খলিলুর রহমান
বাংলা বিভাগ(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠিত কোন ভাষার ভাষাভাষী মানুষ হওয়াটা যেমন, একদিকে গৌরবের বিষয়, তেমনি সে ভাষার ব্রাতীকরণ; উপরন্তু বিকৃতিকরণের মধ্যে বর্তমানে যে একপ্রকার বুনো উল্লাস বাংলাদেশের সমাজ-রাজনৈতিক আবহে দৃশ্যমান। তা রীতিমত পৌশাচিক ও বটে। পৃথিবীর অনেক ভাষার মানুষ নিজ মাতৃভাষাকে নোয়াম চমস্কি কথিত “কম্পিউটারের ভাষা” তথা বিশ্বায়নের ভাষা ইংরেজীর কাছে নির্লজ্জ ভাবে সঁপে দিয়েছে; এতে তারা অতিআধুনিকায় উন্নীত হওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা হচ্ছে । কিন্তু মাতৃভাষাকে সর্বক্ষেত্রে ব্রাত্যীকরণ এবং বিকৃতিকরণের ফলে তাদের নিজ সংস্কৃতি যেমন হয়েছে বিপন্ন ,তেমনি হয়েছে আত্মমর্যাদাহীন । এ সুযোগে আধিপত্যবাদীরা প্রসারিত করেছে তাদের সাম্রাজ্য।
বিশ্ববিখ্যাত ভাষা বিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি ইতোমধ্যে ভবিষদ্বাণী করেছেন যে, মাত্রএক প্রজন্ম পরেই পৃথিবীতে থাকবে একমাত্র কম্পিউটারের ভাষা। আর এই কম্পিউটারের ভাষার সৃষ্টিকর্তা পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদীরা। মজার বিষয় হল এর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে মার্কিনী এবং ইউরোপ এ দুই মোড়লের মধ্যে দ্বন্দের আভাস দেখা দিচ্ছে । আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখব যে, কম্পিউটারে ভাষা নির্বাচনে English(U.S.) এবংEnglish(International) এ দুটো অপশন আছে। এর মধ্যে কেউ যদি English(International) অপশনটি পছন্দ করে , তবে সফ্টওয়্যারটি ঠিক মতো কাজ করবেনা।
সুতরাং, এক্ষেত্রে বাধ্যহয়েই English(U.S.) টিই একমাত্র অপশনটি ক্লিক করতে হবে। সহজেই বোধগম্য হয় যে, আমরা তথাকথিত কম্পিউটারের ভাষার মাধ্যমে মার্কিনীদের ইংরেজী আত্তীকরণ করছি। আর এই ভাবেই শুরু হয়েছে cyber collonisim । বিশ্বব্যাংক, আই.এম .এফ –এর ঋণ বাণিজ্যের প্রলোভনে অনুপ্রবেশ করাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্টের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যাণ কর্তৃক প্রর্বতিত “বিশ্ব গ্রামের” নীলনক্সা। যেখানে মোড়ল থাকবে একমাত্র মার্কিনিরা ।
অন্যদিকে আত্মমর্যাদার অভাবে বিপর্যস্ত জাতি যখন সচেতন হয়ে ঘুরে দাড়াবার চেষ্টা করবে, তখনই আসবে সামরিক হস্তক্ষেপ। মূলতঃ প্রাথমিক ভাবে সাংস্কৃতিক ও জাতিসত্ত্বাকে বিনষ্ট করণ এবং এরই ফলশ্রুতিতে হীনমন্যতায় জর্জরিত একটি জাতিকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক , সামাজিক ভাবে আধিপত্যবাদী শক্তির শৃংখলে বন্দী করার একটি পুরানো কৌশল। এতো গেল বৈশ্বিক পট যেখানে আমাদের অবস্থান টুকু ধরে রাখতে আমরা নিত্য নিজেদের ঐশ্বর্যময় ভাষাকে বিলীন করে দিচ্ছি। এই প্রচেষ্টার ফলেই ব্রিটিশরা , আমাদের প্রায়২০০ বছর শাসন করেছে। একই পন্থা গ্রহণ করেছিল পাকিস্তানীরা।
দৈশিক প্রেক্ষাপটে তৎকালীন পাকিস্তান আমলে আরবি হরফে বাংলা লেখার হীন প্রচেষ্টা দেখেছি। এবং আরো অবাক হয়েছি তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের Pan Islamism এর জিগির তুলে , এ অপপ্রয়াসকে বৈধ করার নির্লজ্জপনা। তারও আগে দেখেছি বাংলা ভাষাকে ব্রাহ্মণ্য বাদীদের সংস্কৃতকরণের আকাক্ষা। সময়ের পরিক্রমায় বাংলা ভাষার উপর একই ধরনের আক্রমণ বারবার ঘটছে। কিন্তু , হায়! তারপরেও আমাদের বোধদয় হয়নি।
আমরা বিবেকহীন জাতি বলেই , নিজ ভাষাকে অন্তরে ধারণ করতে পারিনাই। কথ্য রূপে স্বীকৃতি দিয়েছি মাত্র। দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির :যুদ্ধ করে শত্রু হটিয়ে এখন নিজেরাই , পশ্চিমা আধিপত্যবাদী শক্তির নাগপাশকে বরণ করে নিতে মরিয়া; অতি আধুনিক ও তথাকথিত সভ্য হবার অভিপ্রায়ে। আমরা বাংলাকে বিসর্জন দিচ্ছি ; বিশ্বায়নের তথাকথিত সুবিধা গ্রহণের জন্য। ঢাকা শহরের উত্তর পাড়াগুলোতে হিন্দী ও ইংরেজী ভাষার ঢঙে বাংলা উচ্চারণ তথাকথিত একটি আভিজাত্যের প্রতীক।
