শয্যা পেতেছি দেবীর সাথে: ভারতের মন্দিরগণিকাদের উপাখ্যানঃ পর্ব ১
============================================
প্রতি বছর ভারতে হাজার হাজার মেয়েকে মন্দিরের দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়, এরপর তাদের তাদের পেশা হিসেবে বেছে নেয় পতিতাবৃত্তিকে, সারাজীবনের জন্য।
উলিগাম্মা মন্দিরের শুভ্র খিলানগুলোর মধ্যদিয়ে ভারতের থুঙ্গাবাদ্রা নদীর দিকে এগোচ্ছিল দুরগাম্মা নামের মেয়েটি, কি যেন এক আশ্চর্য গর্বের সাথে! আজকে মেয়েটির বিয়ের দিন। তার আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশীর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল ১২ বছর বয়সী এই মেয়েটির দিকে।
থুঙ্গাবাদ্রা নদীটির সেতুর নীচে একজন পুরোহিত দুরাগাম্মার পরিবারের অর্ঘ্য হিসেবে আনা ছাগলটি গ্রহণ করল। খড়গের দ্রুত আঘাতে সে পাঁঠাটি মন্দিরের দেবী উলিগাম্মার উদ্দেশ্যে বলি দিল।
বলির রক্ত মিশে যেতে লাগল থুঙ্গাবাদ্রায়, যেখানে স্নান করছিল শত শত ভক্তরা।
দুরগাম্মার আত্মীয়ারা তার শরীরে চন্দন মেখে নদীতে গোসল করাল। এরপর যখন তাকে একটি সাদা শাড়ি পরিয়ে আনা হল, সে শুনছিল উঁচুশ্রেণীর পুরোহিতের কন্ঠস্বর, যার সংস্কৃত মন্ত্রপাঠ উপস্থিত কারোর বোধগম্য ছিল না। যখন তার মন্ত্রপাঠ শেষ হল, মন্দিরের পুরোহিত দুরাগাম্মার মাথায় হলুদবাটা মিশ্রিত পানি ঢেলে দিল।
দুরগাম্মা এরপর মন্দিরের ভেতরে গেল যেখানে একজন পুরোহিত তার গলায় একটি লালসাদা পুতিঁগাথা গেরুয়া রঙের সুতা পরিয়ে দিল।
নির্দিষ্ট কোন পুরুষ আসেনি সেই অনুষ্ঠানে, দুরাগাম্মাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে। এর বদলে দুরাগাম্মাকে বিয়ে দেয়া হয়েছে মন্দিরের দেবীর সাথে, এবং তার গোটা জীবন এরপর অতিবাহিত হবে দেবদাসী হিসেবে, সে হবে একজন মন্দিরগণিকা। মন্দিরের পুরোহিতের মতে আজকে দেবী উলিগাম্মার আত্মা দুরাগাম্মার ভেতরে প্রবেশ করেছে। এবং তার পরবর্তী জীবনে, যখন মন্দিরের পুরোহিত কিংবা অন্যান্য পুরুষরা তার সাথে রাত কাটাবে, তারা তো দুরাগাম্মা নয় বরং দেবীটির সাথেই যেন রাত্রিযাপন করবে। দেবীর নির্দেশ এই যেন তার সাথে রাত্রিযাপন করা পুরুষটি সন্তুষ্ট হয়।
শুদ্র পরিবারের কমবয়সী বালিকাদের দেবদাসী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এক কর্ণাটকেই রয়েছে এক লক্ষ দেবদাসী, যেখানে দেবদাসীদের এই রীতিটি পালিত হয় ভারতের ছয়টি শহরে। ভারতে শুদ্রদের নেই কোন সম্মান। দেবদাসী হিসেবে নিজের কচি মেয়েটিকে শুদ্র পরিবার মন্দিরের লোলচর্ম ব্রাহ্মণটির নিকট সমর্পিত করে, তার এই কথায় আশ্বস্ত হয়ে যে তার খাহেশ মেটালে শুদ্রটি পরজন্মে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মাবে।
আগের ঘটনায় ফিরে আসি।
অনুষ্ঠানের পর দুরগাম্মার জন্য একজন শয্যাসঙ্গী অপেক্ষমান ছিল। তার বাবা হুলিগাপ্পা যখন তার ছোট মেয়েটিকে নির্দেশনা দিচ্ছিল
