আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আরেক মিথ্যার ঝুড়ি নিয়ে লুলিও ইকোনমিস্ট

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব। ইকোনমিস্ট গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আবার এক মিথ্যার ঝুড়ি নিয়ে হাজির হয়েছে। বর্তমান নিবন্ধটিও আগেরগুলোর মতোই বাংলাদেশে চলমান যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার চলছে সেটার সমালোচনায় ভরপুর। নিবন্ধটি কিছুটা সত্য, কিছুটা অর্ধসত্য এবং বাকি সবটাই সম্পূূর্ণ মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত। নিবন্ধকার এতটুকু সময়ও ব্যয় করেননি আইকম্যান বিচারের সত্য তথ্য উদঘাটনের ব্যাপারে যেটাকে ইকোনমিস্টের দৃষ্টিতে ‘ইসরাইলের অনুকরণীয় পদ্ধতি’ হিসেবে প্রতিস্থাপন করার প্রয়াস হয়েছে এবং একইভাবে বর্তমানে বাংলাদেশে যে বিচার চলছে তার অন্তর্নিহিত ইতিহাস এবং জনগণের হৃদয় নিঃসৃত আকাক্সক্ষা গত ৪২ বছরে অপূরণের কারণে যে ঘটেছে সে ব্যাপারে নিবন্ধকারের বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই।

এটা এক কথায় গতানুগতিক ভাড়াটে লেখা, যেটা লেখা হয় যেহেতু এটা লেখককে লিখতে হবে শুধু সে কারণে। নিবন্ধকারের অজ্ঞতা এতটাই প্রকট যে, তিনি ধরেই নিয়েছেন যে এ নিবন্ধ যারা পড়বেন, যাদের বেশিরভাগই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বাঙালীরা, তারা এতটাই অজ্ঞ যে, পশ্চিমা রাজধানীর কোন সাপ্তাহিকীতে যে আবর্জনাই প্রকাশিত হোক না কেন তারা সেটাই গলধঃকরণ করবে। আমরা প্রথমেই দৃষ্টি দেই কিভাবে ইসরাইল সরকার পরিচালিত আইকম্যান বিচারকে তিনি গৌরবান্বিত করেছেন, যে বিচারের পদ্ধতি এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। অধিকন্তু পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরে ইসরাইলী বিচার ব্যবস্থাকে কেউই রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করে না, বাংলাদেশের মানুষ তো অনেক দূরের কথা। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী তাদের বাঙালী দোসরদের সহায়তায় বাংলদেশের মানুষের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছিল সেটার প্রেক্ষাপট এবং পটভূমি নাৎসী জার্মানি যে একটি বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর মানুষের ওপর যে হলোকাস্ট সংঘটিত করেছিল সেটা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

প্রথমটা ঘটেছিল যখন বাংলাদেশের মানুষ তাদের দেশকে একটি দখলদার বাহিনীর কবল থেকে দখলমুক্ত করার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল এবং যাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে তারা সবাই বাঙালী, যারা তাদের নিজের দেশের মানুষের ওপর পরিচালিত গণহত্যায় সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সহায়তা করেছে। অন্যদিকে পরেরটার প্রেক্ষাপট ছিল একটা বিশ্বযুদ্ধ, যেটা চলেছে কয়েক বছর ধরে এবং যে বিশেষ ধর্মের মানুষ এ গণহত্যার শিকার হয়েছেন সে ধর্মের কোন মানুষই এ গণহত্যায় জড়িত ছিল না। এবারে দেখা যাক কিভাবে আইকম্যান বিচার পরিচালিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আইকম্যান আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যান, তখনও ইসরাইলের জন্ম হয়নি। ১৯৬১ সালে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ আইকম্যানকে, যিনি কোনদিনও ইসরাইলের নাগরিক ছিলেন না, আজেন্টিনা থেকে অপহরণ করে।

