আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাফনের লেখাঃ ভুলে যাওয়া এক বীরের তেজদীপ্ত আখ্যান

নয়া যামানার নয়া পথিক,পথ হারিয়ে ছুটনা দিক্বিদিক আল্লামা ফজলে হক খয়রাবাদী। জন্ম ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে। বাড়ী অযোধ্যার খায়রাবাদে,তাই তাকে খয়রাবাদী বলা হয়। তাঁর প্রথম পরিচয় তিনি ভারতের একজন শ্রেষ্ঠ আলেম, বিখ্যাত সাহিত্যিক,কবি ও ঐতিহাসিক। তাঁর গর্বময় দ্বিতীয় পরিচয় হলো,তিনি ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের একজন প্রত্যক্ষ সংগ্রামী।

ভারতকে স্বাধীন করতে গিয়ে তিনি বন্দী হন। বিচারের নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তে তার সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয় আর তাকে নির্বাসন দেওয়া হয় কুখ্যাত আন্দামানে। সেখানেই তাঁকে বাকিটা জীবন কাটাতে হয়। আন্দামান দ্বীপ ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করায় মাওলানা ফজলে হককে আন্দামানে ইংরেজদের জেলে এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হয়েছিল। তার ছাদ দিয়ে বৃষ্টি পড়তো।

ফলে পায়খানার মতো ছোট কামরায় পানি জমে যেত। হাফ প্যান্ট আর ছোট জামা তাকে পরতে দেয়া হয়েছিল। খাদ্য হিসেবে দেয়া হত নানা জাতের মাছ সিদ্ধ,যা ছিল অত্যন্ত দুর্গন্ধময় ও খাবার অযোগ্য। সময়ে সময়ে বালি মেশানো রুটিও দেওয়া হত। যাহোক তাই দিয়েই ক্ষুধা নিবারণ করতেন।

ঠাণ্ডা পানির পরিবর্তে গরম পানি দেয়া হতো। অবশ্য কিছুক্ষণ রাখলেই তা ঠাণ্ডা হবার কথা, কিন্তু তার উপায় ছিল না-তাড়াতাড়ি পানি না খেলে পানির পাত্র ফিরিয়ে নিয়ে যাবার নির্দেশ ছিল। প্রতিদিন নিয়মিত বেত্রাঘাতের ব্যবস্থা ছিল। স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে থাকতে হতো। রাত্রে অন্ধকারে রাখা হতো।

কাঁকড়া বিছেতে প্রায়ই দংশন করত,তার যন্ত্রণায় সারাক্ষণ ছটফট করতে হতো। কক্ষে দ্বিতীয় কেউ ছিল না যে তার কাছ থেকে একটু সাহায্য ও সান্ত্বনা পাওয়া যেতে পারে। সর্বাঙ্গ দাদ,চুলকানি ও একজিমাতে ভরে গিয়েছিল। তদুপরি চিকিৎসা ও ঔষধ দেওয়া ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ভারতরত্ন যত্নের অভাবে যেন নোংরা আস্তাকুড়ে চাপা ছিলেন।

আরও দুঃখের কথা,হযরত খয়রাবাদী দিনের বেলা সাধারণ মেথরের মত নিজের ও অন্যান্য কয়েদীদের পায়খানা পরিষ্কার করতে হতো। বন্দী বীরকে তাই করতেন। এদিকে ডেপুটি জেলার সাহেব তার কাছে রক্ষিত একটি মূল্যবান ফার্সি পাণ্ডুলিপির যোগ্য অনুবাদকের খুঁজতে গিয়ে মাওলানা ফজলে হকের নাম পেলেন। তাই কারাকর্তা কাগজ-কলম দিয়ে পাণ্ডুলিপিগুলো তাঁর কাছে পাঠালেন। অসুস্থতা ও অস্বাভাবিক মানসিকতা সত্বেও মাওলানা টিকাসহ অনুবাদের কাজ শেষ করলেন।

সেই সংগে তথ্যগুলো কোন লেখকের কোন পুস্তকের কোন খণ্ড থেকে নেয়া হয়েছে তাও লিখে দিলেন। জেলার সাহেব সেটা পড়ে বিস্ময়ে হতবাক হলেন এই জন্য যে, কোন পুস্তকের সাহায্য ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন করা তো আসলেই বিস্ময়কর। তাই তিনি ফজলে হকের সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। ঠিক এই সময়েই মাওলানা সাহেব পায়খানা পরিষ্কার করে বিষ্ঠামাখা টিন ও ঝাঁটা নিয়ে অর্দ্ধোলঙ্গ পোশাক পরে ধীরে ধীরে আসছিলেন। সাহেব তাকে হাত খালি করে দাঁড়াতে বললেন।

তারপর মূল্যবান পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই মাওলানাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। ক্ষমা চাইলেন ভুলবশতঃ তাঁকে ময়লা পরিষ্কারের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। ফজলে হক নিজেও কেঁদে ফেললেন এবং ক্ষমা করে দিলেন। এরপর জেলার সাহেব তাঁকে পুরস্কার দিতে চাইলে তিনি বললেন,"আমি আল্লাহর কাছ থেকেই পুরস্কার নেব। মানুষের কাছ থেকে নয়।

" জেলার তাঁকে বললেন, আপনি আমাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র ধরেছেন এবং আমাদের সাথে যুদ্ধ করাকে ওয়াজিব বলে ফতোয়া দিয়েছেন আপনার অপরাধ অমার্জনীয়। কাজেই আপনাকে মুক্তি দেয়া ভারতের বড়লাটের ক্ষমতার বহির্ভূত। আপনাকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিল। আমি সেখানেই আপনার মুক্তির জন্য সুপারিশ করবো। ফজলে হক বললেন, আপনার এ উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ।

