বরফ - শীতল © আরফার রাজী [arfar_razi@yahoo.com]
নিঃশব্দ আর্তনাদ
(১)
চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে অয়নের। দোদুল্যমান নৌকার সাথে তাল মিলিয়ে পৃথিবীটাও মনে হচ্ছে এক দুর্বার গতিতে দুলছে। শক্ত হাতে নৌকার গলুইয়ের উপর যে কতক্ষন সে বসে আছে তা মনে করতে পারছে না সে। ছাউনির ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে রাকিব ভাইয়ের দরদী কন্ঠের টান -
''নাচো গো নাচো কালী, নাচো গো
আমার ই বুকে না হয় শিবেরই বুকে
নাচো গো, নাচো গো...''
প্রথম পর্বের গঞ্জিকাসেবন পর্ব শেষ করলো তারা। উদাসী দৃষ্টিতে অয়ন তাকিয়ে আছে বিলের টলমল রূপালী পানির দিকে; ভয়ঙ্কর সুন্দর, যেন গ্রাস করবে এখনই।
হাতছানি দিয়ে ডাকছে যেন। পিটপিট করে ঘড়ির দিকে তাকালো অয়ন। রাত এগারটা। ঘুরেফিরে বারবার বিকেলের কথাই মনে হচ্ছে তার। আকস্মিক সুন্দর কি বলা যায়? সুন্দর হলে তবে তীর কেনই বা বুকে এসে বিধঁবে? অমন দৃশ্যের মুখোমুখী কেনই বা সে হলো? ভাবে অয়ন।
অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে যেন মাথার কোথাও। লিকলিকিয়ে ওঠা হিংস্র স্মৃতিদেহ ক্রমাগত তাড়া করে ফিরে তাকে। শুধুই। নৌকার তলদেশে আছড়ে পড়া ঢেউ যেন কোন অশরীরি হিংস্র থাবা। হঠাৎ রাকিব ভাইয়ের উদ্ধত কন্ঠ।
হাঁক ছেড়ে ডাকে সে।
- ঐ ব্যাটা, ভিত্রে আয়। এইবার চল্বো নিমাই। যন্ত্রণা সব ভুইলা যাবি। আয়।
ছাউনির একপাশ হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে ভিতরে এসে বসে অয়ন। একাগ্র চিত্তে রাকিব ভাইয়ের একাগ্রতার নমুনা দেখছে সে। পরম যত্নে প্রতিটা সিগারেট কে তামাক ভরমুক্ত করা, পাশে রাখা কাগজের টুকরার উপর ঝুরঝুরে তামাকের নিবিষ্ট সন্নিবেশ করা, মুড়িয়ে রাখা কোনো কাগজের অভ্যন্তরীন জিনসটাকে কাঁচি দিয়ে কেটে টুকরা টুকরা করা, নির্দিষ্ট অনুপাতের সংমিশ্রণ, তারপর আবার নিবিড়ভাবে ফাঁপা ঐ সিগারেটের খোলের ভেতর ঢুকানো - প্রতিটা কাজেই লোকটার কি নিবিষ্ট মনোযোগ। ভাবে অয়ন। সে-ও তো মনোযোগীই ছিল সব ব্যাপারেই; সুন্দর ভবিষ্যতের আল্পনা এঁকে রেখেছিল মনের দৃশ্যপটে।
নাহ্, এই নগ্ন প্রতারনার কোনো মানেই হয় না। কপালের শিরা গুলো দপ দপ করছে তার।
- নে, ধরা। বলে একটা স্টিক অয়নের দিকে বাড়িয়ে দিল রাকিব ভাই। মনে থাকে যেন্, নিমাই চল্বো কিন্তুক, নিমাই।
নিমাই পর্ব শেষ করে কিছুক্ষন ঝিম মেরে বসে রইল দুজনই। এটাকেই কি ভরমুক্ত বলে? ভাবে অয়ন। মনে হচ্ছে, অসংখ্য সে - একটার পর একটা যেন ঠিকরে বের হয়ে যাচ্ছে ভেতর থেকে। নিজেকে এক স্তুপ বালুর মতো মনে হচ্ছে তার। ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে বালুকণা তার দেহ থেকে।
