"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি তখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি মাত্র। বাইক স্টার্ট দিয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দাবড়ে বেড়াই। সঙ্গী ছিলো পি ২২৬ এর ব্লাক ভার্শনের একটি আমেরিকান গান। হাতলে লেখা সিগ সুয়ার। এক বড় ভাইয়ের বদৌলতে পাওয়া গান।
পাওয়ার নামক একটা শব্দ আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। সব কিছুতেই আধিপত্য নামক একটা শক্তি ছড়িয়ে দেয়ার নেশা। নিজেকে তুলে ধরা আর পাবলিকের রেসপেক্ট এক্সপেক্ট করাই আমার ডেসটিনেশন। জুনিয়রদের "ভাই" আর নিন্ম পেশার লোকদের "মামা" বলে ডাকাটা দারুন লাগতো। অন্ধ সময় আর অন্ধকারের মায়া।
ইরফান ছিলো আমার সবথেকে ভালো বন্ধু। অসীম সাহসী আর দুর্বার মনোবল। দুজনের জীবন যেন এক ছিলো আমাদের। লক্ষ্য ছিলো আমরা রাজনীতি করবো নিজেদের লাভের জন্য, কিন্তু কারো ক্ষতি করে নয়। ইরফান ছিলো ভীষণ রাগী আর একগোয়ারে ছেলে।
যা একবার মুখে বলবে তা ও করে দেখাবেই। মাঝে মাঝে আমি নিজেই ওকে দেখে ভয় পেয়ে যেতাম। কলেজে থাকতে একবার এক ছেলে আমাকে তুমি করে বলেছিলো, সেই জের ধরে গভঃল্যাব স্কুলের পেছনের মাঠে এক ছেলেকে ক্ষুর দিয়ে এলোপাথারি আক্রমণ। ওকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। সেদিন ওর যে রক্তচক্ষু দেখেছিলাম তা হয়তো কখনোই ভুলবার নয়।
ও একটা কথাই বলতো," তুই আর আমি এক, তোকে কিছু বলা মানেই আমাকে বলা, তোর জন্য জান কুরবান। "
সবদিক থেকে এগিয়ে থাকতো ইরফান। এমন কি পড়ালেখাতেও। গোল্ডেন প্লাস পেয়ে কলেজ থেকে পাশ করে বের হয় ও। আর আমার চার সাবজেক্টে প্লাস নিয়ে এ গ্রেড।
দেশের স্বনামধন্য বিদ্যপীঠে ভর্তি হয় ইরফান, আর আমি প্রাইভেটে। আমি থাকতাম ঢাকার একপ্রান্তে আর ও অন্যপ্রান্তে। তারপরেও কখনো আমরা নিজেদের আলাদা ভাবিনি। ওর সবটুক সময় যেন শুধু আমার জন্যই ছিলো। এমনকি গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময়ও আমাকে নিয়ে যেতো।
আর গার্লফ্রেন্ডের সামনে আমাকে টিটকারি করে বলতো," মামা তোমার চেহারা আছে, স্মার্টনেস আছে, কিন্তু তুমি বোবা, মাইয়া মানুষ শরম পাও, তোমার কপালে প্রেম নাই!"
