"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমাদের পরিবার যথেষ্ট ধর্মীয় মনোভাবের হওয়ায় ছোটবেলাতেই ন্যায় নীতি আদর্শের শিক্ষা পেয়েছি। সন্ধ্যার পরে দাদার সাথে ঘরের সিঁড়িতে বসে জোছনার আলোয় সৃষ্টিকর্তা, ইসলাম ধর্ম, সত্য মিথ্যা, অন্যায়ের শাস্তি, জান্নাত জাহান্নাম নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা করতেন। জান্নাতে হুরপরি আছে, সত্তর জন হুরপরি খেদমত করবেন। আর জাহান্নামে শাস্তি আর শাস্তি, এমন সব সাপ যেগুলো শ্বাস ছারলে সত্তর বছর পৃথিবীতে ফসল হবে না। জাহান্নামে যখন পাপিদের সেই সাপ কাটবে তখন তারা সত্তর হাত মাটির নীচে চলে যাবে, আবার তাদের উঠানো হবে, আবার তাদের সাপে কাটবে।
কিন্তু সত্তরের এত ব্যাবহার কেন এই প্রশ্ন দাদাকে জিজ্ঞাসা করতাম না, যদি আল্লাহ গুনাহ দেয়! দাদা সেই পুলসিরাতের বর্ণনা দিতেন, আমি কল্পনায় ছড়তাম সেই চুলের মত চিকন সেতুতে যার নীচে আছে জাহান্নামের আগুন। আমি কল্পনা করতাম যখন মানুষের মাথার আড়াই হাত উপরে সূর্য থাকবে তখন তাদের কেমন দেখাবে।
পাঠ্যবইয়ের বাইরে তেমন কোন গল্প, ছরা কিংবা ছোটদের বই ছিল না বাড়িতে। পাঠ্যবই হাতে পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই এপিঠ ওপিঠ মুখস্থ করে ফেলতাম। ছোট চাচার ঘরে যত উপন্যাসের বই ছিল সবগুলো পড়ে শেষ করে ফেলেছিলাম প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, আমি ভাবতাম মানুষের মাঝে একরকমের মানুষ আছে যাদের “দেবদাস” বলে।
যেদিন ছোট চাচার ঘরে দেবদাস বইটা দেখলাম, সেদিনই পড়ে শেষ করলাম দেব্দাস টাইপ মানুষদের জানার আগ্রহে। কিন্তু তেমন কোন ধারনাই পেলাম না। শুধু বুঝতে পারলাম প্রেমিকার শ্বশুর বাড়ির কাছেই ধুতি পড়ে যে যক্ষারোগী মদের বোতল হাতে পড়ে থাকে তাকেই দেবদাস বলে। সবকিছুতেই আমার জানার প্রবল আগ্রহ ছিল। তাকের উপরে সাজিয়ে রাখা মোটা মোটা হাদিসের বই আমার নাগালের বাইরে ছিল।
খাটের উপরে বালিশের উপরে বালিশ রেখে একটু উঁচু করে হাদিসের বই নামিয়ে পড়তাম। নবীদের জীবনীর একটা বই ছিল। মুসা (আঃ) এর লাঠি যা মাটিতে পরলে সাপ হয়ে যায়, কিংবা মাছের পেটের আইয়ুব (আঃ), ভালো লাগতো ইউসুফ জোলেখার প্রেম কাহিনী, ইউসুফ (আঃ) এর প্রতি জোলেখার জীবনাধিক ভালোবাসা। ভালো লাগতো প্রিয় নবীর আর তাঁর সাহাবীদের গল্প।
আমাদের পরিবার ধর্মভীরু হলেও অন্য ধর্মের প্রতি কোন অবজ্ঞা কখনো ছিল না।
আমাদের বাড়ির ঠিক দক্ষিনের বাড়িটি ছিল হিন্দু বাড়ি। এই দুই বাড়ির মাঝে বড় রাস্তা। আমাদের মধ্যে অবাধ যাওয়া আসা ছিল। আমাদের বাড়ির খাবার তাদের বাড়ি পাঠানো হতো, তাদের বাড়ির খাবার আমরা নিতাম। হিন্দুবাড়ি থেকে প্রতিবছর কাসুন্দি পাঠানো হতো।
কথিত ছিল গরুকে তারা মা ডাকে তাই কাসুন্দিতে একফোঁটা গরুর চনা দেয়। কিসের কি, আমরা সেই কাসুন্দি আম ভর্তা করে দিব্যি খেয়ে নিতাম।
