আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইভিএম ব্যবহারে ভোটের জালিয়াতি

[সূত্রঃ আমার দেশ, ২৬/১১/১১] বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করে বিভিন্ন স্থানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। মেয়াদ পূর্তির শেষ সময়ে এসে বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন প্রতিবাদের মুখেও কেন ইভিএম ব্যবহারে এত আগ্রহ প্রকাশ করছে তা বোঝা মুশকিল। সম্ভবত তারা অবুঝ দেশবাসীকে বোঝাতে চাচ্ছেন যে, তারা একটি বৈপ্লবিক কর্মসূচি বাস্তবায়িত করে গেছেন। আবার এমনও হতে পারে, বিগত দিনে তারা যে দুষ্কর্ম করেছেন বিদায়লগ্নে সেই দুষ্কর্ম থেকে জনদৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য এই চতুর উদ্যোগ। আবার এমনও হতে পারে, বহু অর্থ ব্যয় করে প্রায় অখ্যাত প্রতিষ্ঠান পাই ল্যাবরেটরির কাছ থেকে যে যন্ত্র তারা কিনেছেন যে জন্য ব্যয়িত অর্থ জায়েজ করার জন্যই এই উদ্যোগ।

পাই ল্যাবরেটরির স্বত্বাধিকারীদের কারিগরি দক্ষতা সম্পর্কে এখনও মন্তব্য করার মতো কোনো তথ্য নেই। এই যন্ত্রের খুঁটিনাটি দিক সম্পর্কে অন্য কারও কথায় কান না দিয়ে নির্বাচন কমিশন মনে করছে তারা সব জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী। বাস্তবে কি তাই? পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে পার্লামেন্টের জন্য জনপ্রতিনিধিকে নির্বাচিত করা। একটি নির্বাচনী এলাকার জনগণ পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একজন প্রতিনিধিকেই নির্বাচিত করেন। জনগণ কাকে ভোট দেবেন সে বিষয়টি থাকে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।

শুধু ফলাফলের মধ্যেই বহিঃপ্রকাশ ঘটে সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দের। কোনো প্রকার ছলচাতুরির আশ্রয় না নিয়ে নির্বাচনী অফিসাররা ভোট গণনা করেন। এ কারণেই ভোটের প্রক্রিয়াটিকে হতে হয় স্বচ্ছ এবং সহজ। যাতে নির্বাচনের দিন একজন ভোটার খুব সহজেই বুঝতে পারেন তিনি কাকে ভোট দিচ্ছেন। জোসেফ স্তালিন তাই যাথার্থই বলেছেন, ‘যারা ভোট দেন তাদের ওপর ভোটের ফলাফল নির্ভর করে না, যারা ভোট গণনা করেন তাদের ওপরই সবকিছু নির্ভর করে।

’ এ কারণেই নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ভোটিং ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ই-ভোটিং হচ্ছে এক ধরনের ব্ল্যাক বক্স পদ্ধতি। যেখানে ভোটদান ও ভোট গণনার বিষয়টি ভোটারের কাছে লুকানো থাকে। এই একটি কারণে ভোটারের রায় যাচাই-বাছাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় এবং ভোটের ফলাফলে জাল জালিয়াতির অবকাশ থাকে। তাই যিনি ইভিএম নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি নির্বাচনী ফলাফলকে যাচ্ছেতাইভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।

বাংলাদেশে যে ইভিএম ব্যবহৃত হচ্ছে তাতে চারটি অংশ আছে। এগুলো হচ্ছে—কন্ট্রোল ইউনিট, ব্যাটারি ইউনিট, ডিসপ্লে ইউনিট ও ব্যালট ইউনিট। ব্যালট ইউনিটের মাধ্যমে ভোটাররা ভোট দেন এবং একটি তারের মাধ্যমে কন্ট্রোল ইউনিট ও ব্যালট ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষিত হয়। প্রত্যেকটি ইভিএম-এ আশিজন প্রার্থীর নাম ও চিহ্ন এবং পঁয়ষট্টি হাজার ভোটারের ভোটদানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। যেহেতু এসব ইভিএম-এ কোনো নেটওয়ার্কের ব্যবস্থা নেই তাই প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে একটি করে এই মেশিন বসাতে হবে এবং এর ফলে এই মেশিনের সংখ্যা কত হবে তা সহজেই অনুমেয়।

