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপ গণতান্ত্রিক একটি সরকারের জন্য আত্মঘাতী হবে। ২০১০ সালে কয়েকদিনের জন্য যখন ফেসবুককে বন্ধ করিয়া দেয়া হয়েছিল, তখন প্রক্সি সার্ভার দিয়া মানুষ ফেসবুকে প্রবেশ করেছিল।
আর বিদেশে অবস্থানকারী ব্যবহারকারীদের একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়না। বলা যায়, ইন্টারনেটকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো সাইটকে বন্ধ করে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। এখন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চীন বা ইরানের মতো ইন্টারনেট-প্রতিপক্ষ দেশ হবার বিলাসিত করতে পারে কিনা সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। কারণ গণতান্ত্রিক যেকোনো দেশে বাকস্বাধীনতা হরণ করলে হিতে বিপরীত হয়। ফেসবুক বা ব্লগ ব্যবহারকারীদের সবাই সমাজের সচেতন-শিক্ষিত অংশ।
এই সাইটগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশ হয়ে গিয়েছে। যেকোনো নিয়ন্ত্রণ তাদের ক্ষুব্ধ করে তুলবে। আর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলেই তা বৈশ্বিক একটা সংবাদের পরিণত হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগানধারী সরকারের ভাবমূর্তির সঙ্কট তৈরী হবে। তাই মানুষকে স্বাধীনভাবে কথা বলতে দেয়াই উচিত।
জনশাসন প্রক্রিয়া সমালোচনাবিহীন যাবে, কোনো গণতান্ত্রিক সরকারেরই এরকম আশা করা উচিত নয়। যুর্গেন হ্যাবারমাসের জনপরিসরের যে ধারণা’ তা জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাইবারপরিসরে গড়ে উঠেছে। এই পরিসরকে রক্ষা করতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।