ক্যান্সারে আক্রান্ত জহির বৃহস্পতিবার ব্যাংককের একটি হাসপাতালে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
শুক্রবার দুপুরে তার মরদেহ থাইল্যান্ড থেকে দেশে নিয়ে আসার পর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে তার প্রথম জানাজা হয়। সব দল ও সব মতের প্রতিনিধিরাই সেখানে এসেছিলেন ড. জহিরের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
বিচারক আইনজীবীদের পাশাপাশি রাজনীতিবিদসহ বিভিন্নি শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত হন।
কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন।
বেলা ৩টায় প্রথম জানাজার শেষ হওয়ার পর মরদেহবাহী ভ্যান রওয়ানা হয় ধানমন্ডির বাসার উদ্দেশ্যে। সাড়ে ৩টার পর শেষ বারের মতো বাড়িতে পৌঁছান ড. এম জহির।
সাড়ে ৪টার দিকে পিতা বিচারপতি এম আসিরের গড়ে দেয়া ঠিকানা ছেড়ে লাশবাহী গাড়িটি যায় বাইতুল আমান মসজিদে।
আশপাশের কয়েক মহল্লা মধ্যে সবচেয়ে বড় এই মসজিদেই জুমা পড়তেন ড. জহির।
সোয়া ৫টায় আসরের নামাজের পর এই মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা হয়।
সেখান থেকে পিতার চিরদিনের ঠিকানার উদ্দেশ্যে নেয়া হয় তাকে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার আগেই বনানী কবরস্থানে পিতার কবরে তাকে দাফন করা হয়।
ইংরেজি সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি নেন জহির। পরে লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলএম এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোম্পানি আইন বিষয়ে ১৯৬৫ সালে ডক্টরেট করেন তিনি।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এই আইনজীবীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবেও পেয়েছিলেন।
এম জহিরকে একজন ‘অসাধারণ শিক্ষক’ অভিহিত করে খায়রুল হক বলেন, “১৯৬৬ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন তিনি আমাদের ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স পড়াতেন।
“কোম্পানি আইনে উনার মত দখল আর কারো আছে কি না ছিল কি না আমার জানা নাই। সাংবিধানিক অন্যান্য ইস্যুতেও উনি দক্ষ ছিলেন। ”
জানাজায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, ড. জহির সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করতেন সব সময়।
এ কারণে দল-মত নির্বিশেষ সবার কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলেন।
“বিভিন্ন সময় বিপদে-আপদে আমরা যখন তার সঙ্গে পরামর্শ করেছি, সবসময়ই তার মধ্যে আন্তরিকতা দেখেছি। যে কোনো ক্ষেত্রে তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে মতামত দিতেন। ”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদ বলেন, “উনি কোনো রাজনৈতিক দল করতেন না। এ কারণেই তিনি দেশের যে কোনো সঙ্কটে নিরপেক্ষভাবে মতামত দিতে পারতেন।
দেশের এ রকম সঙ্কটজনক সময়ে তাকে হারানোয় জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হলো। ”
ড. জহির বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বরাবরই সোচ্চার ছিলেন বলে স্মরণ করেন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, “বাহ্যিক দিক দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এলেও আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা এখনো পাইনি। তার মৃত্যুতে এই পথচলা বাধাগ্রস্ত হলো। ”
নিজের ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে দুটি বিষয় তুলে আনেন সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ জমির।
“উনি গান-বাজনা ভালবাসতেন আত্মার শান্তির জন্য। আর বিশ্বাস করতেন টেনিস না খেললে সুস্থ থাকা যায় না।
“উনি আমার ৩০ বছরের টেনিস খেলার পার্টনার ছিলেন। আমি শুধু ভাইকে হারাইনি। আমার পার্টনারকেও হারিয়েছি।
”
জানাজায় দাঁড়িয়ে রীতি অনুযায়ী বাবার জন্য সবার কাছে ক্ষমা চান ছেলে শামস মুনীর।
তিনি বলেন, “আপনারা সবাই উনাকে মাফ করে দেবেন; আর আমার জন্য দোয়া করবেন। আমার আর কিছু বলার নেই। ”
বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন শামস।
বাবার স্মৃতিচারণ করে এম শামস মুনীর বলেন, বাবাকে সর্বাধুনিক চিকিত্সা দিয়েছি।
তিনি সুস্থ্যও হয়ে গিয়েছিলেন। মনে করেছিলাম তিনি ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে। এরপরও ধরে রাখতে পারিনি।
অন্যদের মধ্যে আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী, এবং হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, আব্দুর রব, জেবিএম হাসান নজরুল ইসলাম তালুকদার, মোস্তফা জামান ইসলাম ও এবিএম আলতাফ হোসেন জানাজায় উপস্থিত ছিলেন।
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাইম মোমিনুর রহমান ও শামসুল হুদা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনও জানাজায় উপস্থিত ছিলেন।
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবুল মাল আবদুল মুহিত, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ, আব্দুল মান্নান খান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) হায়দার আকবর খান রনো ও রুহিন হোসেন প্রিন্স।
এছাড়া রোকনউদ্দিন মাহমুদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহোম্মদ আলী, মনসুরুল হক চৌধুরী, মাহবুবউদ্দিন খোকন , ফজলে নূর তাপসসহ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা এম জহিরের জানাজায় অংশ নেন।
জানাজা শেষে ড. জহিরের কফিন তার সাবেক কর্মস্থল সুপ্রিম কোর্ট থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ধানমণ্ডিতে তার নিজের বাসায়। বিকালে ধানমন্ডির বায়তুল আমান জামে মসজিদে হয় দ্বিতীয় জানাজা।
সেখান থেকে এই আইনজীবীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর বনানী কবরস্থানে।
সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন ড. এম জহির।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।