নেটওয়ার্কের ব্যবস্থা না থাকার ফলে হ্যাকিং সম্ভব হবে না, হবে যন্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার। বাংলাদেশে যে ইভিএমটি ব্যবহারের কথা উঠেছে তা ভারতে ব্যবহৃত ইভিএম-এর অনুরূপ। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে দু’টি কোম্পানি এই ইভিএম মেশিন তৈরি করে। একেকটি ইভিএম মেশিনে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের সম্মিলন ঘটে। এ কারণেই মেশিন তৈরির সময় এমনভাবে প্রোগ্রাম করে দেয়া সম্ভব যাতে ভোটের ফলাফল নিয়ে নয়-ছয় করা যায়।

ইলেক্ট্রনিক ভোটিং পদ্ধতির সমস্যা মূলত তিনটি। যদিও ভোটারের পছন্দের বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয় বিষয়, তবু একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোন ভোটার কাকে ভোট দিয়েছেন ইভিএম থেকে তা বের করা যায়। কোন মার্কায় কোন ভোট পড়েছে তা নির্দিষ্ট হওয়ার আগেই ইভিএম-এ প্রদত্ত ভোট পরিবর্তন করা যায়। এছাড়া পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রামের মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফলও বদলে দেয়া যায়, যা ব্যালট পেপারের মাধ্যমে প্রদত্ত ভোটের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের নির্বাচনী কমিশন দাবি করছে ই-ভোটিং এবং ইভিএম এক বিষয় নয়।

এটি সম্পূর্ণরূপে মিথ্যার বেসাতি। ইলেক্ট্রনিক ভোটিং ই-ভোটিং হিসেবেও পরিচিত। ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে ভোট দান ও ভোট গণনাই হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং। সাধারণভাবে বলতে গেলে দুই ধরনের ই-ভোটিং পদ্ধতি চিহ্নিত করা যায়। এর একটি হচ্ছে এমন ভোটিং ব্যবস্থা যেখানে সরকার বা অন্য মনোনীত ব্যক্তিরা ভোটদানকে পরিদর্শন করতে পারেন।

বাংলাদেশে ব্যবহৃত ইভিএম’টি এ ধরনেরই ই-ভোটিং পদ্ধতি। অপরটি হচ্ছে ভোটারের সম্পূর্ণ নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে ভোটদান। যা তিনি করতে পারেন তার ব্যক্তিগত কম্পিউটার, মোবাইল ফোন অথবা ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এসব ক্ষেত্রে অন্যের খবরদারি চলে না বা জালিয়াতি করাও সম্ভব হয় না। এমন কোনো ব্যবস্থা নেই যে ক্ষেত্রে ইভিএম-এ ব্যবহৃত প্রতিটি ভোট গণনা নিশ্চিত করা যাবে।

কারণ একটি ইলেক্ট্রনিক মেশিনে যে কোনো সময় যে কোনো সমস্যা দেখা দিতে পারে। সারা পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যিনি একশ’ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারবেন যে, ইভিএম মেশিনটি সব সময় সঠিকভাবে কাজ করবে। এমনকি নাসার বিজ্ঞানীরাও। বাংলাদেশের মতো দেশে ইভিএম ব্যবহারে আরও অনেক জালিয়াতি ঘটতে পারে। যা শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে ভোটদানের সময় ঘটতে পারে।

