আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিমগ্ন ফাল্গুনে

আমার কোনো গন্তব্য নেই । পরিব্রাজকদের কখনো গন্তব্য থাকার কথা না... ১. ক্লাসে বসে খবর পেলাম । মাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে । কোনোরকমে ক্লাস থেকে বের হয়ে আমি ছুটলাম হাসপাতালের দিকে । বাবা চিন্তিত মুখে বসে আছে ‘আই সি ইউ’ সামনের বারান্দায় ।

তার মুখ বিষণ্ণ । তার একপাশে যূথী দাঁড়িয়ে আছে । আমি বাবার পাশে গিয়ে দাড়ালাম । যূথী আমার পাশে এসে দাড়ালো । ওর মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে ।

আমার মায়ের শরীর অনেক আগে থেকেই অসুস্থ । খুব সহজ ভাষায় একটা জটিল অসুখ ওনার । লিউকোমিয়া । এক ধরণের রক্তের ক্যান্সার । লাস্ট স্টেজ ।

এই নিয়ে তিনবার ইমারজেন্সি নিয়ে আসতে হলো । আমি এসেছি বাবা হয়ত লক্ষ্য করেননি । বাবা অতি আস্তে বললেন, “বাবু কখন এলি?” - এইতো এলাম মাত্র । ডাক্তার কি বললেন । = এখনো কিছুনা বাবা চুপ করে গেলেন ।

আমি যূথীর দিকে তাকিয়ে বললাম, “তুলি আর মিথি কোথায়রে? - ওরা বাসায় আছে । আমি আর কিছু বললামনা । যূথী প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “মায়ের কিছু হবেনাতো ভাইয়া?” আমি কি বলবো বুঝতে পারলামনা । বললাম “কিছু হবেনারে । তুই চিন্তা করিসনা তো” ।

ইতিমধ্যে আমাদের আত্নীয় স্বজনদের কাছাকাছি যারা আছে তারা অনেকেই চলে এসেছে । হাসপাতালের এই লম্বা বাড়ান্দাটা মানুষে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে অতি দ্রুত । ২. আমাদের মা মারা গেছেন ১ বছর হয়ে গেছে । এই এক বছরে আমাদের তেমন কিছুর পরিবর্তন হয়নি । শুধু কিছু পরিবর্তন হয়েছে আমাদের অবস্থানের ।

আমার ভার্সিটি শেষ হয়েছে । আমি এখন একটা ব্যাংকে চাকরি করছি । বাবা রিটায়ার্ড করেছে দুই মাস হয়নি এখনো । তুলি এবার ক্লাস এইটে উঠেছে । মিথি ক্লাস থ্রি তে ।

এই তুলি আর মিথিই আমাদের বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখে দিনভর । যূথী এবার অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে । বাবা ওর বর দেখছেন । এর মধ্যে সমন্ধ এসেছে বেশ কয়েক জায়গা থেকে । বাবা পছন্দ করেননি বলে ক্যান্সেল হয়েছে ।

মা মারা যাবার পর থেকে আমাদের এই ৫ জনের সংসারটাকে আগলে রাখার অলিখিত দায়িত্ব পড়েছে যূথীর ওপর । আমি প্রায়ই রাতে জাগি । সেদিন যূথীও জাগে আমার সাথে সাথে । দুইজনে চা খেতে খেতে আড্ডা দিই প্রায় ভোর হবার আগ পর্যন্ত । তারপর জোড় করে ঘুমুতে পাঠায় আমাকে ।

যূথীটার বিয়ে হয়ে গেলে হয়তো আর রাত জাগা হবেনা এভাবে । সন্ধ্যা হলে বাবা তুলি আর মিথিকে পড়াতে বসান কোনো কোনোদিন । সেদিনটা তুলি আর মিথির জন্য খুব আনন্দের হয় বলে আমার ধারনা । কারণ বাবা পড়ান কম, তিনি শুরু করেন তার নিজের গল্প । মিথি প্রায়ই গল্পের মাঝ পথেই ঘুমিয়ে পড়ে ।

তুলি খুব মনোযোগ দিয়ে বাবার গল্প শোনে । কতটুকু বোঝে কে জানে । রাত একটু বাড়লে যূথী খেতে ডাকে আমাদের । মিথিকে ডেকে তোলা হয় অনেক কষ্ট করে । খেতে খেতে বাবার সাথে কিছু আলোচনা হয় আমার ।