আমাদের বিশাল বাড়িটি চারপাশ আমগাছে ঘেরা, আমগাছের আবার বাহারি নাম। বাড়ির উঠনে দাদা তাঁর পুত্রবধূদের জন্য একটা গাছ লাগিয়েছিলেন যখন তাঁর পুত্ররাও ছিল ছোট। সেই গাছের নাম “বউ গাছ”, দুই ঘরের চালার উপরে দুটি গাছের নাম “ চালের গাছ”, একটি গাছে আম দেখতে পেঁপের মত বলে সেইটার নাম “পেঁপে গাছ” , আরেকটা গাছে আম লিচুর মত ছোট হয় বলে “লিচু গাছ”, একটা গাছে ফাউল্লা পোকা হয় বলে সেই গাছের নাম “ ফাউল্লা গাছ” তাছারা আরো অনেক অনেক গাছ পঞ্চাশের উপরে বয়স নিয়ে এখনো ঠায় দাড়িয়ে আছে আমাদের বাড়িটি ঘিরে।
দক্ষিন আর পশ্চিম পাশে সুপারি গাছের সারি ছিল। ঝরের সময় সেগুল নুইয়ে পরতে দেখতাম। আটানব্বইয়ের বন্যায় সেই সুপারি গাছেরা সব ইন্তেকাল করে সাথে জলপাই আর কামরাঙ্গা গাছ। উঠোনের একপাশে ছিল পেয়ারা গাছ আর পেঁপে গাছ। এখনো দুইটি পেয়েরা গাছ আছে।
বড় রাস্তা থেকে বাড়িতে ঢোকার সময় দুইপাশের মেহগনি গাছের সারি পথ করে দাড়িয়ে আছে। আমাদের দুইটি কোলা ছিল। বাড়ির নিন্মাংশের ছোট জমকে কোলা বলা হয়। কোলায় পুঁইশাক, লালশাক, মিষ্টিআলু, টমেটো চাষ করা হতো। কোলা দুইটির চারপাশে উঁচু মাটির ঢিবি করে সেখানে করই গাছ লাগানো ছিল।
আমাদের পাড়ির পশ্চিম অংশে একটি চালতা গাছ আর পূর্বে ছিল একটি গাবগাছ, তারা এখনো আছে। শুধু সেই বাড়িটিতে চেনা মুখ চেনা মানুষেরা নেই।
ঝরের দিনে সারাবাড়িতে আম পড়ে বিছিয়ে থাকতো। কাদার মাঝে পা টিপে হেটে হেটে আমরা সংগ্রহ করতাম সেই আম। বৃষ্টির দিনে একটা অসহ্য ব্যাপার ছিল কেঁচো।
দেখলেই গা ঘিন ঘিন করতো। কেমন লম্বা হচ্ছে আবার সেই পিছলে দেহ নিয়ে ছোট হচ্ছে। দাগ ফেলে যাচ্ছে মাটিতে। ঝরের দিনে দাদুকে চেপে ধরে বসে থাকতাম। যখন অদূরে কোথাও বাজ পড়তো দাদুর সাথে আমরাও বলতাম,”ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন”, ঝরের রাতে সবথেকে ভালো লাগতো কাঠের পাটাতনের নীচ দিয়ে হুহু করে আসা বাতাস।
আমাদের কুকুরটা আশ্রয় নিত পাটাতনের নীচে আর বিড়ালটা নরম কোন জায়গা পেলেই ঘুমিয়ে পড়তো। আমাদের কুকুরের নাম ছিল টারজান আর বিড়ালের নাম মিউ। ছোট চাচা ওদের নাম রেখেছিলেন।
উঠোনের পূর্ব দক্ষিনে ছিল ছোট চাচার শখের বাগান। প্রায় সময় সকালে ছোট চাচার সাথে লেগে পড়তাম বাগান ঠিক করার কাজে।
বাগানে ছিল হাস্নাহেনা, বকুল, জুঁই, বেলি, বিভিন্ন গোলাপ, জবা তাছারা কয়েক রকমের পাতাবাহারি গাছ। বাগানের চারপাশে একরকমের পাতাগাছ ছিল যেই গাছের পাতার শিরা ভাজ করে চাপ দিলে শব্দ করতো। বাগানে গাঁদা ফুলের স্থান হয়নি, তাদের ডাল গুজে দেয়া হতো পুকু পারে। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির দিন গ্রামের ছেলেরা বাড়িতে আসতো ফুল নিতে। একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে আমাদের স্কুল থেকে বের হতো প্রাত মিছিল,” আমার ভাইয়ের রক্ত , মুছে যেতে দেব না” কিংবা “ রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই” এই শ্লোগানে মুখর।