এছাড়া যে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জীবনে কখনও কম্পিউটার বা এ জাতীয় যন্ত্র ব্যবহার করেনি তারাও প্রতারিত হতে পারবেন। এ ব্যবস্থায় লেখাপড়া না জানা ভোটারদের প্রভাবান্বিত করে একটি বিশেষ বোতামে চাপ দিতে উত্সাহিত করা সম্ভব। ইভিএম-এ যেহেতু কোনো ব্যালট পেপার নেই তাই ইভিএম মেশিনের বোতামের পাশে প্রায় কাছাকাছি ধরনের প্রতীকে চাপ দেয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। ইভিএম-এ ব্যবহৃত সফটওয়্যারকে এমনভাবে তৈরি করা যায় যার সাহায্যে একজন প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যাকে মেশিনের ভেতরেই বদলে দেয়া সম্ভব। সম্ভবত এ কারণেই নির্বাচন কমিশন এসব মেশিনে ব্যবহৃত সফটওয়্যারের প্রকাশ্য পর্যালোচনায় রাজি হচ্ছে না।

এসব মেশিনের অনেক ক্ষেত্রেই স্মার্ট কার্ড ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। এই স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করে একজন প্রার্থীর পক্ষে অনেকবার ভোট দেয়া সম্ভব। এছাড়া যেহেতু এই মেশিনের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব থাকবে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের হাতে তাই ভোট জালিয়াতির বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। ইভিএম সংবিধানসম্মত কিনা ও গণতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা সে প্রশ্ন বহু দেশে উত্থাপিত হয়েছে। দীর্ঘ বিতর্কের পর জার্মানির সুপ্রিমকোর্ট এই মর্মে রায় দিয়েছে যে, ই-ভোটিং অসাংবিধানিক।

কেননা, এই পদ্ধতিতে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি পদক্ষেপ সাধারণ নাগরিকরা বুঝবেন এমনটা মনে করার কারণ নেই। ইলেক্ট্রনিক ভোটের ফলাফল গ্রহণ করতে হলে ভোটদাতাদের অবশ্যই ভোট পদ্ধতি সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে আস্থাশীল হতে হবে। যেহেতু এটা সম্ভব না তাই এটা অগণতান্ত্রিক। এ কারণেই কিছু দিন আগে প্রচুর অর্থ ব্যয় হওয়ার পরেও আয়ারল্যান্ডের মতো দেশ ইলেক্ট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি বাতিল করে দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রায়ই প্রতিবেশী ভারতের উদাহরণ দিয়ে থাকে।

কিছুদিন আগে ভারতীয় প্রশাসনিক সার্ভিসের সাবেক সদস্য উমেশ সায়গল ২০০৯ সালে ইভিএম ব্যবহার করে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। সায়গল, যিনি নিজে একজন প্রযুক্তিবিদ, তিনি বলেছেন, ২০০৪ সালে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকেই জালিয়াতি চলে আসছে। তিনি একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে দেখিয়েছেন কীভাবে একটি ভোট কেন্দ্রে ব্যবহৃত একটি ইভিএম-এ প্রতি পঞ্চম ভোটটি একজন প্রার্থীর স্বপক্ষে দেয়া সম্ভব। সায়গল দাবি করেছেন, নির্বাচনের আগে ও পরে প্রতিটি মেশিনের সফটওয়্যার যাচাই করতে হবে। সায়গলের দাবির অর্থ এই নয় যে, প্রত্যেকটি ভোটকেন্দ্রে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি ইভিএম যাচাই করতে হবে।

তিনি বলেন, যেসব কেন্দ্রে কোনো প্রার্থী শতকরা ৭৫ ভাগ ভোট পাবেন অথবা যিনি ১৫ হাজারের কম ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করবেন সে মেশিনগুলো যাচাই করলে জালিয়াতি ধরা যাবে। অন্যথায়, ‘ভারতের উচিত হবে কাগজে ব্যবহৃত ব্যালট পেপারে ফিরে যাওয়া। ’ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.