স্বাধীনতা, সে তো আমার প্রিয় মানুষের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা
মিশর ইসরায়েলের অন্যতম প্রতিবেশী ও ফিলিস্থিনিদেরও প্রতিবেশী। আরব দেশগুলির মধ্যে মিশরেরই সেনাবাহিনী সবার্ধিক সুসংগঠিত ও শক্তিশালী এবং আরব ও আফ্রিকার মধ্যে বৃহত্তম সেনাবাহিনী মিশরেরই আছে। তাই বিশ্বরাজনীতিতে মিশর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ । ইসরায়েল ও আমেরিকার জন্য তো মহাগুরুত্বপূর্ণ !
এখন প্রথম আসতে হবে আরব বিশ্বের রাজা, বাদশাহ ও আমির, শেখরা কেন মুরসি বিরোধী এবং কেন তারা মুরসির পতনের সঙ্গে সঙ্গেই ঐ রাতেই মিশরের সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন বার্তা পাঠালো ?
মিশরের ব্রাদারহুড বা এর সমমনা ইসলামিক দল গুলিই কিন্তু গোটা আরব বিশ্বে এই রাজা বাদশাহ আমির শাসিত দেশগুলির বৈধ ও অবৈধ প্রধান বিরোধী দল । এই দলটি হাসানুল বান্নার নেতৃত্বে ১৯২৮ সালে মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিনের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এই দলটি সমগ্র আরবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ।
এই দলটি অনেক ঘাত-প্রতিঘাত অত্রিকম করে এপর্যায়ে এসেছে এবং এই দলটির শাখা বর্তমানে গোটা আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে । ফিলিস্তিনের হামাসও ব্রাদারহুডের একটি শাখা । যাইহোক, মিশরে যদি ব্রাদারহুড সফল হত তাহলে এই আমির রাজ বাদশাহদের সামনে মহা বিপদ হত । সিরিয়ায় পরই আন্দোলন পৌছাত জর্ডানে আর শেষ পর্যন্ত সৌদি আরবে । কারণ এই ইসলামিস্টরা তখন মিশরকে কাছে পেত রাস্ট্রীয় শক্তি হিসাবে এবং তারা আরো উৎসাহ পেয়ে যেত যেমনটা পেয়েছে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ।
সিরিয়াতে যারা বিদ্রোহী তারা কিন্তু র্যাডিক্যাল ইসলামিস্ট । মুরসির পতন আরব বিশ্বের রাজা বাদশাহদের এক বিরাট স্বস্তি । এজন্যই মুরসির পতনের সাথে সাথেই আরব রাজা বাদশাহরা মিশরের সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছে । সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ বলেছেন মুরসির পতনের মাধ্যমে ‘রাজনৈতিক ইসলামের’ পতন হল । আসাদের এই বাক্যটাতে অনেক তাৎপর্য আছে ।
তাহলে প্রশ্ন হতে পারে সো আরবের রাজা, বাদশাহরা কেন তাহলে সিরিয়ার র্যাডিক্যাল ইসলামিস্টদের সহায়তা দিচ্ছে ?
আহা ! সেটা তো আরব লম্বা কাহিনী । তার আগে বুঝতে হবে আরব রাজা, বাদশাহ ও আমিরদের চরিত্র । এদের নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট্য ও মেরুদন্ড তো নেই বরং এরা যুক্তরাস্ট্র ও ইসরায়েলের চামসামি করে ক্ষমতায় টিকে আছে । এখানে প্রধান বিবেচ্য হল সিরিয়ার আসাদ সরকার ইরানের ঘনিষ্ট মিত্র আর অন্যদিকে ইরান হল ইসরায়েল ও আমেরিকার শত্রু । তাই ইরান আরবেদেরও শত্রু ! সেই সূত্রে এরা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সমর্থক ।
তাছাড়া সৌদি আরব বিশেষ করে সিরিয়ার উগ্র সালাফি গোষ্ঠী আল নুসরাকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিচ্ছে যারা সৌদি আরব বান্ধব । এই সালাফিরাই মুরসির বিপদে মুরসির পাশে দাড়ায়নি কারণ সৌদি যে মুরসির পাশে নেই ! অথচ এই মুরসি সালাফিদের জন্য যথেষ্ট করেছেন । মুরসির তার ক্ষমতার শেষ দিকে অনেকটা সালাফি নির্ভর হয়ে পড়েছিলেন । মুরসির আস্কারা পেয়েই উগ্র সালাফিরা এক দিনেই চারজন শিয়া মুসলিমকে হত্যা করে লাশ নিয়ে আনন্দ উল্লাস করেছেন ! তবে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা আসাদকে উৎখাত করলেই যে তারা ক্ষমতার স্বাধ পাবে তাও না । শুধুমাত্র সিরিয়ার সন্ত্রাসী বিদ্রোহীরা ব্যবহৃত হচ্ছে ইসরায়েল ও যুক্তরাস্ট্র ও সৌদি স্বার্থে ।
প্রথম আলোতে কলামিস্ট ফারুক ওয়াসিফ মুরসির পতনের কারণ ব্যাখ্যা্ করেছেন এভাবে----