আমরা খুবই আনন্দিত হতাম যদি আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা একইভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী এক অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী আরেক একজনকে ইসরাইলী কায়দায় অপহরণ করে বাংলাদেশে নিয়ে আসতো। সেটা হলে ইকোনমিস্ট কি আমাদের সমর্থন করত? অবশ্য এটা সাধারণভাবেই ধারণা করা যায়, সে অবস্থায় ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের সমালোচনায় বিরাট এক নিবন্ধ লিখে ফেলত, এক গর্হিত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, এ অভিযোগে। আইকম্যান বিচারে যে তিনজন বিচারপতি ছিলেন তারা সবাই জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ১৯৩৩ সালে যখন নাৎসীরা জার্মানিতে ক্ষমতায় আসে তখন তদানীন্তন ‘ব্রিটিশ ম্যান্ডেটধারী প্যালেস্টাইনে’ অভিবাসন গ্রহণ করেন। প্রসিকিউটর ছিলেন ইসরাইলী এ্যাটর্নি জেনারেল যিনি অস্ট্রিয়ায় জন্মগ্রহণকারী (হিটলারও ওই দেশেই জন্মেছিলেন) এবং একই সময়ে অভিবাসিত। বলাবাহুল্য, ওদের সবাই ইহুদী ধর্মাবলম্বী ছিলেন।

যেহেতু আইকম্যান কোন ইহুদী আইনজীবী গ্রহণ করতে চাননি সেহেতু তার ইসরাইলী নিয়োজিত আইনজীবী ছিলেন জার্মানির নাগরিকÑযার সঙ্গে নাৎসীদলের কোনদিনও কোন সম্পর্ক ছিল না। আইকম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তি ছিল ১৯৫০ সালের ‘নাৎসী দালাল আইন’ যখন ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের জন্মই হয়নি। যেহেতু আইকম্যানের অপরাধ ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে সংঘটিত হয়নি এবং এটা ঘটেছে ওই দেশটির জন্মের আগে সেহেতু ইসরাইল সরকারের এ বিচার করার অধিকার রয়েছে কিনা সে ব্যাপারে প্রথম থেকেই এটা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। উপরন্তু আইনবিশারদদের দৃষ্টিতে এ বিচারের এমন কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিল যে কোন নিয়মিত আপিল আদালতে এ বিচারের রায় বহাল থাকার খুব কমই সম্ভাবনা ছিল। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সমস্ত প্রমাণ এবং দালিলিক সাক্ষ্য আইকম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো আসামির আইনজীবীর দেখার বা সেগুলো কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য সেটা বিশ্লেষণের সুযোগও পাননি।

ঐ বিচার আন্তর্জাতিক পরিম-লে বিরাট বিতর্ক ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। আসামিপক্ষের সাক্ষী, যাদের সবাই ছিলেন উচ্চপদস্থ নাৎসী কর্মকর্তা, তাদের সবাইকে তাদের নিজের দেশ অস্ট্রিয়া এবং জার্মানিতে সম্পূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও তাদের কেউই ইসরাইলে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে রাজি হননি। এই হলো কিনা ইকোনমিস্টের দৃষ্টিতে ‘অনুকরণীয় পদ্ধতি’! এবার দেখা যাক আমাদের দেশের মাটিতে কিভাবে বিচার চলছেÑযেটাকে ইকোনমিস্ট লিখেছে, ‘অন্যধরনের অপরাধ’। প্রকৃতপক্ষে ইকোনমিস্ট এ বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মানসে সবধরনের অপ্রমানিত এবং হাস্যকর তথ্য উপস্থাপন করে চলেছে যেটাতে ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞতারই প্রমাণ দিয়ে চলছে। এটা সবই বিকৃত এবং হাস্যকর তথ্যের ভিত্তিতে রচিত, যেগুলো সম্ভবত তার মক্কেলরাই সরবরাহ করে চলেছে।

ইকোনমিস্টের দৃষ্টিতে এ বিচার চরমভাবে ব্যর্থ যেহেতেু অভিযুক্তদের বেশিরভাগই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এর থেকে হাস্যকর এবং অর্বাচীন বক্তব্য আর কি হতে পারে? মূলত জামায়াতে ইসলামী এবং কিয়দংশে মুসলিম লীগ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নেয় এবং গণহত্যায় অংশ নেয়। অতএব ওই দুই দলের সংশ্লিষ্টরাই যে অভিযুক্ত হবেন সেটা বোঝার জন্য হ্যারল্ড লাস্কীর মতন রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। যে ১১ জনকে আজ অবধি কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে তাদের মধ্যে ৯ জন জামায়াত রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর অন্য দু’জন মুসলিম লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জামায়াত রাজনীতির সঙ্গে জড়িত একজন পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েও বিচার এড়াতে পারেননি।