বেশির ভাগই আমার চাকরী সংক্রান্ত আর দেশের পরিস্থিতি নিয়ে । এর মধ্যে বাবার এক বন্ধুর মাধ্যমে যূথীর বিয়ে মোটামুটি ঠিক করে ফেললেন বাবা । আমাকে ছেলের সব বায়োডাটা দিলেন । ছেলেকে আমারও পছন্দ হলো । নাম অংশু ।

ঢাকা ভার্সিটি থেকে অনার্স মাস্টার্স করেছে । এখন একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার । সবচেয়ে বড় কথা যূথীকে তার খুব পছন্দ অনেকদিন থেকেই । বাবা আমাকে যূথী রাজী আছে কিনা তা জানার জন্যে বললেন । আমি যূথীকে গিয়ে বলতেই ও বললো “আমি কি তোদের খুব বোঝা হয়ে গেছি ভাইয়া ?” মাঝে মাঝে আমি যূথীর কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনা ।

আজও পারলামনা । অনেক বোঝালাম ওকে । ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো । একসময় ঠিক করলাম আজকেও রাত জাগবো দুই জনে । এতোদিন যূথী আমাকে চা বানিয়ে খাওয়াতো আজ আমি ওকে চা বানিয়ে খাওয়ালাম ।

ওকে বললাম “তুই কি জানিস তোর চা টা খুব ভালো হয় । তোর স্বামীকে এটা দিয়েই হাতে রাখতে পারবি তুই” । যূথী হেসে ফেললো । আমি বললাম “তুই না থাকলে আমার সত্যিই খুব অসুবিধা হবেরে যূথী” । ও বললো, “আমার বিয়েটা না দিলে হয়না ভাইয়া” আমি আবার চুপ হয়ে গেলাম ।

যূথী কাদতে থাকলো নিঃশব্দে । আমি একটু হেসে বললাম “বিয়ে হয়ে গেলে আমাদের মনেই পড়বেনা আর দেখিস” ও চোখ মুছতে মুছতে মুখ বাকিয়ে বললো, “তোকে বলেছে” । অবশেষে যূথীর বিয়ের দিনটা চলে এলো । সারা বাড়ি অনাবশ্যক একটা আনন্দে ভাসছে । সবচেয়ে খুশি মনে আছে বাবা ।

সবদিকে খেয়াল রাখার চেষ্টা তার । সব মেহমানরা আসছে । তাদের দিকে খেয়াল রাখা । শুধু কোন কাজ নেই যূথীর । ও নিজের ঘরেই আছে চুপচাপ ।

তুলি আর মিথি সারাবাড়ি মহা আনন্দে ঘুরে বেরাচ্ছে । বাড়ির একমাত্র এবং বড় ছেলে হিসেবে অনেক দায়িত্ব পড়ার কথা আমার ওপর । সেই তুলনায় আমার ওপর তেমন কোনো কাজ পড়েনি । কেনো যেনো মনে হচ্ছে সব এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে । আমার মন একদিকে যতটা খুশি অন্যদিকে ঠিক ততটাই মন খারাপ ।

কারণ এই বাড়িতে আমার একমাত্র বন্ধু বলতে যূথী । তুলি আর মিথির সাথে আমার তেমন একটা কথা বার্তা হয়না । ওরা দুইজনেই ওদের নিজেদের জগৎ নিয়েই থাকে । হয়তোবা ওদের দিকে তেমন খেয়ালও রাখা হয়না আমার । যা করার যূথীই করত ।

আমি যূথীর ঘরে গিয়ে ঢুকলাম । যূথীকে বিয়ের সাজে অপরূপ লাগছে দেখতে । আমি আজ খেয়াল করলাম আমার প্রত্যেকটা বোন ই অসম্ভব রূপবতী । যূথী আমার দিকে তাকালো । বললো, “ভাইয়া এদিক আয় তো” আমি ওর পাশে গিয়ে দাড়ালাম ।

আমি ভাবছিলাম ও হয়তো এখনি কান্নাকাটি শুরু করে দিবে । কিন্তু ও আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, “দ্যাখ তো আমায় কি রকম লাগছে?” । আমি কিছু বললামনা, হাসলাম । কে বলবে এই মেয়ে বিয়েই করতে চাচ্ছিলোনা । একজন এসে ডেকে গেল আমাকে ।

বর এসে গেছে । আমি বের হয়ে গেলাম যূথীর রুম থেকে । রাত ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে যূথীর বিয়ে হয়ে গেলো । মাঝে একটু ঝামেলাও লেগেছিলো যা প্রত্যেক স্বাভাবিক বিয়েতেই লাগে । একসময় সব মিটমাটও হয়ে গেলো ।

