নিজেকে চেনার আছে অনেক বাকি...
১.
লোপা টেবিল ল্যাম্পটার সুইচ একবার অন করছে,আরেকবার অফ করছে। গত আধাঘন্টা যাবৎ সে ক্রমাগত এই কাজটা করে চলেছে। অথচ তার কোন বিকার নেই। সে যেন এই জগতেই নেই। তুপার চিৎকারে সম্বিত ফিরে পায় লোপা।
‘এই আপু!কী করছিস তুই?ঘুমাতে দিবি না?’
লোপা একটু লজ্জা পায়। তুপার দিকে ফিরে বলে, ‘স্যরি মণি!তুই ঘুমা। সকালে তো পরীক্ষা আছে,না রে?’
‘হুঁ’,সংক্ষেপে জবাব দেয় তুপা।
-সব পড়া হয়েছে তোর?
‘এই তো দেখেছি মোটামুটি। তুই কি আজও রাত জাগবি?’
-মনে হয়।
ফিচারটা কালকের মধ্যে জমা না দিলেই না। পরশু দিনের পেপারে যাবে। আচ্ছা,তুই ঘুমা।
‘আপু,তুই জেগে থাকলে আমাকে ডেকে দিস ফযরের আযানের সময়। আমি ঘুমালাম’।
–বলে পাশ ফিরে শোয় তুপা।
-‘আচ্ছা,ডেকে দিব’। ছোট্ট একটা হাই তোলে লোপা।
এইচ.এস.সি. পরীক্ষা চলছে তুপার। আগামীকাল শেষ পরীক্ষা।
তারপরেই তো মুক্ত পাখি। দু’বোনের কত পরিকল্পনা তৈরি হয়ে আছে.....কোথায় কী কেনাকাটা করবে,কবে কক্সবাজার বেড়াতে যাবে,কবে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন থাকবে-ফটিক ঘরটাতে কাজিনরা মিলে প্ল্যানচ্যাট করে ভূত ডেকে আনবে। তুপার বিশ্বাস,প্ল্যানচ্যাট করে ভূত আনা সম্ভব। আর নিতান্তই যদি ভূত না আসে,জ্বীন তো অবশ্যই আসবে। তুপার আগ্রহে লোপার মধ্যেও আগ্রহ জন্মেছে।
সে প্ল্যানচ্যাট বিষয়ক কিছু বিচিত্র বই জোগাড় করে পড়া শুরু করেছে।
যতই দিন যাচ্ছে,তুপার মত লোপার বিশ্বাসও দৃঢ় হতে শুরু করেছে। ওদের ভার্সিটির বোটানী ডিপার্টমেন্টের কাশেম মামাকে নিয়ে একটা কথা শোনা যায়-মামার সাথে নাকি জ্বীন আছে। মামা কথা বেশি একটা বলেন না। যাও বলেন-বেশিরভাগ সময়ই গাছের সাথে কথা বলেন।
কেউ কেউ নাকি মামাকে জ্বীনের সাথে কথা বলতে দেখেছে। লোপা ঠিক করে, ব্যাপারটা যাচাই করার জন্য সে কাশেম মামার সাথে কথা বলবে।
কাশেম মামার অনেক বয়স হয়েছে। ৭০/৭৫ এরকম হতে পারে। মামা কথা কম বলেন-কথাটা একেবারেই ভুয়া মনে হয়েছে লোপার।
মামা অনেক কথা বলেন। অনেক গল্প করেছেন লোপার সাথে। আগ্রহ নিয়েই করেছেন। কিন্তু গল্পটা যে এরকম হতে পারে,লোপা কল্পনাও করেনি তখন।
২.
‘আমি আর আমার ছোড ভাই তহন এই ভার্সিটিতেই রিসকা চালাইতাম।
ছাত্র-ছাত্রীগোরে রিসকায় চড়াইতে বড় ভালা পাইতাম। এইরম একদিন আমি রিসকায় বইয়া আছিলাম। বিয়ানবেলা হইব তখন। এক ছাত্র আইসা লম্বা সেলাম দিল। ‘আসসালামু আলাইকুম চাচা।
কেমন আছেন?’হেইদিন আমার জীবনে পরথমবারের মত কেউ আমারে সেলাম দিছিল,তাও লেহাপড়া জানা শিক্ষিত মানুষ’।
‘মামা,আমিও কিন্তু আপনারে সালাম দিছি’-দুষ্টুমিভরা হাসি দিয়ে লোপা বলে ওঠে।
‘হ,মা। হের লাইগাই আপনেরে দেইখা আমার বাজানের কথা মনে হইছে’।
মামা আবার ঘটনায় ফিরে যান।
‘আমি পরথমে বুঝবার পারি নাই। মনে করছি অন্য কারু লগে কথা কইতাছে বুঝি। পরে বুঝলাম,না,আমারেই কইছে। কইল, ‘চাচা,নীলক্ষেত যাবেন?’কইতে না কইতেই উইঠা বইসা পড়ল আমার পাশে। শরমে আমি তাড়াতাড়ি নাইমা পড়লাম রিসকা থাইকা।
পরে অনেক কথাই হইছিল। বাজানের নাম আছিল ফরহাদ। এই কেলাসেই লেহাপড়া করতো’।
নামটা শুনে একটু চমকে যায় লোপা। ‘তারপর মামা?’
