কেউ বুঝে না এই আমাকে...তাই আমিও কাউকে আর বুঝতে চাই না।
মোদের গরব মোদের আশা
আ-মরি বাংলা ভাষা ॥
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সামনে রেখে বাংলা ভাষা নিয়ে খানিকটা ঘাটাঘাটি করলাম। জানতে চেষ্টা করলাম, আমাদের মার্তৃভাষার উৎপত্তি আর বিকাশ সম্পর্কে। যদিও এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, লেখালেখি হয়েছে। স্বল্প জ্ঞানী আমি সেখান থেকেই জানার চেষ্টা করেছি বাংলা ভাষার স্বরূপ।
বিশাল এক গবেষণার ভান্ডার বাংলাভাষা। এ তো আর একদিনে হুট করে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে নি। সহস্র বছরের ক্রম বিবর্তনে তৈরি হয়েছে আজকের রূপ। বাংলা ভাষা নিয়ে আজকের পড়াশোনা আর ঘাটাঘাটি থেকে যা যা জেনেছি অতি সংক্ষেপে তা এখানে শেয়ার করছি।
বাংলাভাষার উৎপত্তি কাল নিয়ে নানামুনির আছে নানা মত।
এক সময় ভাবা হতো সংস্কৃত ভাষা থেকে সৃষ্টি হয়েছে বাংলা ভাষা। বলা হতো, বাংলা হচ্ছে সংস্কৃত ভাষার বিবর্তিত রূপ। কিন্তু গবেষকদের গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য এই মত ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করেছে। ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সহ অন্য অনেক ভাষাবিদদের গবেষণা থেকে জানা যায়-- সংস্কৃত নয়, প্রাকৃত ভাষা থেকে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে বাংলা ভাষা। বিতর্ক এখানে থেমে নেই প্রাকৃত ভাষার কোন শাখা থেকে বাংলার জন্ম, তা আবার নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত ভাষার জন্ম প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্টভাবে জানা গেলেও বাংলা ভাষা সম্পর্কে সে কথা বলা যাবে না। পৃথিবীর প্রধান পাঁচটি ভাষা-বংশের একটি হচ্ছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-বংশ বা আদি আর্য ভাষাগোষ্ঠী। আদি আর্য ভাষাগোষ্ঠী থেকেই জন্ম হয়েছে বাংলা ভাষার।
গবেষকদের মতে, বাংলা ভাষার উৎপত্তি প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। আধুনিক বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের পথে পিছু হেঁটে আমরা ধারাবাহিকভাবে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারি প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার প্রাচীনতম রূপ বৈদিকে।
সুপ্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্যতম শাখা ইন্দো-ইরানীয়। ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর আবার দুটি শাখা- একটি ইরানীয়, অন্যটি ভারতীয় আর্য ভাষাগুচ্ছ। বাংলা এই আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত আধুনিক কালের একটি ভাষা।
ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর আর্যশাখা বেশ কয়েকটি দলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। এই নবাগত সুসংবদ্ধ ভাষাগোষ্ঠীর মধ্য থেকেই বর্তমান উত্তর ভারতের বিভিন্ন ভাষার উদ্ভব হয়।
আর্যভাষা কালেক্রমে তিনটি স্তর অতিক্রম করে।
১. প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা : খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৬০০ অব্দ
[ধ্রুপদী সংস্কৃত- ঋকবেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, ব্রাক্ষ্ণণ ও উপনিষদ]
২. মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা : খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ থেকে ১০০০ খিস্টাব্দ
[সংস্কৃত- রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, নাটক, গীতিকাব্য, চম্পুকাব্য, ব্যাকরণ অলঙ্কারশাস্ত্র ইত্যাদি। বাল্মীকী, ব্যাস, পাণিনি, ভাস, কালিদাস, বাণ, দণ্ডী, কৌটিল্য(চাণক্য) এ ভাষার বিখ্যাত লেখক; এবং পালি-বৌদ্ধ জাতক, ত্রিপিটক পালি ভাষায় লিখিত]