খাওয়া দাওয়া শেষে যুথীকে বিদায় দেওয়া হলো । এই সময় বাবা কাঁদলো খুব । যুথীও কাঁদলো । অনেক বুঝিয়ে গাড়ীতে তুলে দিলাম ওকে । এক মুহুর্তেই আমাদের এই পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ হয়ে গেলো ।

যুথীকে বিদায়ের পর সেদিন বাবা বারান্দায় বসে রইলেন অনেকক্ষণ । বাবাকে দেখে আমার মনে হলো আমি একটা নিঃসঙ্গ মানুষকে দেখছি । যে মানুষটার ছায়ায় আমরা সব ভাই বোনেরা বড় হয়েছি । অথচ কিসের বা কার ছায়ায় আমরা আছি তা কেউই লক্ষ্য করিনি কখনো । আর এই মানুষটা এখনো ঠিক আগের মতোই আগলে রাখছেন সবাইকে ।

আমাদের সবার মধ্যে সম্পর্কের দৃঢ়তায় বেচে থাকতে শিখিয়েছেন । অথচ নিজে কখনোই কিছু চাননি আমাদের থেকে । ৩. যূথীর বিয়ের ২ বছর হয়ে গেলো প্রায় । আমাদের বাড়িটা এইভাবেই চলছে । আমার চাকরী, বাবার এমনিতেই ব্যস্ত থাকার চেষ্টা ।

তুলি আর মিথির আর একটু বড় হওয়া । যূথী মাঝে মাঝেই আসে । ও আসলে কিছুদিন খুব ভালো যায় । গল্পগুজবে থাকা যায় । ওর এখনো কোনো সন্তান হয়নি ।

তুলি আর মিথি আগের মতোই আছে । উচ্ছল আর প্রাণবন্ত । যূথী আসলে ওরা সবচাইতে বেশি খুশি হয় । কোনো কোনো দিন রাতে আমরা আড্ডায় বসি । আমরা মা হারা ভাই বোনেরা আমাদের হাসি কান্নাগুলোকে এক করে ফেলি ।

খুব ভালো সময় কাটে আমাদের । নিজেকে বড় সুখি মানুষ মনে হয় এই সময়গুলোতে । আস্তে আস্তে বেলা বাড়তে থাকে আমার আর আমার পরিবারের । তুলির সামনে এইচ এস সি পরীক্ষা । আমি ওদের ঘরে রোজ রাতে একবার যাই ।

ঘরে ঢুকলেই আগে তুলির পড়ার টেবিলে তুলি পড়ছে এই দৃশটা চোখে পড়ে । আমি কিছুক্ষণ ওদের ঘরে কাটিয়ে আবার নিজের ঘরে চলে আসি । কিংবা আমার ঘরের সাথের বারান্দায় বসি । ইদানিংকালে সিগারেট খাওয়া ধরেছি । রাত জাগা স্বভাবটা ছাড়াতে পারিনি ।

যূথীর বিয়ের সময় ভেবেছিলাম যূথী চলে গেলে হয়তো আর রাত জাগতে পারবোনা । আমি এখন বুঝতে পারি কারো শূন্যতার জন্য কারো কোনো কিছু থেমে থাকেনা কখনো । ইদানিং মনে হয় তুলিরও রাত জাগা স্বভাব হয়েছে । ও প্রায় দিনেই আমাকে চা বানিয়ে এনে দেয় মধ্য রাতে । জিজ্ঞেস করলে বলে ওর নাকি ঘুম আসেনা ।

অবশ্য ওর এইসময় যা বয়স তাতে এরকম হওয়া অস্বাভাবিক না । আমি কিছু বলিনা এই নিয়ে । তুলি চা খেতে খেতে অনেক গল্প জুরে দেয় আমার সাথে । সব ওর স্কুলের বা বন্ধু বান্ধবদের গল্প । ভালোই লাগে শুনতে ।

মাঝে মাঝে তুলি অনেক মজার মজার কথা বলে । আবার কখনো কখনো ওর কথা শুনলে মনে হয় ও অনেক বড় হয়ে গেছে । অবশ্য যদিও মেয়েরা অনেক অল্প বয়সেই বড় হয়ে যায় । তুলির মুখ গোমরা দেখছি আজ অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই । মিথিকে একবার জিজ্ঞেস করলাম ।