শুধুমাত্র ঐ প্রতারিত আত্মাটাই বাকি পড়ে আছে এই নৌকার ছাউনির ভেতর - এই রাত দুপুরে।
টলতে টলতে অয়ন নৌকার ছাউনির উপড় উঠে বসে। অথৈ সমুদ্রের মাঝে সে? জায়গাটা চিনতে তার খুব অসুবিধা হয় হঠাৎ। দূর, ঐ দূরে ছিটেফোঁটা আলোর নিশাণ দেখা যাচ্ছে। তাহলে অথৈ দরিয়ার মাঝে নয় সে, হয়তো কোন নদী কিংবা বিলের পানিতে ভাসছে সে - কিছুটা স্বস্তি পায় অয়ন।
শুয়ে পড়ে সে ছাউনির উপর।
উপরের আকাশটাকে বেজায় হাস্যোজ্জ্বল দেখাচ্ছে আজ। তারার ডালি সাজিয়ে বসে আছে যেন - মধ্যমণি ঐ চাঁদ। নিচ থেকে আবার ভেসে আসে রাকিব ভাইয়ের গলা-
''আমি একটা জিন্দা লাশ,
কাটিস না রে জংলার বাঁশ,
আমার লাইগা সারে তিন হাত কবর খুঁড়িস না....
আমি পিরিতের অনলের পোড়া
মরার পরে আমায় পুড়িস না;
তোরা মরার পরে আমায় পুড়িস না...''
ডুকরে কেঁদে উঠে অয়ন। সামনে ভেসে উঠে সারা-র নিস্পাপ মুখ।
ঐ কচি মুখ দু হাতে আকড়ে ধরে কতোই না তারা বলেছিল তাদের স্বপ্নের কথা। কোমল দুটি হাত ধরে কতোই না বুনেছিল আশা, কতো পরিকল্পনা। শান্ত, নিরব আখিঁপটে এক বিশাল সমুদ্রের দৃশ্যপট অঙ্কন করতো প্রতিনিয়তই। সব কিছুই হঠাৎ খুবই অর্থহীন মনে হতে থাকে অয়নের। প্রতারণার সূক্ষ্ম আঁচটা আগেই ধরা উচিৎ ছিল তার।
প্রতারণাই যদি হবে তাহলে এত স্বপ্ন বোনা কিসের, কিসের এত মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া - ভেবে পায় না অয়ন।
উপরের ঐ আকাশের মতোই তো আজ হাস্যোজ্জ্বল ছিল সে। সারাটাদিনই তো টুটুলের সাথে এখানে ওখানে ঘুরেছে। সারাকে একটা সারপ্রাইজ ও দিতে চেয়েছে - তার ভালো একটা চাকরি হাওয়ার খবরটা দিয়ে। হুট করেই তাদের সামনে চলে আসে গাড়িটা।
ভেতর থেকে বের হয়ে আসে থলথলে শরীরের এক বুড়া, তার সাথে আবার ২১-২২ বছরের এক তরুণী - খিলখিলিয়ে ক্রমাগত হাসতে থাকা বুড়ার হাত আবার সোজা তরুণীর কোমরে প্যাঁচানো। শিঁস দেবার মতো শব্দ করে টুটুল সাথে সাথেই অয়নকে ডেকে বলে,
- দোস্ত, কর্পোরেট মাগি দ্যাখ, কর্পোরেট মাগি।
মেয়েটাকে চিনতে অয়নের একদমই কষ্ট হয় না। এ তো তার সারাই ছিল, যে তাকে বলেছিল ভালোবাসার কথা। এতটুকু খুঁত তো ছিল না তার নিজের ভালোবাসাতেও।
আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন হতে শুরু করল হঠাৎ। তার সাথে একাগ্রতা প্রকাশ করতেই কি হাস্যোজ্জ্বল আকাশের অমন কান্নার প্রস্তুতি? আনমনে ভাবতে ভাবতে অয়ন ডুবে যায় কোন এক অদ্ভুত জগতে, জরাজীর্ণতার ঠাঁই নেই যেখানে একদম-ই। মাথায় বাজতে থাকে কোন অতিপরিচিত গানের কথা, ধরতে পারে না অয়ন কিন্তু ঢুকে যায় সে ক্রমান্বয়ে..
