বৃটিশ এম পি রুশনারা আলী ও অভিবাসী জীবনের প্রতিচিত্র
ফকির ইলিয়াস
=======================================
অনেক প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একজন বাঙালি বংশোদ্ভূত এমপি স্থান করে নিয়েছেন। তিনি রুশনারা আলী। জন্ম বাংলাদেশের সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার লামাকাজি ইউনিয়নের বুরকী গ্রামে। মাত্র সাত বছর বয়সে অভিবাসী হয়ে ইংল্যান্ডে যান রুশনারা আলী। লেখাপড়া শেষ করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তারপর ক্রমে জড়িয়ে পড়েন ব্রিটিশ রাজনীতিতে। যে আসন থেকে তিনি এমপি হয়েছেন, সেই আসনের সাবেক এমপি ওনা কিংয়ের ক্যাম্পেনের অন্যতম দায়িত্ব ছিল রুশনারা আলীর ওপর। ফলে এ 'বেথনাল গ্রিন-বো' আসনটির নাড়ি-নক্ষত্র ছিল তার হাতের মুঠোয়। লেবার পার্টির ফাইনাল নমিনেশন পেতে প্রায় ৫০ জন প্রতিদ্বন্দ্বীকে ডিঙাতে হয়েছে তাকে। তারপর পেয়েছেন সেই গণভোটের বিজয় মুকুট।
রুশনারা আলীর এ বিজয়ে আনন্দে কেঁপে উঠেছে গোটা বিশ্ববাঙালি। টরেন্টো থেকে টোকিও। সিডনি থেকে নিউইয়র্ক। লন্ডন থেকে রিয়াদ। ঢাকা থেকে রোম।
আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে সিলেটে। আমি যখন টিভিতে রুশনারা আলীর সাক্ষাৎকার দেখছিলাম, তখন তার মুখে খাঁটি সিলেটী কথা শুনে আপ্লুত হয়েছি বারবার। তিনি তো আমাদেরই প্রতিনিধি, আমাদেরই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার।
পাস করার পর একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রুশনারা আলী। বলেছেন, আমি আমার এলাকার সব ব্রিটিশ নাগরিকের এমপি।
আমাকে সবার জন্য সমানভাবেই কাজ করতে হবে। দল-মত, জাতি, বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে আমি সব মানুষের প্রতিনিধি।
তার এ কথাগুলো আমার খুবই ভাল লেগেছে। একজন মা তার সন্তানকে লালন করে, মানুষের মতো মানুষ করে সমাজে পাঠান। আর সেই সন্তান ক্রমে সমাজের কল্যাণেই নিজেকে নিবেদন করেন।
এটাই শাশ্বত সত্য। রুশনারা আলী তাই অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গেই সেই দায়িত্বটির কথা স্মরণ করেছেন। তিনি বিশ্বমানবের কল্যাণে তার হাত বাড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। একজন শক্তিমান মানুষ এভাবেই নিজেকে সব মহৎ কাজে নিয়োজিত করেন।
রুশনারা আলীর এ মহাবিজয়ের পর আমার বারবার যে মানুষটির কথা মনে পড়েছে, তিনি হচ্ছেন বিলাত অভিবাসী প্রয়াত শ্রদ্ধাভাজন তাসাদ্দুক আহমদ।
মহান মুক্তি-সংগ্রামের অন্যতম প্রবাসী সংগঠক এ মানুষটি ১৯৮৫-৮৮ সালের দিকে একজন ব্রিটিশ-বাঙালি এমপির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বিলাত অভিবাসী বাঙালি সমাজকে। তিনি বিভিন্ন সভা, সমাবেশে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন-'হে প্রজন্ম জাগ্রত হও। তোমরা তোমাদের মাঝ থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তোমাদের প্রতিনিধি পাঠাও। '
ব্রিটেনের টাওয়ার হ্যামলেটস বরোটি যারা দেখেছেন, তারা জানেন, ওই এলাকার যে কোন সড়ক দিয়ে হাঁটলে মনে হবে তিনি বোধহয় সিলেটের কোন জনপথই পাড়ি দিচ্ছেন। প্রশ্ন সেটাই ছিল, তাহলে ওই মানুষেরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাঠাতে পারবেন না কেন? সে কাজটিই হয়েছে।
এ শুরুর মাধ্যমে অভিবাসী প্রজন্ম একটি মাইলফলক নির্মাণ করেছে। আশাকরি এ যাত্রা অব্যাহত থাকবেই।
দুই
আজকাল অনেককেই বলতে শুনি, বিশ্বে অভিবাসন প্রক্রিয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। কথাটি মিথ্যে নয়। এটা আমরা জানি এবং বুঝি, উন্নত জীবনের লক্ষ্যেই মানুষ নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে অন্যদেশে অভিবাসন জীবন বেছে নেয়।
ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি মহাদেশগুলো এভাবেই তাদের মুক্ত হাত দিনদিন বাড়িয়ে দিয়েছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি। কিন্তু অতি সম্প্রতি ধর্মীয় কট্টরবাদিতা, জঙ্গিবাদী মৌলতত্ত্ব, সহিংস আক্রমণের মানসিকতার কারণে আঁতকে উঠেছে ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ। একের পর এক ঘটনা কাঁপিয়ে তুলেছে এসব অঞ্চলের জনজীবন।
এর সর্বশেষ ঘটনাটি বহুল অলোচিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। নিউইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে গাড়িবোমা রাখার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে ফয়সল শাহজাদ নামে একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক।
ঘটনা প্রবাহ থেকে জানা যাচ্ছে, ফয়সল শাহজাদ ছাত্র ভিসা নিয়ে ১৯৯৮ সালে আমেরিকা আসে। এখানে সে উচ্চতর ডিগ্রিও নেয়। হুমা মিয়া নামে এক সুদর্শিনীকে বিয়ে করে। তাদের ছোট্ট দুটি সন্তানও রয়েছে।
কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যের ব্রিজপোর্ট শহরে তাদের একটি ছিমছাম বাড়িও ছিল।
মোট কথা, একটি সুন্দর জীবনের অধিকারী ছিল এ ফয়সল শাহজাদ। যে অভিবাসী হিসেবে মার্কিন নাগরিকত্বও নিয়েছিল। সে জড়িয়ে পড়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে। মার্কিনি গোয়েন্দাদের মতে, টাইমস স্কোয়ারে এ বোমাটি বিস্ফোরিত হলে হাজার মানুষের প্রাণনাশ হতে পারত।
এখন এ ফয়সল শাহজাদ মার্কিনি মিডিয়ার শিরোনাম প্রায় প্রতিদিন।
বিভিন্ন সূত্র খতিয়ে দেখছে, তার সঙ্গে পাকিস্তানভিত্তিক আল কায়দার সরাসরি সংযোগ ছিল।
এই যে অপকর্মের মহড়া, তা গোটা অভিবাসী সমাজকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। অভিবাস জীবন গ্রহণ করে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রচেষ্টা না করে ধ্বংসাত্মক মনোবৃত্তি কী লক্ষ্য বহন করছে তা আলোচিত হচ্ছে বিভিন্নভাবে।
ইউরোপ-আমেরিকায় একটি অপশক্তি নেপথ্যে সক্রিয় রয়েছে, যারা এখানের প্রজন্মকে 'ধর্মীয় জোশের' নামে ব্রেনওয়াশ করে বিপথগামী করতে চাইছে। সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে চাইছে।
তাই এ চরম ক্রান্তিকালে প্রতিটি সচেতন প্রবাসীকে সতর্ক এবং সজাগ থাকাটা খুবই জরুরি।
মনে রাখা দরকার, যারা ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে সমাজকে বিষাক্ত করতে তৎপর তারা সিংহ ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই, তারা যতটা সংগঠিত-শান্তিকামী সিংহভাগ মানুষরা ততটা সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ নন। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সবাইকে শান্তির অন্বেষণ করা প্রয়োজন।
অভিবাসে বাঙালি প্রজন্মের অনেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে উজ্জ্বল সফলতার সাক্ষর রাখছেন।
এসব অর্জনকে সমুন্নত রাখতে হবে। একজন রুশনারা আলীর কাজকে একজন ফয়সল শাহজাদের হীনকর্ম কোনমতেই যেন ম্লান করতে না পারে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে পুরো বিশ্বই এখন রাহুশক্তির কবলে। রাজনীতির বিবেকসত্তাই এ রাহুগ্রাস থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে। আর সেজন্য মানুষের ভূমিকাই হতে হবে অগ্রণী।
বিশ্বের জনমানুষের মিলিত উদ্যোগের শক্তিতে পরিবেশকে রাহুমুক্ত করতে হবে।
নিউইয়র্ক, ১১.মে.২০১০
-----------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ঢাকা। ১৪ মে ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।