মিছিলের সাথে হেটে যেতাম স্কুল পর্যন্ত। লাইনে দাঁড়িয়ে ফুল রেখে আসতাম মাটি দিয়ে বানানো আর রঙ্গিন কাগজ আর ফুলে সাজানো শহিদ মিনারের সিঁড়িতে। বাইরে আসার আগে গ্রামের স্কুলে গিয়েছিলাম। সেখানে পাকা শহিদ মিনার করা হয়েছে বিশাল করে। আমরা চারপাশে দেয়াল করা টিনের চালের স্কুলে ক্লাস করতাম, এখন নতুন করে দুইতলা একটি ভবন করা হয়েছে।
এখন ছেলেদের শহিদ মিনারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখে বিস্মিত হলাম। তারা জুতা পায়ে শহিদ মিনারে উঠছে না অবজ্ঞা হবে ভেবে, কিন্তু খালি পায়ে দাঁড়িয়ে ঠিকই সিগারেট টানতেছে।
আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল ঈদগাহ ময়দান। চার কোনায় চারটি প্রকান্ড করইগাছ ছায়া দিত সমস্ত ঈদগাহ। বছরে দুই দিন সেখানে নামাজ পরা হতো, আর বাকি ৩৬৩ দিন সেখানে গরুছাগল চরত, আর ছেলেরা ক্রিকেট খেলত।
অনেকে দেখতাম ইদগাহের মিনারের উপরে উঠে বসে থাকতো, আমার খুব শখ ছিল সেখানে উঠব, কিন্তু আমি পারতাম না। আমার বয়সী ছেলেরা দিব্যি উঠে যেত। আমি বুঝতে পারতাম আমি অন্যসবার মত না, কেন সেটাও আমি জানতাম। কারন ছিল আমাকে কখনো কারো সাথে মিশতে দেয়া হয়নি, বাইরের জগতে আমি পরিচিত না। দুইহাতে ধরে দুইপায়ে জোর দিয়ে নারিকেল গাছে উঠতে দেবেনা আমাকে কখনো।
চলন্ত ট্রলিতে ( নসিমনের মত গাড়ি ) অন্যসব ছেলেরা যেমন দৌরে উঠতে পারে, আমাকে সেই ট্রলি দেখতে বাড়ির দক্ষিন ধারে যেতে দেয়া হতো না। অত্যাধিক আদর যেমন ভাললাগার ছিল, ঠিক তেমনি বিরক্তিকর ছিল। পূবের ঘরে যখন সবাই বেড়াতে এলে তাসের আসর বসতো তখন আমাকে নিষেদ করা হতো সেখানে থাকতে। আমি একা একা তাস সাজাতাম। কিন্তু তাসের ২ থেকে ১০ পর্যন্ত আছে কিন্তু ১ নেই কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরতাম।
একসময় বর্ষায় আমার শখ করলো নৌকা চালাতে। দাদা আমার জন্য নতুন একটি নৌকা কিনে আনলেন পাঁচহাজার টাকায়। নৌকার রঙ টকটকে লালচে খয়েরি। আমার সেদিন যে কি আনন্দ হয়েছিল বলার বাইরে। দাদা আমাকে নৌকা চালানো শিখিয়ে দেন।
আমি সামনে বসে কচুরিপানা সরিয়ে দিতাম আর দাদা পেছন থেকে নৌকা বাইতো। নৌকা নিয়ে দাদার অনেক ভূত আর সাপের গল্প ছিল। রাতের বেলায় দাদা সেই ভূতের গল্প শোনাতেন।
একবার তিনি তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছেন, সেই আত্মীয়ের বাড়ি নদিতে ভাঙছে তাই ঘর সরাতে। সেখানে নদীর মুখে দেখা গেলো ইলিশ মাছের ঝাক।
ফলার মত কি এক অস্র দিয়ে মাছ মারলেন কয়েকটা। তারপরে মাছ নৌকার গলুইতে রেখে সন্ধ্যার পড়ে রওনা দিলেন বাড়ির দিকে। কিন্তু নৌকা ছুটছে অন্য দিকে। দাদা ছিলেন শক্ত সামর্থ্য লোক। তাঁর গলার স্বর দুই মেইল দূর থেকেও শোনা যেত।