৩. নব্য ভারতীয় আর্যভাষা : খ্রিস্টাব্দ ১০০০ থেকে বর্তমান
পাল রাজাদের আমলে রচিত বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ।
সমগ্র উত্তর ভারতে, আফগান সীমান্ত থেকে আসাম সীমান্ত পর্যন্ত, হিমালয় থেকে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত আর্যভাষাগোষ্ঠীর বিস্তার। আমাদের বাংলা এই গোষ্ঠীর একটি বড় শাখা।
আর্যরা ভারতে আসার আগে থেকেই এখানে ভেড্ডি, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় প্রভৃতি অনার্যরা বাস করত। এদের মধ্যে বাঙালির উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল অস্ট্রিকরা। আজ থেকে ৩২০০ বছর পূর্বে রচিত গ্রন্থ বেদে 'বঙ্গ' নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়। বঙ্গ সম্ভবত একটি অস্ট্রিক শব্দ।
সংস্কৃতকে বলা চলে বাংলার অতি দূর সম্পর্কের আত্মীয়।
মাগধী প্রাকৃত বা গৌড়ী প্রাকৃত- যে ভাষার থেকেই বাংলার জন্মের কথা বলি না কেন, প্রকৃত সত্য হচ্ছে, আজকের বাংলা ভাষা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। বাঙালির রক্তে যেমন মিশে আছে বহু জাতি- ভেড্ডি, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোল, আলপাইন, আর্য, শক, আরব, তুর্কী, মোগল, পাঠান প্রভৃতির রক্ত, তেমনি তার ভাষার মধ্যেও রয়ে গেছে অজস্র বিদেশি শব্দ। বাংলার মধ্যে ঢুকে নিজের অজান্তেই সে কখন হয়ে উঠেছে বাংলা শব্দ।
খ্রিস্টিয় সপ্তম শতকে শতকে মাগধী প্রাকৃতকে অবলম্বন করে বাংলা ভাষার বুনিয়াদ স্থাপন হয়। কিন্তু তারও আগে হাজার বছর ধরেই, ধীরে ধীরে, চলছিল এই সৃষ্টিকাজ।
প্রায় এক হাজার বছর আগে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন 'চর্যাপদ' লেখা হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, চর্যার রচনাকাল খ্রিস্টাব্দ ৬০০ থেকে ১২০০ এর মধ্যে। এ সময় বাংলায় চলছিল গুপ্ত-পাল-সেন-বর্মণদের রাজত্ব। গুপ্ত এবং পালরা ছিলেন বৌদ্ধ। তাই চর্যাকার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রতি তাদের কোনো বিদ্বেষ ছিল না।
কিন্তু কলিঙ্গের বর্মণ এবং কর্ণাটকের সেন রাজারা ছিলেন ব্রাম্মণ্যবাদী। সিংহাসনে বসেই তারা রাজ্য থেকে বৌদ্ধদের বিতাড়িত করেন।
ড. আহমেদ শরীফ-এর মতে, আর্য এবং সেনরা বাঙালিদের তাদের মাতৃভাষা বাংলা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল। আর্যদের কাছে অনার্যরা এমন কি মানুষ বলেও গণ্য হত না। এ কারণেই বিভিন্ন গোত্রের অনার্যরা আর্যদের কাছে পরিচিত ছিল দস্যু, রাক্ষস, যক্ষ, নাগ, পক্ষী, কুকুর, দৈত্য প্রভৃতি নামে।
অর্থাৎ বহিরাগত এসব রাজারা বাংলাকে কোনো প্রকার মূল্যই দেয়নি। কিন্তু তবুও তারা বাংলা ভাষাকে নিশিচহ্ন করতে পারেনি।
বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের সময়সীমা খ্রিস্টাব্দ ১২০০ থেকে খ্রিস্টাব্দ ১৮০০ অব্দ। ১২০৪ সালে মুসলিম বিজয়ের পর থেকে ১৮৩৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত এখানকার রাজভাষা ছিল ফারসি। এই দীর্ঘ সময় বাংলাভাষা পায় নি, শাসক গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা।
তবে থেমে থাকে নি বাংলা ভাষার বিস্তার। সাধারণ মানুষের মুখে মুখে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লালিত ও বিকশিত হয়েছে বাংলা ভাষা।
এ সময়ের বাংলা ভাষার নিদর্শন পাওয়া যাবে মালাধর বসুর 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়', কৃত্তিবাসের 'রামায়ণ পাঁচালী' কবীন্দ্র-পরমেশ্বর-শ্রীকর নন্দীর 'মহাভারত পাঁচালী', বিপ্রদাস-বিজয়গুপ্তের 'মনসামঙ্গল', মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চণ্ডীমঙ্গল', ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল' প্রভৃতি কাব্যে। 'মনসামঙ্গল' ছাড়া এসব কাব্যে পশ্চিমবঙ্গ-বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলের উপভাষা এসব কাব্যে ব্যবহৃত হয়েছে, ব্যবহৃত হয়েছে অনেক সংস্কৃত শব্দ।