সে ভয় পেয়েছিল। তার বাবা তাকে বকা দিয়েছিল এই বলে যে লোকটি দুরগাম্মাকে উপহার হিসেবে দিয়েছে রূপার আংটি, নাকের নোলক, হাতের বালা, কানের দুল, এবং পরনের শাড়িকাপড়। সে লোকটিই হাতে যাচ্ছে দুরগাম্মার সাথে প্রথম রাত্রিযাপন করা ব্যক্তি। এর বদলে মন্দিরের পুরোহিতকে উক্ত শয্যাসঙ্গীর তরফ থেকে কিছু অর্থ প্রদান করা হয়েছে, এবং দুরগাম্মার পরিবারকে দেয়া হয়েছে যাতায়াতের খরচ।
পরের দুইটি বছর দুরগাম্মার সাথে রাত কাটাল লোকটি। তারপর একদিন কিছু না বলে, দুরগাম্মার বাবার বাড়ি থেকে বিদায় নিল সে। এরপর দুরগাম্মার বাবা তার মেয়ের জন্য ২০টির মত শয্যাসঙ্গী যোগাড় করেছে। তাদের স্থায়িত্ব ছিল এক সপ্তাহ থেকে দুই বছর।
যখন আমি দেখি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে কোন মেয়ে তার স্বামীর সাথে হেঁটে যাচ্ছে, তখনি আমার মনে পড়ে আমার কথা, আমার জীবন, আমার ভবিষ্যৎ।
যখন আমার মনের ভিতরে বিষয়গুলো আঘাত করে, তখন কেন জানি আমার কান্না বোধ হয়, বলছিল দুরগাম্মা। ২৫ বছর বয়স হওয়ার কারণে যাকে বিবেচনা করা হতো দেবদাসী হিসেবে অনুপযুক্ত।
দক্ষিণ ভারতে অতীতে যখন বর্বর হিন্দুরাজত্ব কায়েম ছিল, তখন দেবদাসীদের খরচ বহন করতো রাজারা। কিন্তু পরবর্তীতে মুসলিমরা দক্ষিণভারতে সভ্যতার আলো নিয়ে আসলে বন্ধ হয়ে যায় দেবদাসীদের দেয়া রাজকীয় ভাতা। তারপরও ব্রাহ্মণরা এই জঘন্য রীতিটি টিকিয়ে রাখল।
কিন্তু দেবদাসীদের উপার্জনের জন্য তখন গ্রহণ করতে হলো মন্দিরের পুরোহিত বাদে অন্যদের দেহ।
তাই যে লেখাটি থেকে আমি এটি অনুবাদ করেছি, তাতে দেবদাসীদের পতিতাবৃত্তি গ্রহণের জন্য দায়ী করা হয়েছে মুসলমানদের। সব মুসলমানদের দোষ! ভারতীয় ইতিহাসবিদদের নিকট ব্রাহ্মণদের কোন দোষ থাকতে পারে না।
মূল পোষ্টের লিংক
============================================
শুইলে যায় না জাত! :ভারতের মন্দিরগণিকাদের উপাখ্যানঃপর্ব ২
============================================
যদিও মন্দিরগণিকা তথা দেবদাসীরা “অস্পৃশ্য” সম্প্রদায় থেকে আগত, মন্দিরের ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা তাদের সাথে রাত্রিযাপন করতে কোনরূপ দ্বিধাবোধ করে না! দেবদাসীদের অনেকেই আবার থাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক। পুরোহিতরা মূলত গরীব পরিবারের কন্যাদেরকে তাদের লক্ষ্যবস্তু বানায়।
মন্দিরের পুরোহিতরা গরিব বাবা মাকে ফুসলিয়ে থাকে এই বলে যে মন্দিরগণিকা হিসেবে তারা তাদের কন্যাদের উৎসর্গ করলে, ব্রাহ্মণের কামনাকে তুষ্ট করলে তাদের পরজন্মে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মানোর একটি সুযোগ থাকবে। এবং দেবদাসীর বাবা মাকে মন্দিরে প্রবেশের অধিকার দেয়া হয়, যেখানে ভারতবর্ষের “অস্পৃশ্য” সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের নিজ উপসনালয়ে গমনের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত! ফলে পূণ্য অর্জনের আশায় শুদ্র চণ্ডালরা তাদের কচি মেয়েটিকে লোলচর্ম বৃদ্ধ পুরোহিতের বিছানায় তুলে দেয়।
ভারতে ধনীরাও অনেক ক্ষেত্রে গরিবদের শোষণ করে, প্রথমে তাদের ঋণের ফাঁদে ফেলে। এরপর গরিবটির আর কিছু করার না থাকলে সে বাধ্য হয় তার কুমারী মেয়েটিকে টাকার বিনিময়ে বয়স্ক ধনীটির বিছানায় ঠেলে দিতে। অনেক ক্ষেত্রে ধনীরাও টাকা দিয়ে গরিব পরিবারের মেয়েদের ভোগ করে।