তিনি গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে নৌকা চালাতে লাগলেন। একসময়ে গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে দেখলেন গায়ে জোর পাচ্ছেন না। গলা থেকে স্বর বেরুচ্ছে না। নৌকা হিজল তলার দিকে যাচ্ছে। দাদা জানতেন হিজলতলায় গেলে সেখান থেকে আর জীবিত ফিরে আসা সম্ভব না।
তিনি খোদার নাম নিয়ে আবার নৌকা বাইতে শুরু করলেন। এদিক ওদিক করে ভোরে যেয়ে দাদা বাড়িতে নামলেন। নৌকার গলুই থেকে ইলিশ মাছ বের করতে যেয়ে দেখলেন মাছের মাথা আর লম্বা কাঁটা ছারা কিছুই অবশিষ্ট নাই। সেই পিশাচনি খেয়ে ফেলেছে সব।
আরেকটা গল্প দাদা প্রায় সময় বলতেন।
আমাদের বাড়ি থেকে দক্ষিন পশ্চিম কোনে হিন্দু বাড়ির কোনায় একটা খুব পুরনো গাবগাছ ছিল। সেটাকে বলা হতো “চিত্তার গাবগাছ”, কারন হিন্দুবাড়ির কর্তার নাম ছিল চিত্তা সরকার। সেই চিত্তার গাবগাছ ঘেরা ছিল বাঁশঝাড়ে। দিনের বেলাতেও বড় রাস্তার পাশের এই অংশটি ভয়ানক অন্ধকার থাকতো। অনেক গল্প কথিত ছিল এই গাবগাছকে নিয়ে।
অনেকে নাকি সাদা কিছু দেখেছে সেখানে, আবার অনেকে মেয়েলী নাকি কন্ঠে কাউকে ডাকতে শুনেছে। প্রায়সময় নাকি দাদা বাজার করে রাতে বাড়ি ফেরার পথে সেই গাবগাছের পাশে রাস্তার দুইপাশে দুই পা রেখে দীর্ঘকায় বিশাল এক দ্বৈত দাঁড়িয়ে পথ অবরোধ করতো। ভয় পেলে নাকি সেই দ্বৈত ঘার মটকে দেয়। দাদা সাহস করে বলত,”সরে দাড়া”, দ্বৈত যখন দেখত দাদা ভয় পাচ্ছে না তখন পথ ছেরে দিত।
দাদারা দুই ভাই ছিলেন, হাসেম তালুকদার আর মন্নাফ তালুকদার।
দাদার বড় ভাই হাসেম তালুকদার এর বাড়ি ছিল একটু দূরে। তিনি মাঝে মাঝে আসতেন আমাদের এখানে লাঠি হাতে। বিশাল দেহের সেই লোকটিকে দেখলে ভয়ে তাঁর ধারে কাছে ঘেঁষতাম না। তার খাতির যত্নের জন্য সবাই ব্যাস্ত হয়ে পরতেন। তিনি ছিলেন মাওলানা টাইপের লোক।
বেশ কিছুদিন কোলকাতায় ছিলেন। ছোট বেলায় জৈনপুরী পীর নামের একজন পীরের শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। তিনি থাকতেন সেই পীরের সাথে পীরসাহেবের বিশাল পঙ্কিতে। পীর সাহেবের নাকি অনেক মোজিজা দেখানোর ক্ষমতা ছিল। তার পঙ্কি বর্ষায় ভেসে চলতো এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়, তার পূর্বপুরুষেরা নাকি বাগদাদ নাকি এর পার্শ্ববর্তী কোন এলাকা থেকে এদেশে এসেছিলেন ধর্মপ্রচারে।
সেই লোক ইশারা করলে নাকি তার বিশাল নৌকা থেকে পশু পাখিরা চারন ভুমিতে নেমে পড়তো আর সন্ধ্যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলে যেখানেই থাকতো সেখান থেকেই ছুটে আসতো নৌকায়। এরকম অনেক গল্প দাদা তার ভাই এবং সেই পীরসাহেব কে নিয়ে করতেন।
আমার শৈশব, কৈশোর আর তারপরের লাগামহীন দিনগুলি - ১
আমার শৈশব, কৈশোর আর তারপরের লাগামহীন দিনগুলি - ২
(পর্বভিত্তিক ভাবে চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।