ইকোনমিস্ট খুবই অসন্তুষ্ট এজন্য যে, ‘এ বিচারের কার্যবিধি নিয়ে কোন জনসমালোচনার সুযোগ দেয়া হয়নি। একটা মামলায় একজন বিচারপতি পদত্যাগ করা সত্ত্বেও অন্য তিনজন সব সাক্ষীদের সাক্ষ্য না শুনেই মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়েছে। ’ এখানেও ইকোনমিস্ট চরম মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। ট্রাইব্যুনালের কার্যবিধি জনসাধারণের এবং সংবাদ মাধ্যমসমূহের জন্য উন্মুক্ত। এমনকি যে সব গণমাধ্যম অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার জন্য মরিয়া হয়ে সব ধরনের অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে সেই সব চিহ্নিত সংবাদসেবীদের জন্যও ট্রাইব্যুনালের দ্বার উন্মুক্ত।

বিরোধী রাজনীতিকরা শুধু এ বিচারের সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হননি, এ ট্রাইব্যুনালকে ভেঙ্গে দেয়ার দাবিও তারা জানিয়েছে। এ ধরনের দাবি ইকোনমিস্টের ‘অনুকরণীয় পদ্ধতি’র দেশে আইকম্যান বিচারে কি কল্পনা করা যেত? প্রকৃত সত্য হলো, তিনজন বিচারকের দু’জন সমস্ত সাক্ষীদের সাক্ষ্য শুনেছেন এবং তৃতীয় বিচারপতি, অন্য দু’জনসহ, বাদী এবং বিবাদীপক্ষের যুক্তিতর্ক পুনর্বার উত্থাপন করার সুযোগ দিয়েছেন। ইকোনমিস্ট অভিযোগ করেছে আসামির সাক্ষীকে নাকি বাদীপক্ষ অপহরণ করেছে। এ ব্যাপারে মতদ্বৈধতা রয়েছে। আসামিপক্ষের সাক্ষী একজন ধর্মীয় সংখালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ।

বাংলাদেশের কেউ কি এটা বিশ্বাস করবে কোন ধর্মীয় সংখালঘু সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর সমর্থনে কোন সাফাই সাক্ষী দেবেন? এর বিপরীতে একজন বাদী পক্ষের সাক্ষীকে এবং একজন সাক্ষীর ভাইকে অভিযুক্তদের সমর্থকরা হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। যে সব আইনজীবী আসামিদের পক্ষে লড়ছেন, তারা সবাই দেশের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, যাদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি। সব আইনজীবীই জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতা এবং সমর্থক, যারা বিচারের সরাসরি বিরুদ্ধে এবং যার মধ্যে দু’একজনের নিজেদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের লক্ষ-কোটি মানুষকে এ বিচারের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে ইকোনমিস্ট লিখেছে, ‘দুঃখজনকভাবে, বেশিরভাগ বাংলাদেশিই এ ট্রাইব্যুনালের ত্রুটিপূর্ণ বিচারকে স্বাগত জানাচ্ছেন। আদালত যখন একজন অভিযুক্তকে মৃত্যুদ-ের বদলে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করল তার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা শহরে যে গণজমায়েত ঘটল সে ধরনের বিরাট গণসমাবেশ বিগত ২০ বছর ঘটেনি।

’ ইকোনমিস্টের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি এ ধরনের জাগরণ ও প্রতিবাদ ’৭১-এ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী বাঙালীর চিত্ত এবং হৃদয়কে যেভাবে আন্দোলিত এবং উদ্বেলিত করেছে সেটা আর কোনদিন ঘটেনি। পরিশেষে, ইকোনমিস্ট যথার্থই লিখেছে, ‘প্রত্যেকেই বিশ্বাস করে অভিযুক্তরা তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত প্রতিদানই পাচ্ছে। ’ প্রকৃতপক্ষে আপামর জনতার এ বহুল উদ্বেলিত অনূভূতিতে বিচার সম্পর্কে সেই বহুল উল্লিখিত উক্তিরই প্রমাণ মিলছেÑ আর সেটা হলো, ‘শুধু বিচার সম্পন্ন করলেই চলবে না, জনগণের কাছে এটাও প্রতীয়মান হতে হবে যে, বিচার সত্যিকারভাবেই সম্পন্ন করা হয়েছে। ’ মোজাম্মেল খান ইকোনমিস্ট গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আবার এক মিথ্যার ঝুড়ি নিয়ে হাজির হয়েছে। বর্তমান নিবন্ধটিও আগেরগুলোর মতোই বাংলাদেশে চলমান যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার চলছে সেটার সমালোচনায় ভরপুর।