ও বললো জানেনা কিছু । আমি আর ঘটালামনা । থাকুক ও ওর মত কিছুক্ষণ । রাতে খাবার সময় দেখালাম ও আগের মতোই আছে । ওকে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে কিছুক্ষণ আগেও আমি ওর মন খারাপ দেখেছি।

আমি জেগেই ছিলাম । দেখলাম তুলি আমার ঘরের দড়জায় দাড়িয়ে আছে । ওকে দেখে বললাম, - কিরে দড়জায় দাড়িয়ে আছিস কেনো ? ভেতরে আয় । তুলি আমার পাশে এসে দাড়লো । ওর চোখ লাল দেখে বললাম, -কিরে কান্না টান্না করেছিস নাকি? চোখ এমন লাল কেনো? কি হয়েছে ? = কিছুনা ভাইয়া এমনিতেই ।

- এমনিতেই মানে? কি হয়েছে বল ? = মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে ভাইয়া হঠাৎ করে । বলতে বলতে ঝর ঝর করে কেদে ফেললো ও । আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলাম । কেনো যেনো মনে হলো । শুধু মায়ের কথা না তুলির আরো অন্য কিছু হয়েছে ।

কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছিনা । আমি একবার জিজ্ঞেস করতে চাইলাম । পরে আবার বাদ দিলাম । বললাম। “তুলি যা তো ।

আমার জন্যে খুব কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়” । তুলি চা বানিয়ে নিয়ে এলো । তারপর কিছুক্ষণ গল্প করে ওকে ঘুমোতে পাঠালাম । আমিও শুয়ে পড়লাম । সকালে বাবার ডাকে ঘুম ভাঙলো আমার ।

দেখলাম বাবার চোখে পানি । তিনি কাঁপতে কাঁপতে কোনো রকমে বললেন ‘বাবু তুলি আর নেই” । আমি কি শুনছি বুঝতে পারলামনা । এক দৌড়ে গেলাম তুলির ঘরে । মেঝেতে আমার ছোট বোনটার নিথর ঠান্ডা দেহ পড়ে আছে ।

বুঝতে আর বাকি রইলোনা গত রাতে সুইসাইড করেছে তুলি । আমার মনে কোন প্রশ্ন এলোনা আর । তুলির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম । মিথি এসে আমার হাত ধরলো । আর থাকতে পারলামনা ।

মিথিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকলাম । আমি কখনো তুলির সুইসাইড করার কারণ জানার চেষ্টা করিনি । যূথী হয়তো কোনোভাবে কিছু জেনেছিলো । ও আমাকে বলতে চেয়েছিলো । আমি মানা করেছি বলতে ।

বলেছি, “তুলির যেটুকু স্মৃতি আমার কাছে আছে সেটুকুই থাকুক । আর কিছু জানার দরকার নেই আমার । ওর মৃত্যুর কারণটা না হয় অজানাতেই থাকুক” । যূথী চলে যাবার দিন তুলির লিখা ডায়রীটা আমায় দিয়ে গেলো । রাত্রি বেলা ওটা পড়তে বসলাম আমি ।

ডায়েরীতে আমাদের সবার সম্পর্কে অনেক কিছুই লেখা । “আমি বড় হয়েছি এক অতি ভালো পরিবারে । যে পরিবারটায় আমার বাবা আছে একটা বড় ভাই আছে, বড় বোন আছে আর ছোটো বোন আছে । আমি যেবার ক্লাস সেভেনে উঠলাম সেবার মা মারা গেলেন । আমি বড় হতে থাকলাম মা বিহীন এক সংসারে ।

যদিও আপুর জন্য কখনোই মায়ের অভাব বোধ হয়নি । আপু যেবার বিয়ে হয়ে গেলো আমি লুকিয়ে অনেক কেদেছি সেদিন । কেউ দেখেনি । আপুর কাছে গিয়েও কেদেছি অনেক । আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হলো আমার বড় ভাই ।

বান্ধবীদের কাছে থেকে বড় ভাই সমন্ধে যা বিবরণ শুনেছি তার পুরোপুরি ব্যাতিক্রম আমার ভাই । কোনোকিছু মানা করেনি কখনো । যখন যা চেয়েছি তা পেয়েছি । ভাইয়াকে রাত জাগতে দেখলে খুব খারাপ লাগে আমার । তখন ভাইয়াকে দেখলে খুব একলা একলা লাগে ।

আমিও রাত জাগি এখন । মাঝে মাঝে ভাইয়াকে চা বানিয়ে খাওয়াই । ভাইয়া তখন খুব গল্প করে আমার সাথে । আমার খুব ভালো লাগে । নিজেকে অনেক বড় বড় মনে হয় ।