ভারতীয় সরকার ১৯৮২ সালে উদযোগ নিয়েছিল এই দেবদাসীপ্রথা বন্ধ করার, যেখানে শাস্তি হিসেবে নির্ধারিত হয়েছিল পাঁচ বছরের জেল এবং ৫০০০ রূপি জরিমানা, কন্যাকে সম্প্রদানকারী পরিবারের জন্য, ব্রাহ্মণের জন্য নয় কিন্তু! তারপরও এই আইন বাস্তবায়ন করাটাও খুব কঠিন। কারণ জেলা শহর থেকে দূরে অজপাঁড়াগায়ে শহুরে আইনের গুরুত্ব খুবই কম। সবচেয়ে বড় কথা, প্রধান শহরের রাজনীতিবিদরাও দেবদাসীদের নিজেদের রক্ষিতা হিসেবে রেখে থাকে অনেকেই। অনেকেই আইন জানে কিন্তু সনাতন কুসংস্কার গোঁড়ামির কারণে ছাড়তে পারে না।
আসলে শুধু কর্ণাটকেই নয়।
গোটা ভারতের চিত্র একই। ওপার বাংলাও খুব ব্যতিক্রম নয়।
ওপার বাংলার সোনাগাছি শুধু কলকাতার নয়, গোটা ভারতেরই সবচেয়ে বড় পতিতালয়গুলোর একটি। অবশ্য ভারতের মুম্বাইয়ের কামাথিপুরা হল গোটাবিশ্বের সবচেয়ে বড় পতিতালয়। কিন্তু সোনাগাছির সুনাম(!) ও কম নয়।
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি বাবু সম্প্রদায় এই অঞ্চলে নিজ নিজ উপপত্নীদের প্রতিপালন করতেন। এই অঞ্চলের বেশ কিছু বাড়ি নির্মিত হয়েছিল ব্রিটিশ যুগে। কথিত আছে প্যারিসের বিখ্যাত যৌনকর্মীরাও কলকাতার এই সোনালি অঞ্চল (Golden district)-এর খ্যাতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)
তথ্যচিত্র বর্ন ইনটু ব্রথেলস ২০০৫ সালে শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র বিভাগে অস্কার জয় করে। এই তথ্যচিত্রে সোনাগাছির যৌনকর্মী-সন্তানদের জীবনযাত্রা চিত্রিত হয়েছে।
অর্থাৎ বাঙালি জমিদারদের গড়া সোনাগাছির সুনাম(!) বিশ্বব্যাপি। কলকাতা যদি পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী হয় তাহলে কলকাতার রাজধানী হল সোনাগাছি!
কলকাতার সানন্দা পত্রিকাটির ব্যাপারে অনেকেই জানেন। এপার ওপার বাংলা মিলিয়ে নারীবাদীদের প্রথম পছন্দের পত্রিকা। পত্রিকাটির সম্পাদক ভারতের মুম্বাইয়ের নামকরা অভিনেত্রী কঙ্কনা সেন শর্মার মা অপর্ণা সেন। সেই পত্রিকায় বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দূর্গাপুজায় গণিকাদের তাৎপর্য নিন্মরূপে তুলে ধরা হয়েছিল।
দূর্গা পুজার সময় দশ ধরনের মাটি প্রয়োজন হয় । তার মধ্যে বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য । বলা হয় বেশ্যারা নাকি পুরুষদের কাম (যৌনতা) নীলকন্ঠের মতো ধারন করে সমাজকে নির্মল রাখে বলে বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা অবশ্য প্রয়োজনীয়। "
এ তথ্যের উৎস হল : সানন্দা ১৮ এপ্রিল ১৯৯১ দেহোপজীবিনী সংখ্যা, শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা "গণিকাবৃত্তি : সমাজ, সংস্কার এবং সমীক্ষা"
আসলে ভারতবর্ষ থেকে গণিকাবৃত্তি দূর করা খুব কঠিন। এ এমনই এক বৃত্তি, কালীদাসের কবিতায় যে বৃত্তির অনুরক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছিল স্বয়ং রাজা বিক্রমাদিত্যকে।
গণিকাবৃত্তি সে দেশে কি করে দূর হবে? যে দেশে ধর্ম ও গণিকাবৃত্তি, একে অপরের পরিপূরক।
মূল পোষ্টের লিংক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।