আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চেতনার সংকট

মানুষের চলাফেরা, খাওয়া দাওয়া, ঘুম জাগরণ, সুখ দুঃখ, চিন্তা ভাবনা, সিদ্ধান্ত প্রভৃতি সকল কার্যাবলী তার মস্তিষ্ক প্রসূত স্নায়ুকার্য ( নিউরোনাল) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। ব্যক্তির জ্ঞানবুদ্ধি (কগনিটিভ) সৃষ্টি সিরিব্রাল করটেক্সে নানা সংকেত প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। বহির্জগতের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ হতে পঞ্চেন্দ্রিয়ের (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা, ত্বক) মাধ্যমে ইন্দ্রিয়ানুভূতি(দর্শন, শ্রবন, ঘ্রাণ, স্বাদ, স্পর্শ) ইনপুট হিসেবে গৃহীত হয়। ইনপুট সমূহ ব্রেণস্টেম ও থ্যালামাসের দ্বারা যাচাই বাছাই হয়ে আরো প্রসেসিং করার জন্য মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশ সমূহে প্রেরিত হয় যেখানে সংকেতগুলো প্রক্রিয়াজাত, সংগঠন, সংরক্ষণ করা হয়। এভাবে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ হতে ইনপুট গ্রহনের মাধ্যমে মানুষের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা তৈরী হয় যা চেতনা সৃষ্টির কাজ করে।

চেতনা সৃষ্টির পর্যায়গুলো হলো— ১। ইন্দ্রিয়ানুভূতি (সেনসেশন) বা সেনসরি বার্তা গ্রহন। ২। বিভিন্ন সেনসরি অনুভূতি পূর্ব অভিজ্ঞতা লব্ধ স্মৃতি(মেমরি) সাথে যাচাই করে ব্রেণের নির্দিষ্ট অংশে নিউরাল কোডভূক্ত(মডুল) করার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ জ্ঞান (পারসেপশন) সৃষ্টি হয়। পারসেপশন বাস্তব জগতের ইন্দ্রিয়ানুভূতি সমূহের নিউরোনাল প্রতীক।

৩। পারসেপশনাল অবগতিকে স্মৃতি(মেমরি), আবেগ(ইমোশন), সংস্পর্শ(এটাচমেন্ট), আত্ম নিয়ন্ত্রণ(সেলফ রেগুলেশন), ব্যক্তি সম্পর্ক ও অভিজ্ঞতা ( ইন্টার পারসোনাল কানেকশন ও সাব্জেকটিভ এক্সপেরিয়েন্স) প্রভৃতির সাথে মিথস্ক্রিয়া করে যে নিউরোনাল প্রতীক সৃষ্টি হয় তাকে মনজগতে সৃষ্ট উচ্চতর বোধ (কনসেপশন) বলে। কনসেপশন বস্তুজগত নির্ভর তবে বস্তুজগত থেকে আলাদা ও মনজগতে সৃষ্ট উচ্চতর বার্তা বাহক। কনসেপচুয়াল নিউরোনাল প্রতীক চিন্তা, বিশ্বাস, উদ্দেশ্য, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, নৈতিকতা, সমাজ ও জীবন দর্শন, ধর্ম বিশ্বাস, জাতিগত ধারণা ইত্যাদি উচ্চতর বিমূর্ত বোধজ্ঞান যাকে সাধারণভাবে চেতনা বলা হয়। অতএব চেতনা মস্তিষ্কের বিশেষ কার্যাবস্থা(মেন্টাল ফাংশনাল স্টেট) যা স্থান, কাল, পাত্র ভেদে পরিবর্তনশীল।

প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে গৃহীত ইনপুটের দ্বারা ও আনুষ্ঠানিক(স্কুল কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা) এবং অনানুষ্ঠানিক( গ্রাম, মহল্লা, কর্মস্থল, সামাজিক মেলামেশা থেকে শিক্ষা) শিক্ষার মাধ্যমে যে সকল অবগতি ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়; সে সকল অভিজ্ঞতা সমূহের নিউরোনাল প্রক্রিয়ায় চেতনার বিবর্তন ও পরিবর্তন সাধিত হয়। পরিবর্তিত ও নতুন চেতনার প্রেক্ষিতে মানুষ জীবনধারণকে সময়োপযোগী করে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিবর্তনের চেষ্টা করে। সুতরাং চেতনার সংকট বা সমস্যা চিরপ্রবহমান যা জীবন সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশ নামক ভূ-খন্ডে জীবন যাপনকারী মানুষেরা ঐতিহাসিকভাবে অনেক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের অধ্যায় পেরিয়ে আজ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অধিবাসী। প্রত্যেক পরিবর্তনের সাথে অধিবাসীদের চেতনার বিক্রিয়া ও পরিবর্তন ঘটেছে।

