মিসেস রেহেনা (ছদ্মনাম) পেশায় শিক্ষক। একদিন ক্লাসে পড়াতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলেন, একটি শিক্ষার্থী তাঁকে নিয়েই খাতাতে অশ্লীল কথা লিখছে। মাত্র ১৩-১৪ বছরের একটি কিশোরের মনে এত বিকৃতি কী করে এলো, ভেবে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। শিক্ষার্থীটির অভিভাবকদেরকে এই খাতা দেখানো হয় এবং স্কুল থেকে টিসি দিয়ে দেওয়া হয়।
স্কুলের ঐ কিশোরটি তার যৌন বিকৃতির প্রকাশ ঘটিয়েছে তার খাতায়।
যদিও এ ধরনের বিকৃতির পেছনে সে নিজেও দায়ী নয়। খেলার মাঠ কেড়ে নিয়ে শিশু কিশোরদের আমরা অনেক আগেই বন্দী করে দিয়েছি চার দেয়ালের মাঝখানে। প্রাপ্ত বয়ষ্ক হবার আগেই অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানের হাতে তুলে দেন মোবাইল, ল্যাপটপ। কিন্তু সন্তানটি সেগুলোর কতটুকু ব্যবহার করছে আর কতটুকু অপব্যবহার করছে সে খবর রাখেন না। স্কুল-কলেজের অনেক পড়া তৈরিতে শিক্ষার্থীদের নেট ব্যবহার করতে হয়।
ঘরের খুব কাছেই সাইবার ক্যাফেগুলো গড়ে উঠায় নেট খুব সহজলভ্য হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষের কাছে। প্রতিটি ব্যক্তির ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণ বিভিন্ন। কিন্তু ক্যাফেগুলোতে ঘুরে দেখা যায় পর্ন সাইট ব্যবহারের মাত্রাটাই বেশি। দেখা যায় স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় টিন এজাররা সেখানে এসব সাইটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুরুব্বী গোছের অনেকেই হয়ত বলবেন, সব সাইবার ক্যাফে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে ক্যাফে বন্ধ করে দেওয়াটাই তো সমাধান নয়। ক্যাফে ছাড়াও তো পর্নছবির সিডি অত্যন্ত সহজলভ্য। সাইবার ক্যাফে ও সিডি ব্যবসায়ীদের একটি বড় ক্রেতা হল এই টিন এজাররা। তাই ওরা পর্নসাইট বা পর্নছবির সিডি বিক্রি করা বন্ধ করবে না, যতদিন না এ ব্যাপারে আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। তাই সচেতন হতে হবে অভিভাবকদের।
পর্নগ্রাফি দেখার ব্যাপারে টিনএজারদের কৌতুহলী হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এমন কি আজকের এই সময়ে পর্নগ্রাফি দেখাটাও সাধারণ একটা ঘটনা। পর্নগ্রাফি দেখলেই যে আপনার সন্তানটি খারাপ হয়ে গেল, ব্যাপারটি তাও নয়। ‘’দেখা’’ ও ‘’আসক্ত’’ হয়ে যাবার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আসক্ত হয়ে যাওয়া হল, যখন ব্যক্তি এটা ছাড়া আর কোন কিছুই ভাববে না।
ব্যক্তি একটি ফ্যান্টাসির জগতে বাস করতে থাকে, যা বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত নয়। পরবর্তীতে বাস্তব জীবনে সম্পর্ক তৈরি, আবেগিক স্বাস্থ্য, ক্যারিয়ার ইত্যাদিতে এই আসক্তি প্রভাব ফেলে। একসময় ব্যক্তি আর পর্নগ্রাফ দেখেই তৃপ্ত হতে পারে না। বাস্তবেও সে যৌন বিকৃত আচরণগুলো ঈভ টিজিং, ধর্ষণ, শিশু নিগ্রহ (child abuse), ভায়োলেন্স ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ করতে থাকে। তাই পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি মাদকাসক্তির চেয়ে কম ভয়াবহ নয়।
পর্নগ্রাফ দেখেছে কিনা, এ প্রশ্ন আপনার সন্তানকে করার কোন দরকার নেই। কেননা এক্ষেত্রে ওরা কখনোই এটা স্বীকার করবে না। সচেতন অভিভাবক হিসেবে সন্তানের আচরণ দেখে আপনাকে বুঝে নিতে হবে, সে কি সত্যিই আসক্ত কিনা। খেয়াল রাখুন মোবাইল বিল, হাতখরচ হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছে কি না, সন্তানের বন্ধু বান্ধবেরা কেমন, স্কুলের ফলাফল হঠাৎ খারাপ হচ্ছে কিনা, পিসির হিস্ট্রি চেক করে কিছু পাচ্ছেন কিনা। যদি বুঝতে পারেন সন্তানটি পর্নগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে, তাকে কখনোই অভিযোগ বা দোষারোপ করবেন না।
যা করবেনঃ
• পিসিতে এডাল্ট সাইটগুলো ফিল্টার করে রাখুন। পিসি খোলামেলা জায়গায় রাখুন।
• সন্তানকে প্রতিদিন সময় ধরে পিসি ব্যবহার করতে দিন। যেমন- প্রতিদিন দুই ঘন্টা নেট ব্যবহার করতে দেওয়া। এব্যাপারে সন্তানের সাথে আগেই চুক্তি করে নিতে হবে।
• ইন্টারনেট ছাড়া বাস্তব জীবনের অন্যান্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে তাকে আগ্রহী করে তুলুন। ছুটির দিনে তাকে নিয়ে দর্শনীয় স্থানগুলোতে বেড়াতে যেতে পারেন।
• সন্তানকে পর্যাপ্ত খেলতে দিন।
• সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিন। সন্তানের পাশাপাশি তার বন্ধুদের সাথেও সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন।
• সন্তানকে যৌন শিক্ষা দিন। (আমরা পরিবারের সবাই একসাথে মিলে টিভিতে অশ্লীল হিন্দি নাচ-গান দেখতে পারি, অথচ যৌন শিক্ষা নিয়ে কথা বলতে গেলে লজ্জায় মরে যাই! তার চেয়েও বড় কথা যৌন শিক্ষা নিয়ে আমাদের স্পষ্ট কোন ধারণাই নেই। )
• পর্নগ্রাফিতে আসক্ত হলে বাস্তব জীবনে কো্ন সম্পর্ক তৈরিতে কেমন সমস্যা হতে পারে সেসব সম্পর্কে সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন।
আপনার ফুলের মত সন্তানটিকে যেন কোন ঘুনপোকা নিঃশব্দে কুড়ে কুড়ে খেতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে আপনাকেই।
১৪ অক্টোবর, ২০১১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।