পৃথিবীর সব ভালোই আমার ভালো লাগে। পাবনা জেলার মেয়ে নাজু। ভালো রোজগারের আশায় মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। কিন্তু গিয়ে দেখলেন, তাকে যে বেতন দেওয়ার কথা ছিল তা দিচ্ছে না ওরা। শুধু তাই নয়, গৃহকর্তা ও তার ছেলে তাকে যৌন নিপীড়নও করত।
রাজি না হলে তাকে অকথ্য নির্যাতন করা হত। অবশেষে তার এক অভিবাসী আত্মীয়ের সহায়তায় তিনি অন্য জায়গায় কাজ নিয়ে চলে যান। তবে তিনি এখন ভালো আছেন। বর্তমানের মালিক আগের তুলনায় ভালো। নরসিংদী জেলার রিনা বেগমের কাহিনী ভিন্ন রকম।
দালালরা তাকে সেলাইয়ের কাজ দেবে বলে সৌদি আরবে নিয়ে যায়। কিন্তু তাকে দেওয়া হয় বাসার কাজ। সেখানে তিনি একা ঘরের সব কাজ করতেন। বিনিময়ে তাকে সারাদিনে মাত্র একটি রুটি খেতে দেওয়া হত। রাতে ঘুমাতে যেতে পারতেন তিনটায়।
আবার সকাল পাঁচটায় তাকে তুলে দেওয়া হত। ঘুম থেকে উঠতে পাঁচ মিনিট দেরি হলেই বাড়িওয়ালী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে মারধর করত। কষ্ট করে দুই বছর তিনি সেখানে থেকেছেন। কারণ প্রায় সব সম্পত্তি বন্ধক, বিক্রি, ধারদেনা করে বিদেশে গিয়েছিলেন তিনি। হায় নিয়তি! শেষ পর্যন্ত একদিন অর্ধমৃত অবস্থায় তাকে দেশে ফেরত পাঠাল ওই সৌদি পরিবার।
বিগত বছরে আমাদের দেশে অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা, যেখানে নারীর ভূমিকা কোনও অংশে কম নয়। বিভিন্ন দেশে নানা কাজের জন্য আমাদের নারীশ্রমিকদের নেওয়া হচ্ছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বু্যরোর হিসাব অনুযায়ী, শুধু গত বছরই অন্যদেশে মোট নারীশ্রমিক গেছেন ২২ হাজার ২৪৪ জন। এসব নারীর বেশিরভাগই অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর। ভাগ্যান্বেষণে তারা পাড়ি দেন দূর দেশে।
কিন্তু এসব শ্রমিক বিদেশে গিয়ে নানা ধরনের অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হন। নির্যাতনের মাত্রা যে কতটা ভয়ানক হতে পারে তা আমরা চিন্তাও করতে পারি না। অনেককে শেষ পর্যন্ত লাশ হয়ে দেশে ফিরতে হয়। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে লেবাননে। সেখানে ২০০৯ সালে নির্যাতনের শিকার হয়ে লাশে পরিণত হতে হয়েছে ১৫ বাংলাদেশি নারীকে।
তেমনি এক কন্যাহারা মা টেলিভিশনে 'বিবিসি সংলাপ'-এর একটি অনুষ্ঠানে দর্শক প্রশ্নের পর্বে কান্নায় ভেঙে পড়ে জানান, তার মেয়ের পরনে এক টুকরো কাপড়ও ছিল না। এ কেমন বীভৎসতা! বেশিরভাগ নারীকর্মীই বিদেশে যান গৃহপরিচারিকা হিসেবে। এসব নারীশ্রমিক সেখানে গৃহকর্তা ও গৃহের অন্য পুরুষদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হন। ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার সখিনা লেবাননে যাওয়ার মাত্র দেড় মাসের মাথায় মারা যান। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের নিরাপদ অভিবাসন কর্মসূচি সমন্বয়ক জানান, নিপীড়নের শিকার হয়ে সখিনার মৃত্যু হয়েছে।
ক্রমেই এসব নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এ সমস্যা দূর করার জন্য সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি দরকার তা হল, সচেতনতা। একই চিন্তা থেকে সম্প্রতি বিটিএমটির (জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) উদ্যোগে নারী কর্মীদের কল্যাণার্থে ওই ভবনেই নারী অভিবাসী ও তথ্য কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এই তথ্য কেন্দ্রের কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার বললেন, তারা বিদেশ-গমনেচ্ছুক নারীদের সব ধরনের সাহায্য করে থাকেন। তাছাড়া বিদেশে গিয়ে কেউ যদি কোনও সমস্যায় পড়েন, আর তা যদি আমাদের অবহিত করা হয় তাহলে আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নিয়ে এজেন্সির বিরুদ্ধে অ্যাকশনে গিয়ে সমস্যার সমাধান করি।