‘তারপরে নীলক্ষেতে গিয়া রিসকা থাইকা নামল।
আমার হাতে ভাড়া দিয়া কইল, ‘আচ্ছা চাচা,আসি। আবার দেখা হবে ইনশাল্লাহ’। কইয়াই দুই মিনিটের মাথায় বইয়ের দোকানে হারায় গেল। আমি অনেকক্ষণ তাকায় আছিলাম ওইদিকে। বড় চইঞ্চল পোলা আছিল বাজান।
এত্ত সুন্দর কইরা কথা কইতে পারত!কথা কইলে খালি হুনবার মন চাইতো। ভার্সিটির বেবাক মাইনষে চিনতো তারে’।
‘উনি থাকতো কোথায় মামা?’
‘এইহানেই,হলে থাকতো। পরে আরও কয়েকবার দেখা হইছিল। বাজান আমারে চিনবার পারে নাই।
চিনবই বা কেমনে!এত কিছু মনে রাখন কী সোজা কথা!কত্ত বড় বড় বই মনে রাখন লাগতো!
কিন্তু আমার মনে আছিল। একবার আমার ভাইডা একসিডেন কইরা মরতে বসছিল। হেইদিন এই বাজান আর তার বন্ধুরা না থাইকলে আমার ভাই বাঁচতো না। উনারা ওরে হাসপাতালে লইয়া আইছিলো,রক্ত দিছিল’। একটু করে থামেন চাচা।
তারপর বলতে থাকেন, ‘এরপরে কয়েক মাসের মইদ্যে সংগ্রাম শুরু হয়া গেল। আমিও রিসকা থুইয়া বন্দুক হাতে লইলাম’।
‘মামা,আপনি যুদ্ধ করেছেন!!’প্রায় শীষ দিয়ে ওঠে লোপা।
‘হ,মা,করছি। চিন্তা কইরা দেখলাম,শুয়োর পাকিস্তানীগুলানরে দেশছাড়া করতি না পারলি কী হইব রিসকা চালাইয়া!আমি টেরনিং নিলাম।
কত বড় বড় লেহাপড়া জানা মাইনষে আমার লগে টেরনিং নিল। আতকা একদিন দেহি,ফরহাদ বাজান আইছে আমরার লগে টেরনিং নিতে। আমি তো বেবাক খুশি হইছি বাজানরে দেইখা। কিন্তু খুশির কথাটা বাজানরে কইতে পারি নাই। বাজানের কী আর আমার কথা মনে থাকব!আমরা এক লগে খাইছি,ঘুমাইছি,যুদ্ধ করছি।
অনেকগুলান অপারেশন করছি একলগে। কুত্তার বাইচ্চাগুলানরে কুত্তার লাহানই মারছি’।
মামা থেমে যান হঠাৎ করে। কাঁদতে থাকেন। লোপা বিব্রতবোধ করে।
‘কী হইছে মামা?আপনি কানতেছেন কেন?তারপরে কী হইল?’
কাঁদতে কাঁদতেই বলল মামা, ‘তারপর অঘ্রাণ মাসে ফুলতলী ব্রীজ অপারেশনে গেলাম আমরা ৭ জন। অপারেশন ঠিকঠাক মতোই হইছিল। কিন্তু আতকাই কোইথ্যাইকা জানি দুইটা শুয়োর আইসা গুলি কইরা দিল ফরহাদ বাজান আর ইকবাল স্যারের পিঠে। দুইজনেই পইড়া গেল মাটিতে। আমার কোলের উপর,এই কোলের উপর শুইয়া মইরা গেল বাজান।
ইকবাল স্যারও মইরা গেল। কিচ্ছু করবার পারলাম না আমরা’। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন মামা।
যুদ্ধের ৪০ বছর পরও কারো মাঝে যে এতটা আবেগ থাকতে পারে,লোপার জানা ছিল না। সে আস্তে করে হাত রাখে একজন মুক্তিযোদ্ধার মাথায়।
শ্রদ্ধার হাত,ভালবাসার হাত।
মামা বলেন, ‘জানেন মা,ওই শুয়োর দুইটারে জ্যান্ত পুঁতছিলাম মাটির নিছে। ওই মাটি আইজও বিষ ছাড়তাছে। এত বিষ আছিল ঐ হারামীগুলার শইলের মাঝে!’