কিন্তু আমাকে মুক্তি দেয়া মানে আমাকে অনুগ্রহ করা। আমি ব্রিটিশের অনুগ্রহ নিব না। লক্ষ্মৌর হাইকোর্ট আমাকে বলেছিল, আমি ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করলেই আমাকে মুক্তি দেয়া হবে। কাজেই যে আনুগত্যের অনুগ্রহ তখন নেই নি, তা এখনও নিব না। আপনি একজন জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি তাই বলছি।

আমাদের কুরআনে আছে,-"তোমরা কিছুই চাইতে পারবে না,কিন্তু আল্লাহ যা চান,তাই হয়। " কাজেই আমি যে এখানে আছি তা আল্লাহর ইচ্ছাতেই আছি। মাওলানা সাহেবের তেজস্বীতা দেখে জেলার সাহেব বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, মুক্তি গ্রহণ করা না করা সেটা আপনার ইচ্ছা,কিন্তু আমার বিবেকতাড়িত কাজ আমি করবই। ১৮৭২ সালে আন্দামানের ছবি মাওলানা সাহেব তাঁর মনের অন্তিম কথাগুলো তিনি কাফনের উপর লিখে যেতেন তাই তিনি ঐ জেলারকে আগেই বলেছিলেন," আমার আনা কাফনখানি আমি আমার ছেলেদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। যদি আমার মৃত্যু এখানেই হয় তাহলে আপনারা সরকার অনুমোদিত কাফন দিয়েই আমার কবর দেবেন।

"ঐ কাপড়ের উপর নির্বাসিত জীবনে বসে কাব্য আকারে যে কাহিনী তিনি আরবী ভাষার যে লিখেছিলেন সেটাই সুবিখ্যাত "আসসাওরাতুল হিন্দিয়া"(ভারতীয় বিদ্রোহ) এর পাণ্ডুলিপি। তাঁকে অনুবাদের জন্য যে কাগজ দেয়া হতো,তা থেকে কাগজ বাঁচানোর কোন উপায় ছিল না,কারণ কাগজ দেয়া হতো পরিমাণমত। তবে তিনি ছিঁড়াফাড়া টুকরাগুলো রেখে দিতেন। এসব টুকরা কাগজ এবং কাফনের কাপড়ে পেন্সিল অথবা লাকড়ির কয়লা দিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন এই অমূল্য গ্রন্থটি। এই বইয়ে তিনি ভারতের স্বাধীনতা বিপ্লবে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আন্দামানে তাঁর উপর নির্যাতনের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।

এই পুস্তকটি অবশেষে তার ছেলে আব্দুল হক খায়রাবাদীর কাছে পৌঁছে। উলামায়ে দেওবন্দ পাণ্ডুলিপিটির উর্দু অনুবাদ করেন। বেনিয়া সরকারের তা সহ্য হয়নি। তারা পুস্তকটি বাজেয়াপ্ত করে এবং অনুবাদক ও প্রকাশকের উপর অশেষ নির্যাতন চালায়। যাই হোক, মাওলানা সাহেবের দুই ছেলে মাওলানা আব্দুল হক ও মাওলানা শামসুল হক দেশের জ্ঞানী-গুণীদের সুপারিশ সংগ্রহ করে পিতার মুক্তির জন্য লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলের কাছে পাঠান।

জেলার সাহেব এবং দেশবাসীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রিভিকাউন্সিল আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীকে মুক্তি দেন। মুক্তিনামার একটি কপি মাওলানা শামসুল হক খায়রাবাদীর কাছে আরেকটি জেলার সাহেবের কাছে পাঠানো হলো। মাওলানা শামসুল হক প্রায় চার বছর পর নিজের বরেণ্য পিতাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য মহানন্দে আন্দামানগামী জাহাজে উঠলেন। মাওলানা শামসুল হক আন্দামানে নেমে দেখলেন হাজার হাজার রোরুদ্যমান কয়েদী একটি জানাজার পিছনে ধাবমান। তিনি একজন কয়েদীকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কোন কয়েদীর জানাজা ভাই! কয়েদী চোখ মুছে বলল,আপনি বুঝি নতুন এসেছেন? -হ্যাঁ! -এটি ভারত রবি আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীর জানাজা।

বাক্যবিমূঢ় পুত্র মুক্তিনামাটি হাতে নিয়া ছুটে গিয়ে পিতার বুকে স্থাপন করে খাটিয়া ধরে চলল। জেলার সাহেবও মুক্তিনামাটি মরহুমের বুকের উপর রেখে খাটিয়া ধরে চলছিলেন। দু জনের চোখেই তখন ভারত মহাসাগরের সমস্ত নোনাজল। জানাযা হচ্ছে আর জেলার সাহেব একটি পাথরের উপর বসে ভাবছিলেন,সেই দিনের আল্লামার কথাগুলো । শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের অনুগ্রহ গ্রহণ করলেন না।

কি তাজা দিলের মানুষ ছিলেন এই খায়রাবাদী। সত্যি! ফজলে হক খায়রাবাদী বেনিয়ার মুক্তিনামা হাতে নিয়ে স্বদেশে ফিরে আসার পরিবর্তে মহাপ্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে স্বস্থানে চলে গেলেন আর শেষ আশ্রয় গ্রহণ করলেন স্বদেশ থেকে বহু দূরে আন্দামানের মাটিতে। আল্লামার কবর তথ্যসূত্রঃ ১)আযাদী আন্দোলনঃ১৮৫৭ (আসসাওরাতুল হিন্দিয়া এর বঙ্গাবুবাদ) ২) চেপে রাখা ইতিহাস ৩) উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাজি ৪)আন্দামানে বন্দী বীর ৫)উইকিপিডিয়া  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.