ভাষার উদ্ভব কখন-কিভাবে তার কোন সঠিক ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস আবিষ্কার করা যায়নি। বাংলাভাষার রক্তিম ইতিহাস ১৯৫২ সালে রচিত হলেও এই ভাষার রয়েছে হাজার বছরের সংগ্রামী ইতিহাস। বাংলা শব্দের উৎপত্তি নিয়েও রয়েছে ানেকগুলো গবেষণা লব্ধ মত।
পৃথিবীর ভাষাসমূহের মধ্যে বাংলাভাষার একটি বিশিষ্ট স্খান ও মর্যাদা বিদ্যমান। বাংলাভাষার উৎপত্তি নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে।
অনেক পণ্ডিতের মতে, ঐতিহাসিক যুগে আমাদের দেশে প্রচলিত সর্বপ্রাচীন ভাষাকে ‘প্রাচীন প্রাকৃত' রূপে আখ্যায়িত করা চলে। তখনও কোন লিখন-পদ্ধতির প্রচলন হয়নি। জনগণের মুখে মুখেই সে ভাষা প্রচলিত ছিলো বলে তা প্রাকৃতজনের ভাষা হিসেবে ‘প্রাকৃত' ভাষার নাম গ্রহণ করে বৈদিক যুগে ‘রামায়ণ' ‘মহাভারত' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনার সময় এ প্রাকৃতজন তথা সাধারণ মানুষের ভাষা সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে প্রাকৃত ভাষার সংস্কৃত রূপই ‘সংস্কৃত' ভাষারূপে পরিগণিত হয়। সংস্কৃত ভাষায় শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরাই কথা বলতেন।
ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য জাতের হিন্দুরা এমনকি ব্রাহ্মণ নারীদেরও ঐ ভাষায় কথা বলার অধিকার ছিলো না। ধর্মীয় পবিত্রতা আরোপ ও শাস্ত্রীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে সংস্কৃত ভাষা যে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মধ্যে দীর্ঘকাল চালু ছিল এবং এ ভাষায় অসংখ্য গ্রন্থাদি রচিত হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে যে ভাষা জনগণের কথোপকথনের ভাষায় রূপান্তরিত হতে পারেনি এবং যে ভাষা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর চর্চা করার কোন অধিকার ছিলো না, সে ভাষার বিকাশ ও চর্চা কালক্রমে স্বভাবতই সংকীর্ণ গণ্ডিবদ্ধ হয়ে এক সময় মৃত ভাষায় পরিণত হয়। তাছাড়া সংস্কৃত ছিল আর্য় ভাষা আর বাঙালী জনগোষ্ঠী অনার্য গোষ্ঠীভুক্ত। নগেন্দ্রনাথ যাদেরকে ‘অশিক্ষিত ইতর লোক' বলে আখ্যায়িত করেছেন, মূলত তারাই এই অনার্য গোষ্ঠীসম্ভুত সাধারণ বাঙালী, যারা দেশ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃত ভাষায় কথাবার্তা কহিত বলে নগেন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন।
এ থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, প্রাকৃত ভাষার রূপও এক ছিলো না, অঞ্চল ভেদে তা বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। এসব শাখা-প্রশাখা গৌড়ি প্রাকৃত, শৌরসেনী প্রাকৃত, মাগধী প্রাকৃত নামে পরিচিত। কালে কালে এসব ভাষায়ও নানা পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটে। ফলে প্রাকৃত ভাষার পরে প্রবহমান ভাষাকে ‘অপভ্রংশ' ভাষা রূপে চিহ্নিত করা হয়। এ অপভ্রংশ ভাষা থেকেই পবর্তীকালে অহমিয়া, উড়িয়া, হিন্দি, মৈথিলী, বাংলা প্রভৃতি ভাষার উৎপত্তি ঘটেছে বলে পণ্ডিতদের ধারণা।
ডক্টর সুনীত কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ভাষার উৎপত্তি ঘটেছে ৬০০ খৃস্টাব্দে। অধ্যাপক যুল ব্লকের মতে, অপভ্রংশ ভাষার সৃষ্টি হয়েছে ৫০০ খৃস্টাব্দের পূর্বে। বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহও এ মতের সমর্থক। সে হিসাবে আর্য-ব্রাহ্মণবাদী গুপ্ত যুগের শেষ অধ্যায় বা তারপর বৌদ্ধ পাল রাজাদের রাজত্বকালের শুরুতে বাংলাভাষার পূর্ববর্তী স্তর অপভ্রংশ ভাষার উৎপত্তি এবং ক্রমান যে পাল আমলের মধ্যবর্তী দশম শতাব্দীর কোন এক সময়ে বাংলালিপি ভাষার উৎপত্তি বলে ধারণা করা চলে।
পাল বংশের প্রতিষ্ঠা প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে।
পালরা এদেশের অধিবাসী এবং ঐতিহাসিককালে তারাই এ অঞ্চলে একটি সুসংহত স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে সমর্থ হন। এ সময় একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে পাল যুগকে প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে স্বাধীনতার প্রথম পর্ব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ কথা ঐতিহাসিক সত্য যে, বাংলাভাষায় লিখিত রূপের জন্ম হয়েছিল বৌদ্ধ পাল রাজাদের আমলে যাকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বলা হয় দোহা বা চর্চাগীতি। বৌদ্ধ সাধক ও ভিক্ষুরা এগুলোর রচয়িতা।
চর্যাপদের একটি নিদর্শন এ রকম- টালত ঘর মোর নাহি পরবেশী/হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী।