‘মামা,আপনি কি উনারে বলতে পারছিলেন যে আপনি তারে মনে রাখছেন কেমনে? নীলক্ষেতের ওই ঘটনা,আপনার ভাইয়ের কথা......’
‘নারে মা। এইডা আমার একটা দুখ আছিল।
তয় আমি কইছিলাম বাজানরে। যখন বাজান আমার কাছে আইছিল তার পরিবারের ঠিকানা জানাইতে,তখন কইছি’।
‘বুঝলাম না মামা। উনি আপনার কাছে আসছিল মানে?’
‘মারে,কাউরে কইয়েন না। বাজান আমার কাছে আহে মাঝে মাঝে।
আমি মনে মনে ডাকলেও আহে’।
লোপার চোখে হয়তো অবিশ্বাসীর দৃষ্টি ছিল। মামা বললেন, ‘জানি মা। বিশ্বাস করন বড় শক্ত। আপনেরা লেহাপড়া জানন মানুষ।
কিন্তু ঘটনা সত্য। আমি তার পরিবাররে খবর দিছিলাম। তার মা আর ছোড এক বইন আছে। আপনার লাহানই হইব অখন। অনেক বছর হইছে দেহি নাই’।
৩.
মামার কান্না যেন লোপা শুনতে পাচ্ছে এখনো। লোপার গাল বেয়েও জল ঝরছে। একটা চাপা কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে উঠে আসে গলার কাছে। ডুকরে কেঁদে ওঠে লোপা। সেদিনও কান্না পেয়েছিল লোপার।
কান্না লুকোবার জন্য কাশেম মামার কাছ থেকে তাড়াতাড়ি করে বিদায় নিয়ে চলে এসেছিল।
পরে খোঁজ নিয়ে আরও অনেক তথ্য জেনেছে লোপা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা কোন এক প্রবন্ধে ফরহাদ নামটা পড়েছিল লোপা। তাই নামটা শুনে সেদিন এমন চমকে উঠেছিল।
এই ফরহাদই ছিল ১৯৭১ এ উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ২য় বর্ষের মেধাবী,প্রাণচঞ্চল তরুণ ফরহাদ মোর্শেদ।
ফরহাদের পরিবারের খোঁজ জানার চেষ্টা চালাচ্ছে লোপা। পাশাপাশি ঘটনাটা নিয়ে একটা ধারাবাহিক ফিচার লিখছে পত্রিকায়-অনেকটা গল্পের মত করে। এত অভূতপূর্ব সাড়া পড়বে,লোপা ভাবেনি। পাঠকরা অফিসে ফোন করে অস্থির করে ফেলছে শেষ পর্বের জন্য। সবার মুখে একটাই আলোচনা-অরাত্রিকার ‘একজন ছায়া তরুণের গল্প’।
‘অরাত্রিকা’ ছদ্মনামেই পত্রিকায় লিখে লোপা।
অরাত্রিকা ভাবতে থাকে ফরহাদ মোর্শেদের কথা। ওর গালে জলের রেখা বোঝা যায়। কখন যে ভোর হয়ে গেছে টেরও পায় না সে।
ফযরের আযান দিচ্ছে।
তুপার ঘুম ভেঙ্গে যায়। লোপার দিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বলে,‘আপু তুই কাঁদছিস কেন?’
‘কিছু না মণি,এমনি। তুই উঠে পড়। আযান দিচ্ছে’। দুহাতে শুকনো জলের রেখা মোছার বৃথা চেষ্টা করে লোপা।
৪.
দুদিন পর,পত্রিকায় ‘একজন ছায়া তরুণের গল্প’র শেষ পর্ব ছাপা হয়। ভার্সিটির বাসে,ক্যান্টিনে চায়ের কাপে গল্পটা ঘুরতে থাকে। আনন্দে চোখে পানি আসে লোপার। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল লোপা অন্য একটা কারণে।
যেদিন শেষ পর্বটা ছাপা হলো,সেদিন রাতে ফরহাদ এসেছিল।
লোপার সাথে কথা বলেছে। শেষ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে তুপা দেখে,লোপা একা একা কথা বলছে। তুপা কিছু বলে না,চুপচাপ শোনে। কী বোঝে কে জানে!তবে এর পর ও কখনো আর প্ল্যানচ্যাট করতে চায় নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।