ফেব্রুয়ারি মাস চলছে, চলছে ভাষার বন্দনা, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চা। আরো অনেক কথাই হবে হয়তো, আবার নেতিয়েও যাবে। তবু বলতে চাই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের যে মর্মকথা তা বাস্তবায়ন হবে কি না, অথবা না হওয়ার কারণ কি? সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারনের ফলশ্রুতিতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং বাংলাদেশের গৃহীত সংবিধানে ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ভাষা হবে বাংলা। এই রাষ্ট্রভাষাটি অবশ্যই বাংলাদেশ নামক ভূ-খন্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা। সেইসাথে ১৫৩(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে বাংলায় এই সংবিধানের একটি নিভর্রযোগ্য পাঠ থাকবে।
অফিস আদালতসহ সবর্স্তরে বাংলা ভাষা চালুর জন্য ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রবর্তন করা হয়। এই আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালতে, আধাসরকারী, স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতিত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং আন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। তারপর (২) উপধারায় বলা হয় ৩(১) ধারায় উল্লেখিত কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতিত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন উহা বেআইনী ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।
বাংলা ভাষা প্রচলন আইন অনুসারে আদালতে বাংলা ব্যবহার করতে গিয়ে দেখা গেছে ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারাকে আকার্যকর করা হয়নি। সরকার অত্র ধারা মতে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার স্থগিত না করায় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন মূলত অকার্যকর থেকেই যায়।
একই রকম ভাবে ফোজদারী কার্যবিধির ৫৫৮ ধারাও প্রযোজ্য । এছাড়া ফৌজদারী কার্যবিধির ২২১(৬), ৩৭৫(১), ৩৬০(৩), ৩৬১(১), ৩৬৪, ৩৬৭, ৩৭১ ও ৩৭২ ধারাতে আদালতের ভাষা বিষয়ে কিছু বিধি বিধান রয়েছে। অন্যদিকে হাইকোর্ট জেনারেল রুলস অ্যান্ড অর্ডারে ও ইংরেজী ভাষায় আদালত পরিচালনার দিক নির্দেশনা রয়েছে। এসব উপেক্ষা করেও একাধিক মামলায় কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় দিয়েছেন। এই রায়গুলি বাংলায় হওয়ার কারণে কোনভাবে দুর্বল হয়েছে এমন কথা অদ্যবধি শোনা যায়নি।
প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য ইংরেজী ভাষা অধিক জরুরী। ধরেই নিলাম ব্যাপারটির গুরুত্ব অনেক কিন্তু সেক্ষত্রে একটি মাত্র অনুবাদ সেল সেই চাহিদা পূরণ করতে পারার কথা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার যে সম্মান ও স্বীকৃতি অর্জন হয়েছে সেটাতো কেবল মাতৃভাষা বাংলার জন্যই হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে একটাই ভাষার সংগ্রাম হয়েছে। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিক এবঙ আরো অনেকে।
পৃথিবীর পাঁচ ভাগের একভাগ মানুষ চীনা ভাষা ব্যবহার করে, জাপান, জার্মান, ফরাসিরাসহ আরো অনেকে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষা ব্যব্হার করে না, তাতে তাদের আন্তর্জাতিক মান নষ্ট হয়েছে বলে মনে হয় না। এমনকি তারা আমাদের তুলনায় এগিয়ে আছে, না পিছিয়ে এমন প্রশ্ন তোলাও বোধ হয় বোকামি।
বাংলাদেশের প্রকৃত শিক্ষার হার যতই হোক এখনো সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করেনি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা যতই হোক ইংরেজী পড়তে পারলেও বুঝতে বা লেখতে পারা মানুষের সংখ্যা ১ শতাংশের বেশী হবে বলে মনে করার কোন কারণ নেই। আদালতে মাতৃভাষা চালু না হলে আমজনতা কোন কালেই তার কী বিচার হলো সেটা বুঝবে কি না তা থেকে যাবে অন্ধকারে।
ধরে নেই একজন সামান্য কিছু পড়ালেখা জানেন, তাতে তার ইংরেজী বুঝার কোন ক্ষমতাই নেই। ১০ পৃষ্টা হোক আর ১০০ পৃষ্ঠা হোক ভাষা না বুঝা ব্যক্তিকে যদি ঐ রায়ে ফাঁসিও দেওয়া হয়ে থাকে তাতে তার কোন বোধগম্যতাই কাজ করে না। আর যদি এই রায়টিই মাতৃভাষা বাংলায় দেওয়া হয় কারো কোন রকম পড়ালেখা জানা ছাড়াও যদি ন্যূনতম পড়তে পারা একজন লোককে রায়টি পড়তে দেওয়া তাতে বুঝতে সক্ষম হয় যে কি রায় তার জন্য দেওয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিককালে আইনমন্ত্রি এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়েছেন অচিরেই আইন আদালতে বাংলা ভাষা চালুর ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু কবে চালু করা হবে সেটি বুঝা গেল না ।
দীর্ঘ ৬০ বছর পর, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার সম্মান ও স্বীকৃতি অর্জনের ৮ বছর পরও যদি অপেক্ষা করতে হয় মাতৃভাষা চালুর জন্য তাহলে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিক ভাষার সংগ্রামে প্রাণ দিয়ে কি ভুল করেছে বলে মনে করব? পৃথিবীর তাবত ইতিহাসই বিজয়ের ইতিহাস, এখনো পরাজয়ের কোন ইতিহাস রচনার ইতিহাস নেই। আমাদের জয়ের ইতিহাস পাকিস্থানের ২৩ বছরের শৃংখল মুক্তির পরও কেন অবহেলিত? কলমের এক খোঁচায়, আবার চোখের নিমিষে কত আইনই তো পাশ হয়েছে। বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটি কার্যকর করতে কিংবা দেওয়ানি কার্যবিধি ও ফৌজদারী কার্যবিধির সামান্য ২/১টি বিধান অকার্যকর করতে কেন এত গড়িমসি? বাংলাভাষার সম্মানের অপেক্ষা আর কতকাল?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।