বাংলাদেশে এরূপ রিক্রুটিং (বৈধ) এজেন্সি আছে ১৪টি। তিনি আরও বলেন, শ্রমিক যে দেশে যাবেন সে দেশের ভাষা সম্পর্কে তার ন্যূনতম জ্ঞান থাকা দরকার। তাই নারী কর্মীদের জন্য বর্তমানে এসব প্রশিক্ষণ নেওয়া বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ ফি হাতের নাগালেই_ মাত্র ৩০০ টাকা। তথ্য কেন্দ্রটির পরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, যে সব দেশে দূতাবাস নেই, সে সব দেশের অভিবাসীরা পাশের দেশের দূতাবাস থেকে সাহায্য নিতে পারবেন।
যেমন, লেবাননের কর্মীরা জর্ডান থেকে সাহায্য পেতে পারেন। তবে লেবাননে এক মাস আগে আমরা একজন কনসালটেন্ট নিয়োগ করেছি। তিনি আপাতত এ বিষয়গুলো দেখবেন। এত কিছুর পরও নারীরা যখন তাদের আগ্রহ না কমিয়ে বাড়িয়েছেন তখন এসবের ফায়দা লুটছেন রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। নারী কর্মীদের জন্য সরকার অনুমোদিত সর্বোচ্চ ব্যয় হল ২০ হাজার টাকা।
কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এসব দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে আদায় করে নিচে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। ব্যুরোর কর্মকর্তা মোঃ শওকত হোসেন (কল্যাণ ) বলেন, ভুক্তভোগীরা যদি আমাদের কাছে অভিযোগ না করেন তাহলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নিতে পারি না। দালালদের মাধ্যমে নারীদের বিদেশে যাওয়া আরও বিপজ্জনক। কারণ দালালরা অনেক সময় বিদেশে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে দেয় বা অন্য কোনও দেশে নিয়ে যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেয়। এত সমস্যার পরও নারীরা বিদেশে যাচ্ছেন শুধু সোনালী ভবিষ্যতের আশায়।
তিন সন্তানের জননী পারুল বেগম তাদেরই একজন। বাড়ি ফরিদপুর। বড় মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ছে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন কিন্তু অর্থের অভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানাতে পারছেন না। ছোট দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ আছে।
স্বামী লেদ মেশিনে কাজ করেন। এত খরচ কি আর তার সামান্য উপার্জনে চলে? স্বামী-সন্তান-সংসার রেখে বিদেশে যাবেন, খারাপ লাগছে না? পারুল অশ্রুসজল নয়নে বলেন, 'কী করমু আফা, সন্তানগুলানরে মানুষ করা লাগব না? বিয়া-সাদি দেওন লাগব না? কইত্থন পামু এত টাকা বিদেশে না গেলে?' সত্যিই তো এ মায়ের স্বপ্নগুলো তো আর আপনা-আপনি পূরণ হয়ে যাবে না। 'নারী অভিবাসী তথ্য কেন্দ্র' তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জেলা পর্যায়ে নারীদের সচেতন করে তোলার জন্য তারা ১৭ জেলায় ওয়ার্কশপ করবে। এখানে কীভাবে ব্যাংক একাউন্ট খুলতে হবে, প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রক্রিয়া প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা হবে। এভাবেই ধীরে ধীরে সব বিষয়ে দক্ষ ও সচেতন করে তোলা হচ্ছে আমাদের কর্মীদের।
আমরাও চাই সচেতন হয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েই তারা বিদেশে যান
উৎসঃ দৈনিক পূর্বকোন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।