"অভ্যুত্থানের প্রধান দুই সিভিল সমর্থক হলেন আন্তর্জাতিক আণবিক কমিশনের সাবেক প্রধান নোবেলজয়ী এল বারাদি এবং হোসনি মোবারক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আহমদ শফিক। আহমদ শফিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুরসির কাছে পরাজিত হন। গত মার্চে তাঁরা দুজন সংযুক্ত আরব আমিরাতে মিলিত হয়ে মুরসি সরকারের পতনের পরিকল্পনা করেন। অভ্যুত্থান ঘটার আগেই এক সাক্ষাত্কারে শফিক ফাঁস করেছেন যে মুরসিকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করার ফন্দি ছিল তাঁদের। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে ঠিকই, তবে তাঁকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট না বানানোয় তিনি হতাশ হয়ে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছেন।
মুরসির পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছিল প্রধানত দুটি কারণে। সেনাবাহিনী তাঁর হাতে ছিল না, বিচার বিভাগ নির্বাচিত সরকারকে পদে পদে বাধা দিচ্ছিল, আমলাতন্ত্র নিজের ইচ্ছায় চলছিল, পররাষ্ট্র দপ্তর ও ব্যাংকব্যবস্থাও সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব কটি প্রতিষ্ঠানেই যখন মোবারক যুগের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা গাঁট মেরে বসে ছিলেন, তখন মুরসির একমাত্র শক্তি ছিল নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের পদ। এমনকি সংসদও আদালতের নির্দেশে বাতিল হয়ে গিয়েছিল। মোবারকের আমলের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি জারি করা আদেশ কেন গণতান্ত্রিক আমলে পালিত হলো না, তার জন্য আদালত নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশ পর্যন্ত দিয়েছিলেন।
ফিরিয়ে আনা হয়েছিল একসময়কার ঘৃণিত পাবলিক প্রসিকিউটরকে। অথচ মিডিয়ায় প্রচারিত হয়, ব্রাদারহুড সরকারই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে। পাশাপাশি শরিয়া আইনের কিছু কিছু বিধান জারি করা, রাষ্ট্রকে ইসলামি করতে চাওয়াও জনগণের বিরাট অংশ মানতে পারেনি। ব্রাদারহুড শেষ পর্যন্ত জনগণের দল না হয়ে দলের জন্য জনগণ ভাবা শুরু করেছিল।
অন্যদিকে হোসনি মোবারকের আমলে আইএমএফের ‘পরামর্শে’ মিসরের অর্থনীতিকে বাজারীকরণ করা হয়।
রাষ্ট্রীয় সেবাসুবিধা উঠিয়ে নেওয়া হয়। জনগণ মূলত এ কারণে ক্ষিপ্ত হয় মোবারকের বিরুদ্ধে। কিন্তু মুরসিকেও ক্ষমতারোহণের সময় আইএমএফের নির্দেশ মেনে নিতে হয়েছিল। এতে অর্থনীতি আরও নাজুক অবস্থায় চলে যায়। আইএমএফের নির্দেশ মানতে গিয়ে অর্থনৈতিক ব্যর্থতা মুরসির জন্য রাজনৈতিক ব্যর্থতা হয়ে দেখা দেয়।
"
আমি মনে করি মুরসি উৎখাত শুধু অর্থনৈতিক কারণ ও রাজনৈতিক কারণেই হয়নি । এরসঙ্গে যুক্ত আছে মিশরের সেনাবাহিনীর ক্ষমতা । সেই বাদশাহ ফারুক উৎখাত হওয়ার পর থেকেই মিশরের ক্ষমতার শীর্ষে ছিল সেনাবাহিনী। গামাল নাসের থেকে শুরু করে মোবারক পর্যন্ত যত প্রেসিডেন্টই এসেছেন তারা সবাই ছিলেন সেনাকর্মকর্তা । মিশরের অর্থনীতির ৪০% + নিয়ন্ত্রন করত সেনাবাহিনী ।
ইসরায়েলের পরপরই মিশরই হল ২য় দেশ যে যুক্তরাস্ট্রের কাছ থেকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়ে থাকে আর তার একটা বিরাট অংশ ব্যয় হয় সেনাবাহিনী পিছনে। প্রায় ৬০ বছর পর হঠাৎ করে বেসামরিক নেতৃত্বের অধীনে চলতে মিশরের সেনাবাহিনী মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রস্তুত ছিল না । ক্ষমতা কে সহজে ছাড়িতে চায় হে কে ছাড়িতে চায় ? ক্ষমতা হল এক অমৃতসুধা !
মিশরে যা হল, ধরুন আমাদের ঢাকা শাপলা চত্বরে হেফাজতের হাজার হাজার কর্মী জড়ো হল । ওরা শাপলা চত্বরে ২ দিন অবস্থান করল । এতে স্বভাববতই আরো লোক জড়ো হবে এবং বিএনপি জামাতও হয়তো যোগ দিবে।
এখন তাদের দাবী হল শেখ হাসিনার পদত্যাগ । সেনাবাহিনী হেফাজতীদের বিপক্ষে না যেয়ে শেখ হাসিনাকে ৪৮ ঘন্টা সময় দিল । শেখ হাসিনা কি করবেন এই ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ? তিনি একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী । তিনি পদত্যাগ করবেন ?