'মনসামঙ্গল' কাব্যে পূর্ববাংলার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
কারণ মনসামঙ্গল প্রধানত পূর্ববঙ্গে রচিত হয়েছে। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর মধ্যযুগে প্রচলিত ভাষার ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। বৈষ্ণব ও অনুবাদ সাহিত্যে প্রচুর তৎসম শব্দ ব্যবহৃত হতে থাকে। বৈষ্ণব পদাবলিতে বিদ্যাপতি এবং গোবিন্দ দাসের ভাষায় বাংলার পাশাপাশি মৈথিলি ভাষা স্থান পায়। অন্যদিকে ষোড়শ শতাব্দী থেকে মুসলিম কবিদের রোমান্সমূলক প্রণয়কাব্যে প্রচুর পরিমাণ আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হয়ে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা সঞ্চারিত হয়।
শাহ মুহম্মদ সগীর, আলাওল, মুহম্মদ কবির, দৌলত উজির বাহরাম খান, শেখ চান্দ প্রমুখ কবি এ ক্ষেত্রে পালন করেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। ভারতচন্দ্র রায়-গুণাকরও তার কাব্যে প্রচুরসংখ্যক আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করে বাংলা ভাষার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
উনিশ শতকে বাংলা ভাষা গদ্য এবং পদ্য, এই দুই ধারায় বিকশিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শক্তি নিজেদের প্রয়োজনে কাজের গদ্য সৃষ্টিতে সহযোগ দিয়েছিল। ক্রমেই কাজের গদ্য থেকে জন্ম নিল বাংলা গদ্য ভাষা।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়েছে ইংরেজি, ফরাসি, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ প্রভৃতি ভাষার অনেক শব্দ। চিঠি-পত্র, দলিল-দস্তাবেজের পরিধি অতিক্রম করে ক্রমেই এসব ভাষা সাধারণ মানুষের কাছাকাছি চলে আসে। উনিশ-বিশ শতকে বাংলা ভাষা নানা মাত্রিকতায় বিকশিত হয়েছে।
মধুসূদনের হাতে বাংলা ভাষা পেয়েছে পেশির লাবণ্য, রবীন্দ্রনাথ তাকে করে তুলেছেন মানবচিত্তের সমুদয় ভাবের প্রকাশক্ষম। নজরুলের হাতে এসে বাংলা ভাষায় সঞ্চারিত হয়েছে দ্রোহের আগুন।
জসীমউদ্দীন আবার সেখানে নিয়ে আসেন লোকায়ত জীবনের উত্তাপ। লোক কবিদের রচনায় পাই বাংলা ভাষার আরেক স্বতন্ত্র রূপ। সব মিলিয়ে উনিশ-বিশ শতকের কবিতার হাত ধরে বাংলা ভাষা ক্রমেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে।
গদ্য ভাষার ক্ষেত্রে প্রথমেই স্মরণে আসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা। অবশ্য তার আগে উইলিয়াম কেরি, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার কিংবা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাও আমরা স্মরণ করব।
তবে বাংলা ভাষাকে প্রথম সুশৃঙ্খল এবং শিল্পিত করে তোলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলা গদ্যে বিরামচিহ্নের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং বিষয়ানুগ ভাষা প্রয়োগ বিদ্যাসাগরের অক্ষয় কীর্তি। এরপর বঙ্কিমচন্দ্র, মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরীর শিল্পিত হাত বাংলা গদ্য ভাষাকে নিয়ে গেছে শিল্পের সিদ্ধিচূড়ায়।
একুশ শতকে এসে বিশ্বায়নের প্রভাবে বাংলা ভাষায় এখন আবার নতুন বাঁক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল।
পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার পেছনে নানা ঘটনা, নানা অনুষঙ্গ। সন্দেহ নেইথ অনাগতকালে বাংলা ভাষা অঙ্গীকার করবে আরও অনেক নতুন মাত্রা, অঙ্গে জড়াবে সে আরও কত অলঙ্কার!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।