' এর অর্থ হলো টিলার উপর আমার ঘর কিন্তু আমার কোন প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে আমার ভাত থাকে না কিন্তু রোজ রোজই অতিথি আসে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের রচিত এই চর্চা পদগুলো বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ১৯০৭ সালে ভাষাবিদ পণ্ডিত হর প্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ দরবারের গ্রন্থাগার ঘেঁটে এ রকম ৪৬টি চর্যাপদ আবিষ্কার করেন। এগুলো উদ্ধার করা সম্ভব না হলে বাংলাভাষার আদি সাহিত্য হাতছাড়া হয়ে যেত এবং বাংলাভাষার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।
পাল রাজাদের চারশো বছরের রাজত্বকাল শিক্ষা-সংস্কৃতি-স্খাপত্যকলা ইত্যাদির চর্চা ও বিকাশের এক গৌরবোজ্জ্বল যুগ। কিন্তু পরবর্তীতে একাদশ শতাব্দীতে ভারতের দক্ষিণাত্যের কর্ণাটক থেকে আগত আর্য ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী গোঁড়া সেন রাজারা বাংলাদেশ দখল করে এবং বৌদ্ধধর্ম উৎখাতের অভিযান চালায়। বৌদ্ধ পণ্ডিত ও ভিক্ষুগণ প্রাণ ভয়ে স্বদেশ ছেড়ে নেপাল, তিব্বত, থাইল্যান্ড, চীন, শ্রীলঙ্কা, বার্মা প্রভৃতি স্খানে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। সেই সাথে বাঙাল ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলোও তাদের সাথে বাঙালার বাইরে চলে যায়। এভাবে বাংলাভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ রচনা বাধাগ্রস্ত হয়।
বলা চলে শৈশবেই বাংলাভাষার ওপর ভয়াবহ আগ্রাসন নেমে আসে। আর সেন রাজাদের অনুসরণ করে হিন্দু শাস্ত্রবিদ ও পণ্ডিতগণ কথিত বেদভাষা সংস্কৃত ছাড়া লোকভাষায় শাস্ত্রালোচনা নিষিদ্ধ করে দেন। তাদের এই ঘোষণার ফলে বাংলাভাষা রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা তো পেলোই না বরং কঠিন পরিস্খিতির মুখে পড়ে।
১২০৩ সালে তুর্কী ইখতিয়ারু-দ-দীন বখতিয়ার খলজী রাজা লক্ষ্মণ সেনকে লখনৌতি হতে বিতাড়িত করে বাংলায় সংস্কৃত চর্চার মূলে কুঠারাঘাত হেনে বাংলা চর্চার পথ উন্মুক্ত করেন। বাংলায় ছয়শ' বছর মুসলিম শাসন আমলে সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় ও উৎসাহে বাংলাভাষা চর্চা প্রসার লাভ করে।
মুসলিম শাসন আমলে বাংলাভাষা ও সাহিত্য চর্চায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক রাষ্ট্রীয় পোষকতা লাভ করেছিল। তবে সে সময় মুসলিম সমাজের নিত্যব্যবহার্য প্রায় আড়াই হাজার আরবী-ফার্সি, তুর্কী শব্দ বাংলাভাষায় প্রবেশ করেছে।
সুলতানি আমলেই প্রথম কাব্য বড়চণ্ডীদাশের ‘শ্রীকৃষä কীর্তন' রচিত হয়। ঐ সময়ের দ্বিতীয় কাব্য হলো কৃত্তিবাস রচিত ‘রামায়ণ'। সুলতানী আমলের আরেকজন শক্তিশালী কবির কাব্য পাওয়া যায়, তিনি হলেন শাহ মুহাম্মদ সগীর।
তাঁর কাব্যের নাম ‘ইউসুফ-জুলেখা' । এদের সময়েই বাংলাভাষা সাহিত্যের মর্যাদা পায় এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্ব দরবারে স্খান লাভ করে।
১৯৫৭ খৃস্টাব্দে পলাশীর বিপর্যয়ের ইংরেজ শাসকরা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করে ১৮০০ সালে। প্রধানত ব্রাক্ষণদের দ্বারা পরিচিলিত হবার কারনে এবং ইংরেজ শাসন চলার কারনে এসময় বাংলায় অনেক সংস্কৃত ও ইংরেজি শব্দ ঢুকে পড়ে। এসময়ের কালজয়ী ঘটনা রবীন্দ্রনাথের নোবেল সাহিত্যে নোবেল জয়।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করলো বটে কিন্তু রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে আবার শুরু হলো ষড়যন্ত্র। আমাদের জাতিসত্তা বিলুপ্তির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের চাপিয়ে দেয়া ভাষার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ-সংগ্রাম, সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় দেশ মুক্তির আন্দোলন-আমাদের স্বাধীনতা। পৃথিবীর অন্য আর কোন ভাষার উপর সম্ভবত এতো বিপর্যয় নেমে আসেনি যেমনটি এসেছে বাংলাভাষার ক্ষেত্রে। বাংলাভাষা বারবার ধাক্কা খেয়েছে, নিপীড়িত হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। তবু আজ শত বিরূপতার ইতিহাসের ভেতর দিয়ে যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন দেখি, এই বাংলাভাষাতেই শ্রেষ্ঠ ফসলগুলো ফলেছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাই একমাত্র ভাষা যার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম করেছে একটি জাতি। হাসিমুখে জান কোরবান দিয়েছে তার দামাল ছেলেরা। দুনিয়ার বুকে বাংলাভাষাই একমাত্র ভাষা যার সংগ্রাম জন্ম দিয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। বাঙালি জাতির এই গৌরবদীপ্ত ইতিহাসকে সম্মান দিয়ে ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ৩০তম পূর্ণাঙ্গ সাধারণ সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে ঘোষিত হয় একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ব মাতৃভাষা। বাংলাই বিশ্বের একমাত্র ভাষা যা ভাষাভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে।
(মূল: বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, বাংলাপিডিয়া)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।