এজন্য ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের প্রচলন করে দেশ ও সংস্কৃতিতে ছিন্নমূল একটি পরগাছা প্রজন্ম ইতোমধ্যে তৈরি করে ফেলেছি। যাদের অন্তঃসার শূন্য জ্ঞান এবং কিছু তোতা পাখির মাতো মুখস্থ ইংরেজী উচ্চারণ দেখে আমরা চমৎকৃত হচ্ছি । গাজী ট্যংকের সেই বিজ্ঞাপনের মতো বলছি ;“বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে”। কিকিন্তু এসব ছিন্নমূল ইংরেজী মাধ্যম
কিন্তু এসব ছিন্নমূল ইংরেজী মাধ্যম,প্রজন্মের বেড়ে উঠাটা সাময়িক মনোহর হলেও, বাস্তবে এরা দেশ ও জাতির জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনেনি। স্বদেশে বাসকরে বিদেশী সংস্কৃতিতে বড় হওয়া এসব প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা তাদের চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে দেখছে বিস্তর ফারাক।
তাই তারা হয়ে পড়ছে হতাশা গ্রস্থ এবং বিভ্রান্ত। দেশে এবং বিদেশে তারা কেউ হতে পারছেনা সফল। দেশকে বিশ্বের সামনে সঠিক ভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এসবই হচ্ছে বাংলা ভাষার ব্রাত্যীকরণের ফলাফল।
অপরদিকে গত এক দশকে গড়ে উঠেছে অর্ধশত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়।
এসব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হচ্ছে সমাজের উঠতি মুৎসুদ্দী শ্রেণী, যাদের কাছে শিক্ষার চেয়ে মুখ্য বিষয় হলো ব্যবসায়িক লাভ। এজন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠাঁই হয়নি বাংলা সাহিত্য বিষয়ক বিভাগের। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো ,উচ্চ-মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা শিক্ষাই যথেষ্ট,এবং চাকুরির বাজাওে এর কোন চাহিদা নেই। কিন্তু বাণিজ্য, বিজ্ঞান সহ অন্যান্য যেসব বিষয় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় , তা অস্পূর্ণ এবং ফটোকপি নির্ভর। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা গ্র্যাজুয়েটরা হচ্ছে শুধুমাত্র কেরাণী।
এসব মুৎসুদ্দীরা ভুলে গিয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য হল জ্ঞানের অন্বেষণ করে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা গ্র্যাজুয়েটরা দেশকে নেতৃত্ব দিবে, জাতির ক্রান্তিলগ্নে দিক নির্দেশনা প্রদান করবে। মনুষ্যত্বের মূল্যবোধ সম্পন্ন এসব গ্র্যাজুয়েটরা দেশকে বিশ্বের সামনে সম্মানজনক ভাবে দেশকে উপস্থাপন করবে। কিন্তু এক্ষেত্রে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হচ্ছে। কারন হচ্ছে তাদের শিক্ষাক্রমে জাতীয় ভাষা, সংস্কৃতি সম্পূর্ণ রূপে উপেক্ষিত।
তারা লোকদেখানো রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালন করে ইংরেজী হরফে বাংলা লিখে। এ ব্যাধি আক্রান্ত করেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগের শিক্ষকদের মতে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলার দরকার নেই। এতে ক্যারিয়ার তৈরি হয়না। ব্যাংক, বীমা, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করা যায় না।
কিন্তু এসব শিক্ষকরা ভুলে গেছেন যে, চাকুরি অথবা অর্থ উর্পাজনই শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। কারণ এদেশে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেই ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করা যায় । স্বদেশী ভাষা ,সংস্কৃতি, শিক্ষা, সভ্যতা যদি উচ্চতর শিক্ষায় অর্ন্তভূক্ত না করা হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে হতে থাকবে ছাত্র রাজনীতির নামে দুবৃর্ত্তপনা, অস্ত্রের ঝনঝনানি, ইভটিজিংয়ের মতো ঘটনা। বাংলা ভাষার আধুনিকীকরণ হবে বাধাগ্রস্ত,হয়ে পড়বে মৃতপ্রায়। বাংলা হারিয়ে গেলে আমরা জাতিসত্ত্বার পরিচয় হারাব।