এইতো আজও ভাইয়াকে চা বানিয়ে খাওয়ালাম । কদিন থেকে মনে করেছি ভাইয়াকে বলবো ভাইয়া আমি খুব খারাপ মেয়ে । তোমার বোন হবার যোগ্য আমি নই । আমি খুব খারাপ একটা কাজ করেছি । তুমি আমাকে কখনো ক্ষমা করোনা ।

কিন্তু বলতে পারছিনা । ভাইয়ার সামনে গেলে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । এই মানুষটাকে কিভাবে বলি আমি...” আমি আর পড়তে পারলামনা । নিজেকে অপরাধী মনে হলো কেন জানি । বার বার মনে হলো সেদিন যদি তুলিকে আর কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখতাম ।

আর কিছুক্ষণ গল্প করতাম ওর সাথে । তাহলে হয়তো এমনটা হতোনা । কিংবা আমি যদি আর একটু খেয়াল রাখতাম.. এখনো প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে তুলির ঘরে যাই রোজ । তুলি নেই সেটা মনে থাকেনা । ঘরে ঢুকলেই তুলি পড়ার টেবিলে বসে আছে এই দৃশ্যটা দেখতে চাই নিজের অজান্তেই ।

তুলি মারা যাবার পর মিথি চুপচাপ হয়ে গেছে একেবারে । সারাদিন চুপচাপ থাকে । তেমন কথা বার্তা বলেনা কারো সাথে । অবশ্য ওর কথা বলার মানুষও নেই এখন আর । ৪. আমাদের বাড়িটার নাম ছিলো ছায়ানীড় ।

আমার মায়ের নাম ছিলো ছায়া । তুলি মারা যাবার পর বাবা বাবা নাম বদলে রাখলেন “ছায়া তুলি নীড়” । ছায়া বা তুলি কেউই এখন্নেই আমাদের মাঝে । কিংবা আমাদের মাঝেই আছে । ইদানিং প্রায়ই রাতে বাবাকে বারান্দায় বসে থাকতে কিংবা পায়চারি করতে দেখি ।

সেদিন গিয়ে সামনে দাড়ালাম বাবার । বাবা চমকে উঠে বললো, “কে? ছায়া?” । -আমি বাবা = ও বাবু? ঘুমাসনি এখনো? - নাহ । তুমি ঘুমাওনি কেনো? = ঘুমিয়েছিলাম । হঠাৎ দেখলাম তোর মা বাইরে দাড়িয়ে আছে ।

- যাও তো বাবা । ঘুমাও গিয়ে । = আচ্ছা । যাচ্ছি । তুইও যা ঘুমো গিয়ে ।

আর জেগে থাকিসনা । বাবা চলে গেলো । আমি আরো কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকলাম বারান্দায় । কে জানে হয়ত আমার অবচেতন মনও মা কে দেখতে চাইছে । মিথিকে এখন খুব করে আগলে রাখি আমি আর বাবা ।

বাবা রোজ ওকে স্কুলে নিয়ে যায় আবার নিয়ে আসে । সন্ধ্যেবেলায় আগের মতোই পড়তে বসায় ওকে । পড়ার ফাকে আচমকাই বলে ওঠে “বুঝলি তুলি?” বলেই হুট করেই থেমে যায় । চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ । মিথিও আর কিছু বলেনা ।

অবাক হয়ে তাকায় বাবার দিকে । তারপর আবার পড়ায় মন দেয় । পড়া শেষে কোনোদিন আমি মিথির ঘরে বা কোনোদিন মিথিকে আমার ঘরে নিয়ে আসি । ওর ঘুমা না আসা পর্যন্ত নানান গল্প করি । একসময় মিথি আমাকে তুমি করে বলতো ।

এখন অনেক বলে দেওয়ার পর তুই বলে । তারপরও মাঝে মাঝেই তুমি বলে ফেলে । তারপর দাতে জিহবা কামড়ে ধরে হেসে ফেলে । মিথি বড় হচ্ছে । বুঝতে পারছে ধীরে ধীরে আমাদের পরিবারের অবস্থা ।

আমি আর বাবা অনেক আদরের মাঝে বড় করার চেষ্টা করছি ওকে । মাঝে মাঝে যূথী আসে । ও আসলে তুলি আর মায়ের কথা মনে করে কাঁদে । বাবা ওকে সান্তনা দিতে গিয়ে নিজেই কেঁদে ফেলে । বাবা মেয়ের এই কান্না দেখতে বেশ ভালোই লাগে আমার ।