নিবন্ধটি কিছুটা সত্য, কিছুটা অর্ধসত্য এবং বাকি সবটাই সম্পূূর্ণ মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত। নিবন্ধকার এতটুকু সময়ও ব্যয় করেননি আইকম্যান বিচারের সত্য তথ্য উদঘাটনের ব্যাপারে যেটাকে ইকোনমিস্টের দৃষ্টিতে ‘ইসরাইলের অনুকরণীয় পদ্ধতি’ হিসেবে প্রতিস্থাপন করার প্রয়াস হয়েছে এবং একইভাবে বর্তমানে বাংলাদেশে যে বিচার চলছে তার অন্তর্নিহিত ইতিহাস এবং জনগণের হৃদয় নিঃসৃত আকাক্সক্ষা গত ৪২ বছরে অপূরণের কারণে যে ঘটেছে সে ব্যাপারে নিবন্ধকারের বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই। এটা এক কথায় গতানুগতিক ভাড়াটে লেখা, যেটা লেখা হয় যেহেতু এটা লেখককে লিখতে হবে শুধু সে কারণে। নিবন্ধকারের অজ্ঞতা এতটাই প্রকট যে, তিনি ধরেই নিয়েছেন যে এ নিবন্ধ যারা পড়বেন, যাদের বেশিরভাগই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বাঙালীরা, তারা এতটাই অজ্ঞ যে, পশ্চিমা রাজধানীর কোন সাপ্তাহিকীতে যে আবর্জনাই প্রকাশিত হোক না কেন তারা সেটাই গলধঃকরণ করবে। আমরা প্রথমেই দৃষ্টি দেই কিভাবে ইসরাইল সরকার পরিচালিত আইকম্যান বিচারকে তিনি গৌরবান্বিত করেছেন, যে বিচারের পদ্ধতি এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।

অধিকন্তু পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরে ইসরাইলী বিচার ব্যবস্থাকে কেউই রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করে না, বাংলাদেশের মানুষ তো অনেক দূরের কথা। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী তাদের বাঙালী দোসরদের সহায়তায় বাংলদেশের মানুষের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছিল সেটার প্রেক্ষাপট এবং পটভূমি নাৎসী জার্মানি যে একটি বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর মানুষের ওপর যে হলোকাস্ট সংঘটিত করেছিল সেটা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমটা ঘটেছিল যখন বাংলাদেশের মানুষ তাদের দেশকে একটি দখলদার বাহিনীর কবল থেকে দখলমুক্ত করার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল এবং যাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে তারা সবাই বাঙালী, যারা তাদের নিজের দেশের মানুষের ওপর পরিচালিত গণহত্যায় সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সহায়তা করেছে। অন্যদিকে পরেরটার প্রেক্ষাপট ছিল একটা বিশ্বযুদ্ধ, যেটা চলেছে কয়েক বছর ধরে এবং যে বিশেষ ধর্মের মানুষ এ গণহত্যার শিকার হয়েছেন সে ধর্মের কোন মানুষই এ গণহত্যায় জড়িত ছিল না। এবারে দেখা যাক কিভাবে আইকম্যান বিচার পরিচালিত হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আইকম্যান আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যান, তখনও ইসরাইলের জন্ম হয়নি। ১৯৬১ সালে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ আইকম্যানকে, যিনি কোনদিনও ইসরাইলের নাগরিক ছিলেন না, আজেন্টিনা থেকে অপহরণ করে। আমরা খুবই আনন্দিত হতাম যদি আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা একইভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী এক অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী আরেক একজনকে ইসরাইলী কায়দায় অপহরণ করে বাংলাদেশে নিয়ে আসতো। সেটা হলে ইকোনমিস্ট কি আমাদের সমর্থন করত? অবশ্য এটা সাধারণভাবেই ধারণা করা যায়, সে অবস্থায় ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের সমালোচনায় বিরাট এক নিবন্ধ লিখে ফেলত, এক গর্হিত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, এ অভিযোগে। আইকম্যান বিচারে যে তিনজন বিচারপতি ছিলেন তারা সবাই জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ১৯৩৩ সালে যখন নাৎসীরা জার্মানিতে ক্ষমতায় আসে তখন তদানীন্তন ‘ব্রিটিশ ম্যান্ডেটধারী প্যালেস্টাইনে’ অভিবাসন গ্রহণ করেন।