আমরা আত্মপরিচয়হীন জাতির মতো অস্তিত্বসংকটে পড়ব। আর এসুযোগে বৈদেশিক আগ্রাসী শক্তি আবারও হানা দিবে এ সোনার বাংলায়। যেমন, অধুনাকালে চীনের হংকং প্রদেশের কথাই এক্ষেত্রে বিবেচ্য। একই দেশ একই সংস্কৃতি হওয়া সত্ত্বেও ,ব্রিটিশদের আরোপিত কৌশলের জন্য তারা মানসিক দিক দিয়ে অপরিচিত।
এতো গেল বাংলাভাষার ব্রাত্যীকরণের প্রসঙ্গ।
এর বিকৃতিকরণের পরিনাম আরো ভয়াবহ। এ কথা অনস্বীক্্ার্য যে, আমরা কেউ নিজ ভাষা সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধু উচ্চারণ করতে পারিনা। কিন্তু, বিকৃতিকরণকে মেনে নিতে পারিনা। বর্তমানে কিছু নাট্যকার প্রমিত ভাষার বদলে পাড়া-মহল্লার ছিঁচকে ও বখাঁটেদের ভাষা নাটকের মাধ্যমে প্রচার করছে। তাই এখন নাটকে দেখা যায়,খাইছি, গেছি, চাপ, ফুট, বাঁশ দিমু ইত্যাদি।
এমনকি কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণীর বাচ্চাও বিষয়ক কটু কথা প্রচারিত হয় সাড়ম্বে। এক্ষেত্রে এসব তথাকথিত নাট্যকারের অভিমত, যে রীতিতে আমরা কথা বলি, সে রীতিই তারা নাটকে প্রচার করেন। কিন্তু আবারো তারা যে ভাষার প্রমিত রীতির প্রসঙ্গটি সর্ম্পকে একেবারেই অজ্ঞ, তা প্রমাণিত হয়। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষায় রয়েছে, কিছু লধৎমড়হ ড়িৎফ। কিন্তু এশব্দগুলো কি সর্বক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী?এসব ভাষা নাটকে ব্যবহারের ফলে তরুণ প্রজন্ম হচ্ছে বখাঁটে সংস্কৃতির ধারক।
এসব নাটকের ভাষা অশ্লীল ,তাই নাটকের কাহিনীও হয়ে থাকে কুরুচিপূর্ণ যেমন; পরকীয়া,ইভটিজিং ইত্যাদি। তাই এসব নাটক কোন শিক্ষা দেয়না, পরিপূর্ণ বিনোদন দেয়না।
এরই সাথে যুক্ত হয়েছে,এফ.এম. রেডিও গুলো। যেখানে বাংলা ভাষাকে শুধুমাত্র ব্রাত্যীকরণ ও বিকৃতি করণ দেখা যায় না। আর. জে .দের ভুল ইংরেজী উচ্চারণ এবং ব্যকরণগত দুর্বলতাও লক্ষ্যণীয়।
বেসরকারী টি.ভি ও সংবাদপত্রের খবরগুলোতে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার ও বিকৃতি করণের দৃশ্যটি আরো ভয়াবহ।
বাংলাদেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অনুপস্থিতি, এফ. এম. রেডিও গুলোতে বিকৃত বাংলা ভাষার ভুল ব্যবহার এবং মোবাইল অপারেটরদের ইংরেজী ভাষায় বাংলা ব্যবহার প্রচলনের অপচেষ্টা এবং এসব ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য। আমাদের এই কথা ই মনে করিয়ে দেয় যে জাতি হিসেবে বাঙালি কতটা নির্বোধ । বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের অবহেলা এবং অতিআধুনিকতা বরণের ছলে আমাদের পুনরায় উপনিবেশিক শক্তির অধীনস্থ হওয়ার ভুল পন্থা। আমাদের মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র বাঙালি সংস্কৃতির পরিচায়ক।
বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে অবস্থান করে নিতে হলে, আমাদেরকে অবশ্যই বাঙালি সংস্কৃতি তথা বাংলা ভাষার মাধ্যমে অর্জন করে নিতে হবে। আমরা কেউ কখনোই খাঁটি ইংরেজ, মার্কিনী, আরবীয় হতে পারবনা। নিজেকে বিশ্ব সংস্কৃতির মানুষ ভাবা আর ভির দেশী সংস্কৃতির মানুষ ভাবা এক কথা নয়। আধুনিকতার চরম শিখরে পৌছাতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই নিজ ভাষা,নিজ সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ আত্মস্থ করতে হবে। আমাদের অস্তিত্বের জন্য বাংলা ভাষাই হবে আমাদের একমাত্র অবলম্বন।
নয়তো আমাদের মায়ের ভাষার অবস্থান হবে মালয় ভাষার মতো এবং সংস্কৃতি হবে হংকং-এর মতো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।