সুদূর অতীতে না গিয়ে যদি ব্রিটীশ বিরোধী সংগ্রামকে বিবেচনায় নেয়া হয়; তবে দেখা যাবে প্রথম থেকে স্বাধীনতার চেতনা থাকলেও তা ছিল সর্বভারতীয়। জাতিরাষ্ট্র গঠনের চেতনা ছিল না। কিন্তু নানা কারণে শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় বিভাজন কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটো রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা হয়। তবে মৌলিক সত্য হলো পূর্ব বাংলার মুসলমান প্রজা সাধারণের হিন্দু জমিদারদের শোষণ অত্যাচার ও ব্রিটীশদের শাসন নিপীড়নের চেহারা ছিল একই। তারা চেয়েছিল উক্ত শাসন, শোষণ অত্যাচারের অবসান।

ধর্ম সেখানে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়ে ছিল। ৪৭এর পরে পূর্ব বাংলার মানুষ যখন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ও নিপীড়নের শিকার হলো; তখন তারা ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিবেশের কারণে বিশেষ করে ভাষা ও সংস্কৃতির উপর সরাসরি আঘাত করায় ধর্মীয় চেতনাকে পিছনে ফেলে ভাষা ও সংস্কৃতির চেতনাকে ব্যবহার করা হয় সংগ্রামের ঐক্য সৃষ্টিতে। তাই ৪৭ ও ২১এর চেতনা মূলতঃ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার চেতনা। তবে ২১এর চেতনা আরও আধুনিক, সেক্যুলার এবং বাংলাদেশের অধিবাসীদের প্রেক্ষিতে বৃহত্তর ঐক্যের সহায়ক।

ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক চেতনা ধর্মীয় বিভাজনকে দূরে ফেলে বৃহত্তর সেক্যুলার ঐক্য সৃষ্টিতে কাজ করেছিল। ২১এর চেতনার সংগ্রাম ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হলে পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের জীবন ও অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে ধর্মীয় এবং ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর বিভাজন পিছনে ফেলে বৃহত্তর সেক্যুলার ঐক্যবদ্ধভাবে(সেক্যুলার ইউনিটি) যুদ্ধে অংশগ্রহন ছিল চরম বাস্তবতা। কিন্তু মাত্র ৯মাসের যুদ্ধে কোন ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনা দানাবদ্ধ হওয়া সম্ভব ছিল না। ধর্মীয় চেতনা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর চেতনা, ভাষা সংস্কৃতি প্রভৃতির অংগন থেকে বৃহত্তর জাতীয় এবং সেক্যুলার উদার গণতান্ত্রিক চেতনা সৃষ্টি আজ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন; তবে তা সময় সাপেক্ষ। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১ম ভাগ(অনু-৭); ২য় ভাগ(অনু-৮ থেকে অনু-২৫) রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং ৩য় ভাগ(অনু- ২৬ থেকে অনু- ৪৭) মৌলিক অধিকারের বিধিমালা সমূহ আমাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

এর সাথে আরও কয়েকটা আদর্শ ধারণ আমাদের রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্য আবশ্যক। যেমন--- ১। বাংলাদেশের নাগরিকদের নাগরিকত্ব(সিটিজেনশিপ) বাংলাদেশী। ২। বাংলাদেশের নাগরিকদের জাতীয়তা হবে বাংগালী এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব জাতীয়তা।

অর্থাত বাংলাদেশ বহুজাতিক(মাল্টি ন্যাশনাল) রাষ্ট্র। ৩। বাংলাদেশের নাগরিকদের ধর্ম ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সহ অন্যান্য সনাতন ধর্ম সমূহ। অর্থাৎ বাংলাদেশ বহু ধর্মীয় রাষ্ট্র যেখানে প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। ৪।

বাংলাদেশের নাগরিকদের ভাষা বাংলা সহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃ ভাষা এবং সবাই স্বাধীনভাবে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা করবে। উপরোক্ত আদর্শ ও চেতনা সমূহ ধারণ করে এগিয়ে যেতে পারলে বাংলাদেশ সুখী ও শান্তি পূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।