প্রসিকিউটর ছিলেন ইসরাইলী এ্যাটর্নি জেনারেল যিনি অস্ট্রিয়ায় জন্মগ্রহণকারী (হিটলারও ওই দেশেই জন্মেছিলেন) এবং একই সময়ে অভিবাসিত। বলাবাহুল্য, ওদের সবাই ইহুদী ধর্মাবলম্বী ছিলেন। যেহেতু আইকম্যান কোন ইহুদী আইনজীবী গ্রহণ করতে চাননি সেহেতু তার ইসরাইলী নিয়োজিত আইনজীবী ছিলেন জার্মানির নাগরিকÑযার সঙ্গে নাৎসীদলের কোনদিনও কোন সম্পর্ক ছিল না। আইকম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তি ছিল ১৯৫০ সালের ‘নাৎসী দালাল আইন’ যখন ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের জন্মই হয়নি। যেহেতু আইকম্যানের অপরাধ ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে সংঘটিত হয়নি এবং এটা ঘটেছে ওই দেশটির জন্মের আগে সেহেতু ইসরাইল সরকারের এ বিচার করার অধিকার রয়েছে কিনা সে ব্যাপারে প্রথম থেকেই এটা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

উপরন্তু আইনবিশারদদের দৃষ্টিতে এ বিচারের এমন কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিল যে কোন নিয়মিত আপিল আদালতে এ বিচারের রায় বহাল থাকার খুব কমই সম্ভাবনা ছিল। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সমস্ত প্রমাণ এবং দালিলিক সাক্ষ্য আইকম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো আসামির আইনজীবীর দেখার বা সেগুলো কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য সেটা বিশ্লেষণের সুযোগও পাননি। ঐ বিচার আন্তর্জাতিক পরিম-লে বিরাট বিতর্ক ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। আসামিপক্ষের সাক্ষী, যাদের সবাই ছিলেন উচ্চপদস্থ নাৎসী কর্মকর্তা, তাদের সবাইকে তাদের নিজের দেশ অস্ট্রিয়া এবং জার্মানিতে সম্পূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও তাদের কেউই ইসরাইলে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে রাজি হননি। এই হলো কিনা ইকোনমিস্টের দৃষ্টিতে ‘অনুকরণীয় পদ্ধতি’! এবার দেখা যাক আমাদের দেশের মাটিতে কিভাবে বিচার চলছেÑযেটাকে ইকোনমিস্ট লিখেছে, ‘অন্যধরনের অপরাধ’।

প্রকৃতপক্ষে ইকোনমিস্ট এ বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মানসে সবধরনের অপ্রমানিত এবং হাস্যকর তথ্য উপস্থাপন করে চলেছে যেটাতে ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞতারই প্রমাণ দিয়ে চলছে। এটা সবই বিকৃত এবং হাস্যকর তথ্যের ভিত্তিতে রচিত, যেগুলো সম্ভবত তার মক্কেলরাই সরবরাহ করে চলেছে। ইকোনমিস্টের দৃষ্টিতে এ বিচার চরমভাবে ব্যর্থ যেহেতেু অভিযুক্তদের বেশিরভাগই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এর থেকে হাস্যকর এবং অর্বাচীন বক্তব্য আর কি হতে পারে? মূলত জামায়াতে ইসলামী এবং কিয়দংশে মুসলিম লীগ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নেয় এবং গণহত্যায় অংশ নেয়। অতএব ওই দুই দলের সংশ্লিষ্টরাই যে অভিযুক্ত হবেন সেটা বোঝার জন্য হ্যারল্ড লাস্কীর মতন রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।