আসলে ব্যাপারটা তা না । ব্যাপারটা হল সেনাবাহিনী কোন আদর্শ লালন করে আর যারা রাস্তায় নেমেছে তারা কোন আদর্শের ।
দেখুন, মুরসির বিরুদ্ধে যারা রাস্তায় নেমেছিল তাদের আদর্শ ও সেনাবাহিনীর আদর্শ এক । তাই সেনাবাহিনী বিক্ষোভরত জনতার পক্ষ নিয়েছে । এখনকার দৃশ্য দেখুন, মুরসির সমর্থক কিন্তু রাস্তায় নেমেছে অথচ সেনাবাহিনী তাদের গুলি করতেছে ! গ্রেফতার করতেছে ! আর সিরিয়ার সেনাবাহিনীর আদর্শের সাথে বিক্ষোভরতম জনতার আদর্শের মিল ছিল না তাই সেনাবাহিনী তাদের সমর্থন করেনি ।
মুরসির উৎখাত আমি মনে করি এটা ব্রাদারহুডের চুড়ান্ত পরাজয় নয় । সামনের নির্বাচন না হোক , হয়তো তার পরের নির্বাচনে এই ব্রাদারহুডেরাই আবার ক্ষমতায় আসবে ।
যেমনটা হয়েছে তুরস্কে । মিশরের নতুন প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যেই বলেছেন ব্রাদারহুড দেশের জনগণের একটি অংশ । তাহলে প্রশ্ন দাড়ালো ব্রাদারহুড তথা আরব দেশগুলিতে ইসলামিস্টদের উত্থান ঠেকানো যাবে কিভাবে ?
একটা উপায় আছে । উদারহরণ সামনে আলজেরিয়া । এখন যেটা হবে সেটা হল ব্রাদারহুডকে আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠানো ।
তাদেরকে সন্ত্রাসী বানিয়ে দেওয়া বা তারা নিজেই সিস্টেমে পড়ে সন্ত্রাসী হয়ে যাবে । মানে মিশরের সেনাবাহিনী দ্বারা ব্রাদারহুডকে খতম করা । আলজেরিয়ায় এরকম হওয়ার পরে সেখানে ইসলামিস্টরা এখন অনেক দুর্বল ও ভবিষ্যতে তাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভবনা নেই েইতিমধ্যে মিশরে সেরকম প্রক্রিয়া অনেকটা শুরু হয়ে গেছে । ব্রাদারহুড ঘোষনা দিয়েছে তারা মুরসিকে প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্বহাল না করা পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বে না । অন্যদিকে সেনাবাহিনীও ধরপাকড় ও মুরসির সমর্থকের মিছিলে গুলি চালিয়েছে ।
নিহত ও আহত হয়েছে তো অনেক !
মুরসির সরকার ইসরায়েল ও আমেরিকার সাথে যথেস্ট সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে । তারপরেও তারাই ভিতরে থেকে বা পর্দার আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়ে মুরসিকে উৎখাত করালো । প্রশ্ন হল কেন ? কারণ মুরসি আপাতত সম্পর্ক ভাল রাখলেও ভবিষ্যৎ মধ্যপ্রচ্যে হয়তো ব্রাদারহুড ইসরায়েলের সাথে আর সুসম্পর্ক নাও রাখতে পারে মানে যখন তারা পর্যায়ক্রমে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ন্ত্রন করবে তখন। ইসরায়েলকে পেয়ে বসেছে এই আশংকা । তাছাড়া মিশর হল ইসরায়েলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী।
ইসরায়েলের যা দরকার মিশরে সব সময় মোবারকের মত ইসরায়েল বান্ধব সরকার আর না হলে অস্থিতিশীল ও গৃযুদ্ধ কবলিত মিশর। তাহলে ইসরায়েলের পুরোটা লাভ । আর গণতান্ত্রিক মিশর ইসরায়েলের জন্য ভয়ংকর ।
আর সেনাবাহিনী বলেছে তারা অতি দ্রত নির্বাচন দিয়ে বেসামরিক কর্তৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কিন্তু মনে হয় না সেই পথ এত সহজ । ধরুন, ব্রাদারহুডই আবার জয়ী হল তখন কি করবে সেনাবাহিনী ?
তবে ব্রাদারহুড ও সেনাবাহিনী যদি বিচক্ষনতার পরিচয় দেয় তাহলে মিশর গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে পড়বে না ।
আর তা হলে আমি মনে করি এতে ব্রাদারহুডই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে।
নোট : মুরসির পতনের মাধ্যমে আমার কাছে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে তাহলো সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ টিকে গেল । আসাদের পতন হওয়া বা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্ভবনাই আর নেই । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।