যূথীর শ্বশুর বাড়িতেও বেশ সমস্যা চলছে ওর এখনো কোনো সন্তান না হওয়া নিয়ে । তবে আমি জানি অংশু খুব ভালোবাসে যূথীকে । ও ঠিকই সুখে রাখবে আমার এই বোনটাকে । তবে কে জানে ! সন্তান না হওয়ার যন্ত্রণা আর শ্বশুর বাড়ির খোঁটা শোনা এই দুই যন্ত্রণা শুধু মাত্র একটা নারীই বুঝতে পারে হয়ত । আমি তার সিকি ভাগও বুঝতে পারবোনা ।

এবার যূথী চলে যাওয়ার সময় খুব করে বলে গেলো এবার আমি যেনো একটা বিয়ে করে ফেলি । আমি কিছু বলিনি । মাঝে মাঝে যূথীর কথার কোনো জবাব পাইনা আমি । একঘেয়ে এই জীবনে প্রতিদিন নিয়ম করে চলি । ভালোও লাগেনা আবার খারাপও লাগেনা ।

সবকিছু কেমন যেনো সয়ে গেছে । মাঝে মাঝে ভাবি বেশ তো ছিলাম । সেইরকম থাকলেই তো হতো এমন হওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিলো । আবার ভাবি সবকিছু যদি আমার হাতে থাকতো তবে সব বদলে দিতাম । তুলির কিছু হতে দিতামনা ।

আজও তুলি বেচে থাকতো । আজও হয়তো আমি জেগে আছি দেখে চা বানিয়ে এনে খাওয়াতো । তারপর পাশে বসে ওর না বলা কথাগুলো বলতো । আমি হতাম সবচেয়ে সুখী মানুষদের একজন । এখন বাবাকে দেখলে মনে হয় বাবার বয়স হঠাৎ করেই যেনো বেড়ে গেছে অনেক ।

বাবা যেনো খুব বুড়ো হয়ে গেছে । বাবার দিকে আর তাকাতে পারিনা । আমার কিছুই বলার নেই বা করার নেই । নিজেকে খুব অসহায় লাগে । তুলি ওর ডায়েরীতে লিখেছিলো আমি যেনো সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিই ।

সেদিন থেকেই সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি । কখনো কখনো স্বপ্নে দেখি তুলিকে । আরো সুন্দর হয়েছে দেখতে ও । দেখি তুলি আর মিথি সারা উঠোন ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে আর আমাকে ডাকছে । আমি চমকে উঠে জেগে যাই ঘুম থেকে ।

স্বপ্ন আর বাস্তব একাকার হয়ে যায় মিলেমিশে । স্বপ্নটাকে বড্ড বেশি বাস্তব মনে হয় । মাঝে মাঝে নিজেকে মুক্ত করে দিতে ইচ্ছে করে । আমরা মৃত্যু মানেই মুক্ত বুঝি । কারণ হয়ত মৃত্যর পরের অবস্থানটা দেখা নেই আমাদের ।

মানুষ হিসেবে আমরা খুব অল্প ভালো সময় কাটাই । তাই হয়ত ভালো সময়গুলোর জন্য আমাদের এতো অপেক্ষা... আমি এখন বসে থাকি ঘরের এককোণে কিংবা বারান্দার একপাশে । নিজের একাকিত্ব বা মহাশূন্য হবার গল্পটা সাজাতে থাকি মনে মনে । অসংখ্য পাতার পর পাতা লিখা হতে থাকে আমার গল্প । আমি নির্বাক নিশ্চুপ আর নিরুত্তর থাকি অনেকক্ষণ ।

আমার নিরবতা ভাঙানোর কেউ থাকেনা । আমি সময় কাটাইনা, সময় পেরিয়ে যেতে থাকে তার ইচ্ছে মতো । রোজ সন্ধ্যা হয়, রাত হয়, গভীর রাত হয়, ভোর হয় তারপর আরেকটা দিন শেষে আবার আরেকটা সন্ধ্যা আসে । যেই সন্ধ্যা থেকে শুরু সেই সন্ধ্যা থেকেই শেষ । আমি রোজ হারাই ।

নিজের সত্তা খুঁজতে থাকি কোনো এক বসন্তে । আবার আমি রোজ একা হই... __©একজন পরিব্রাজক between.poribrajok@জিমেইল.com ফেইসবুক প্রোফাইল : http://www.facebook.com/ekjon.poribrajok/  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।