যে ১১ জনকে আজ অবধি কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে তাদের মধ্যে ৯ জন জামায়াত রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর অন্য দু’জন মুসলিম লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জামায়াত রাজনীতির সঙ্গে জড়িত একজন পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েও বিচার এড়াতে পারেননি। ইকোনমিস্ট খুবই অসন্তুষ্ট এজন্য যে, ‘এ বিচারের কার্যবিধি নিয়ে কোন জনসমালোচনার সুযোগ দেয়া হয়নি। একটা মামলায় একজন বিচারপতি পদত্যাগ করা সত্ত্বেও অন্য তিনজন সব সাক্ষীদের সাক্ষ্য না শুনেই মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়েছে। ’ এখানেও ইকোনমিস্ট চরম মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের কার্যবিধি জনসাধারণের এবং সংবাদ মাধ্যমসমূহের জন্য উন্মুক্ত। এমনকি যে সব গণমাধ্যম অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার জন্য মরিয়া হয়ে সব ধরনের অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে সেই সব চিহ্নিত সংবাদসেবীদের জন্যও ট্রাইব্যুনালের দ্বার উন্মুক্ত। বিরোধী রাজনীতিকরা শুধু এ বিচারের সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হননি, এ ট্রাইব্যুনালকে ভেঙ্গে দেয়ার দাবিও তারা জানিয়েছে। এ ধরনের দাবি ইকোনমিস্টের ‘অনুকরণীয় পদ্ধতি’র দেশে আইকম্যান বিচারে কি কল্পনা করা যেত? প্রকৃত সত্য হলো, তিনজন বিচারকের দু’জন সমস্ত সাক্ষীদের সাক্ষ্য শুনেছেন এবং তৃতীয় বিচারপতি, অন্য দু’জনসহ, বাদী এবং বিবাদীপক্ষের যুক্তিতর্ক পুনর্বার উত্থাপন করার সুযোগ দিয়েছেন। ইকোনমিস্ট অভিযোগ করেছে আসামির সাক্ষীকে নাকি বাদীপক্ষ অপহরণ করেছে।

এ ব্যাপারে মতদ্বৈধতা রয়েছে। আসামিপক্ষের সাক্ষী একজন ধর্মীয় সংখালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। বাংলাদেশের কেউ কি এটা বিশ্বাস করবে কোন ধর্মীয় সংখালঘু সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর সমর্থনে কোন সাফাই সাক্ষী দেবেন? এর বিপরীতে একজন বাদী পক্ষের সাক্ষীকে এবং একজন সাক্ষীর ভাইকে অভিযুক্তদের সমর্থকরা হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। যে সব আইনজীবী আসামিদের পক্ষে লড়ছেন, তারা সবাই দেশের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, যাদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি। সব আইনজীবীই জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতা এবং সমর্থক, যারা বিচারের সরাসরি বিরুদ্ধে এবং যার মধ্যে দু’একজনের নিজেদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের লক্ষ-কোটি মানুষকে এ বিচারের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে ইকোনমিস্ট লিখেছে, ‘দুঃখজনকভাবে, বেশিরভাগ বাংলাদেশিই এ ট্রাইব্যুনালের ত্রুটিপূর্ণ বিচারকে স্বাগত জানাচ্ছেন। আদালত যখন একজন অভিযুক্তকে মৃত্যুদ-ের বদলে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করল তার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা শহরে যে গণজমায়েত ঘটল সে ধরনের বিরাট গণসমাবেশ বিগত ২০ বছর ঘটেনি। ’ ইকোনমিস্টের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি এ ধরনের জাগরণ ও প্রতিবাদ ’৭১-এ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী বাঙালীর চিত্ত এবং হৃদয়কে যেভাবে আন্দোলিত এবং উদ্বেলিত করেছে সেটা আর কোনদিন ঘটেনি। পরিশেষে, ইকোনমিস্ট যথার্থই লিখেছে, ‘প্রত্যেকেই বিশ্বাস করে অভিযুক্তরা তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত প্রতিদানই পাচ্ছে। ’ প্রকৃতপক্ষে আপামর জনতার এ বহুল উদ্বেলিত অনূভূতিতে বিচার সম্পর্কে সেই বহুল উল্লিখিত উক্তিরই প্রমাণ মিলছেÑ আর সেটা হলো, ‘শুধু বিচার সম্পন্ন করলেই চলবে না, জনগণের কাছে এটাও প্রতীয়মান হতে হবে যে, বিচার সত্যিকারভাবেই সম্পন্ন করা হয়েছে।

’ মোজাম্মেল খান  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।