...My head grew heavy, and my sight grew dim
I had to stop for the night
There she stood in the doorway
I heard the mission bell
And I was thinking to myself
This could be Heaven or this could be Hell
Then she lit up a candle
And she showed me the way
There were voices down the corridor
I thought I heard them say...
(২)
রাত দুটা বাজার টিক টিক শব্দ কানে এলো সারার। বাইরে বৃষ্টিতে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে।
আজ অয়নকেই দেখল না তো সে? বিকেল থেকেই এই চিন্তাটা মাথায় ঘুরাঘুরি করেই যাচ্ছে।
ভালো একটা পার্টি পাওয়া গিয়েছিল আজ সকালে। সকালেই আনিস ভাইয়ের ফোন পেয়েই ইউনিভার্সিটিতে যাবে না বলে ঠিক করে ফেলল সে। আনিস ভাই অফিস থেকে গাড়ি পাঠালেন সাথে সাথেই, কাজটা যেভাবেই হোক হাসিল করানো লাগবেই- অনেক টাকার মামলা। তারপর থেকেই সারার এই পার্টির সাথে সকাল থেকেই ঘুরাঘুরি। আনিস ভাইয়ের কাজটা এতক্ষনে হয়ে গেছে নিশ্চই।
উটকো ঝামেলা হলো ঐ বুড়োর সাথে রাত কাটানো। বুড়ো ১২টায়ই দম ফুরিয়ে বেহুঁশ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।
হঠাৎ অয়নের কথা মনে হলো সারার। নিস্পাপ ঐ চেহারার কথাটা মনে হলেই তার অন্যরকম ভালো লাগা শুরু হয়। নিজেকে খুবই ভাগ্যবতী মনে হয় তার।
উজাড় করা ভালবাসা পেয়েছে সে অয়নের কাছ থেকে। সে নিজেও তো তাকে কম ভালবাসে না। তার যত যা উপার্জন, তা তো দু'জন মিলেই খরচ করে। অনেকটা চাপ অন্তত অয়নের মাথা থেকে সে মুক্তি দিতে পেরেছে।
মাঝে মাঝে খুব পাপবোধ হয় তার এইধরনের শহুরে প্রস্টিটিউশনের জন্য।
আবার ভাবে, ছেড়েই তো দিবে, অয়নের চাকরিটা হলেই সব ছেড়ে দিবে সে। কোনো গ্লানি, বা অপরাধবোধ থেকে যে সে এই পথে আসে নি, এটা যেমন সত্য, তেমনি খুবই মাঝে মাঝে এই অপরাধবোধের তাড়া তাকে চরমভাবে খেতে হয়, এটাও সত্য। মাঝে মাঝে কিছু উটকো ঝামেলাও এসে ভর করে। যেমন, প্রায় প্রতি রাতেই তার অফিসিয়াল নাম্বারে ফোন আসে আজব কিছু কম বয়েসী ছেলেদের,
- আপা, আপনি নাকি কলগার্ল? আপ্নের রেট কত?
খুব ভালো ভাবেই এদেরকে ম্যানেজ করতে শিখে গিয়েছে সারা। কারা যে এই নাম্বার লিক করে কে জানে!
বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সারা।
কাল অয়নের সাথে দেখা করার কথা। সকাল সকাল বাসায় ফিরেই অয়নের প্রিয় লাল রঙের একটা কামিজ পড়ে বের হবে ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে। বুড়ার কাছে অয়নের জন্য একটা ভালো চাকরির ব্যাপারেও কথা বলে রেখেছে সে। কতোই না খুশী হবে ছেলেটা, ভাবতেই ভালো লাগে সারার।
জানালার গ্রিলের ভেতর দিয়ে হাত বের করে দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধরতে চেষ্টা করে সারা।
হঠাৎ তার মনে হয়, অয়নকে সে ঠকাচ্ছে না তো? নাহ্। কেন ঠকাবে? সে-ও যে ভালবাসে তাকে, নিরেট এবং নিখাঁদ। আনমনেই দু'চোখ বেয়ে অঝোরে পানি বের হয়ে আসে সারার।
(ছবি : ইন্টারনেট)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।