ইরফানের জন্যই আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে যাই। ও আমাকে রাজনীতি থেকে দুরে রাখার চেষ্টা করতো। ও বলতো_" বন্ধু, এইগুলা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা কর। একসময় বুঝতে পারবি এই লাইফ কতটা খারাপ। " আমি ওর কথা শুনে হাসতাম।
আমি বলতাম,_" তুই যেদিন ছেরে দিবি আমিও তোর পিছু নেব। নিজে এত ভালো বুঝস কিন্তু তুই ছারস না কেন? অন্তত তাহমিনার কথা চিন্তা করে ছেরে দে। " চুপ করে থাকতো ও।
কলাবাগান কোয়ার্টার মাঠের আড্ডা জমিয়ে রাখতো ইরফান। সিনিয়র ভাইয়েরাও অনেক ভালোবাসতো ওকে।
আমাদের প্রতিটি সার্কেলেই ইরফানের অন্যরকম প্রভাব ছিলো। কোন বন্ধুর আবদার অসম্পূর্ণ রাখতো না। বলতো,_"বন্ধুদের জন্য 'না' বলে কোন শব্দ আমার ডিকশনারীতে নাই। "
চাঁনমিয়া নামে ইরফানের এক ফ্যান ছিল। চাঁনমিয়ার বয়স দশ কি বারো।
টোকাই শ্রেনীর মধ্যে উৎকৃষ্ট টোকাই বলা যায়। বিকালে কাউন্টারের পাশের টং দোকানে আড্ডায় হাজির থাকতো চাঁনমিয়া। ইরফান বলতো,_"এইটা আমার টাইগার বুঝলি, বড় হইলে আমার থেকে এক ডিগ্রি বেশি হবে। " সারাদিন ঘুরে ঘুরে ইরফানের জন্য তথ্য উপাত্ত যোগার করতো চাঁনমিয়া। ইরফানও ছেলেটাকে অনেক আদর করতো।
রমজান মাস শুরু হয়েছে। তেইশ রোজার ঘটনা। রাত আড়াইটায় আবির আমাকে ফোন করে জানায় নাখালপাড়ায় কারা যেন ইরফানকে গুলি করেছে। ঢাকা হাসপাতালে আছে এখন। আমি গায়ের প্রতিটি লোম দাঁড় হয়ে যায় ঐ অবস্থায়।
আমি এলাকার বন্ধু তামিম কে নিয়ে দ্রুত মেডিকেলে চলে যাই। বার্ন ইউনিটের অপজিটে ইমার্জেন্সি সেকশনের গেট দিয়ে দৌড়ে ভিতরে ঢুকি। আবির ধরে রাখে আমাকে। আমি তাকিয়ে ছিলাম চাকা ওয়ালা স্টিলের বেডটার দিকে। শুয়ে আছে আমার প্রিয় বন্ধু।
শার্টের বাটন খোলা। ডানপাশে কোমরের উপরে রক্তে ভেজা তুলা। বেডটার উপরে খয়েরি রংয়ের রক্ত জমাট বেঁধে আছে। হাতে হোয়াইট গোল্ডের ব্রেসলেটটা। পাশে ওর মা অজ্ঞান হয়ে পরে আছে বড় আপুর কোলে।
আহাজারির শব্দ। আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। গোঙানো আর্তনাদে চোখ থেকে শুধু পানি ঝরছিলো আর বুকের ভেতরটা কেমন যেন শুন্য মনে হচ্ছিলো।
একসপ্তাহ পরে তাহমিনা একদিন ফোন করে দেখা করতে চায়। মেয়েটার চোখের নিচে গাঢ় কালো ছাপ পরেছিলো ।
মুখটা শুকিয়ে রুগ্ন হয়েছিলো। তাহমিনা সেদিন আমাকে রেকুয়েস্ট করেছিলো ইরফানের কবরটা দেখিয়ে দিতে। মেয়েদের নাকি কবরে প্রবেশ নিষেধ। দূর থেকে দাড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো। সেদিন ওর চোখে আমি অশ্রু দেখিনি।
হয়ত মাত্রতিরিক্ত কষ্টে শুকিয়ে গিয়েছিলো সবটুক অশ্রু। আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। ওকে একা রেখেই চলে আসি কাপুরুষের মত।
আর চাঁনমিয়া। ওকে দেখলেই ইরফানের একটা মায়ার ছাপ খুঁজে পেতাম।
চাঁনমিয়ার জন্য হাশেমের টং দোকান এখনো ফ্রি আছে।
"ও বন্ধু তোকে মিস করছি ভীষন, তোকে ছারা কিছু আর জমেনা এখন"
অফটপিকঃ সামান্যতম বাস্তবতার অন্তরালে গল্প। গল্পের চরিত্র ও কাহিনী কাল্পনীক ভেবে নেয়াই শ্রেয়। আর গল্পটি ব্লগার সরলতাকে ডেডিকেট করলাম। আমার ব্লগের একজন নিয়মিত পাঠক ও সমালোচক।
তার মৌন বিদ্রহ সকলের মত আমাকেও কষ্ট দিচ্ছে। ব্লগার আঁধারী অপ্সরাও তার সব পোষ্ট ড্রাফটে নিয়ে নিয়েছে সরলতার জন্য। সরলতার কাছে আবেদন থাকবে শীঘ্রই যেন আবার ফিরে আসে তার সরল রূপে। প্রিয় শাহরিয়ার কবির ড্যানি ও চশমখোরও চলে যাওয়ার পথে। সকলের প্রতি আবার ফিরে আসার আহ্বান রইল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।