আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিঃশব্দ নিনাদ

এই ব্লগের কোন লেখা আমার অনুমতি ব্যতীত কোথাও ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি

মূহুর্তগুলো ভীষণ দীর্ঘ হয়ে উঠেছে আজকাল, যেনো ধারালো ক্ষুরের ফলার উপর দিয়ে অতি সন্তর্পণে বয়ে চলেছে সময়ের সহস্র ভগ্নাংশ, শেষ হতে চাইছে না কিছুতেই, নিরবধি ভেসে থাকতে চাইছে আমার এই মূল্যহীন জীবনস্রোতে। জীবনটাকে যত সংক্ষিপ্ত ভেবেছিলাম, জীবন আসলে ততটা সংক্ষিপ্ত নয়, জীবন অর্বুদ বৃন্দ দীর্ঘশ্বাসের সীমায় বাঁধা এক একটি মূহুর্তের নৃশংস সমাকলন। যখন ছোট্ট ছিলাম, দীর্ঘশ্বাসগুলো ছোট ছিল; যত বড় হচ্ছি, ঘূর্ণিঝড়ের মতো শক্তিশালী হচ্ছে দীর্ঘশ্বাসগুলোও, বড় হচ্ছে প্রতিনিয়ত, যেমন বড় হচ্ছে স্বপ্ন, মূল্যবোধ এবং স্বাধীনতার প্রাচীর । দাঁড়িয়ে আছি এখন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে, রক্তে টগবগ করছে তারুণ্যের মাদকতা, অমিত সম্ভাবনাময় যৌবন, উচ্ছল আগামীর প্রতিজ্ঞা; অথচ জীবন আমার কাছে কী নিরর্থকই না হয়ে উঠেছে। এতোটা অর্থহীন জীবন চাইনি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে, যাপন করতে চেয়েছিলাম জীবনকে, কিছুটা যাপন করেছিলামও, কিন্তু তারপর আর যাপন করিনি, করতে পারিনি, জীবনকে সুদীর্ঘকাল শুধু ধারণ করে চলেছি।

জীবনযাপনের শেষ পর্যায়টি ছিল আমার দুরন্ত ডানপিটে কৈশোর, কৈশোরের শেষ চৈত্রে আমি শেষবারের মতো জীবনযাপন করেছিলাম। যাপিত জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটি আমি নিয়েছিলাম তোমাকে দেখার আগের মূহুর্তটিতে, কৈশোরের শেষ চৈত্রে; তোমাকে দেখার অই মূহুর্তে কেউ নিঃশ্বাস নিতে পারে না, আমিও পারিনি, নিঃশ্বাস বন্ধ করে তোমাকে দেখেছি এক ঝলক। সামান্য দৌড়ে চলে গিয়েছিলে তুমি, বেশিক্ষণ ছিলে না সেই ঝড়ো সন্ধ্যায়, তোমার সুবাস ছড়িয়ে ছিল লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আমার পৃথিবী জুড়ে, ছিল প্রায় অন্ধকার, হলদে আকাশে ইতস্তত মেঘ, কয়েকফোঁটা বৃষ্টি, এবং অই বৃষ্টিমেঘের গম্ভীর শব্দের মাঝে মহাকাল জুড়ে ছিল তোমার নূপুরের অপার্থিব ধ্বনি। তুমি চলে যাওয়ার পর আমি আবার নিঃশ্বাস নেই, আমার জীবনধারণের প্রথম নিঃশ্বাস, আমার প্রথম বিশুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস! এরপর থেকে আমার দীর্ঘশ্বাসগুলো বড় হতে থাকে, আমি বড় হতে থাকি, আমার পৃথিবী বড় হতে থাকে, আমার স্বপ্নগুলো বড় হতে থাকে, ব্যর্থতাগুলো বড় হতে থাকে, ক্রমাগত আমি ধারণ করতে থাকি জীবনকে। জীবনযাপন আর জীবনধারণের মাঝে সূক্ষ্ণ পার্থক্য আমি অনুধাবন করি খুব দ্রুত, কৈশোর শেষ হওয়ার সাথে সাথে, অনুধাবন করি আরও অনেক কিছু যা আমাকে কিশোর থেকে পুরুষ করে তোলে।

আমি আর দুরন্ত থাকিনি এরপর, আমি বিষণ্ন হয়ে যাই, আমি উদভ্রান্ত হয়ে যাই, আমি একাই ছিলাম সবসময়- তবু নতুন করে নিঃসঙ্গ হয়ে যাই। এরপর আমি হাঁটতে থাকি আমার প্রিয় শহরের অচেনা অলিতে-গলিতে, হাঁটতে থাকি পৃথিবীর সবকটি তপ্ত সাহারায়, সবগুলো আল্পসের বিপদসঙ্কুল গিরিখাত আর উপত্যকায়, ভাসতে থাকি সবগুলো মহাসাগরে, হারাতে থাকি সবগুলো ভীষণ অরণ্যে, আমার শান্ত চোখ তখন আর আগের মতো স্থির থাকে না, উদভ্রান্ত হয়ে পড়ে; খুঁজতে থাকে তোমার অই বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ মুখায়ব, স্বৈর্গিক অদ্ভূত আলোর মিছিলের এক অসামান্য প্রভা, পূর্ণিমার জোৎস্নাবর্ণের এক অপ্সরীকে, এক দেবীকে-তোমাকে। তারপর একদিন আমি তোমাকে পাই, তোমার খোলা চুল থেকে ভেসে আসে সেই অদ্ভূত সুবাস, যা আমি দুটি দীর্ঘ বছর ধরে খুঁজেছি। তোমার নূপুর আমি দেখতে পাই না, কিন্তু আমার কাছে সেই শব্দ তোমার পেলব পদক্ষেপ থেকে পৌঁছে যায়। আমি তোমার কাছে যেতে থাকি, প্রতিদিনই, আমি তোমার আরও কাছে আসতে চাই, তোমার অনুমতি আমার দু'বছরের শুষ্ক সাহারাগুলোকে সবুজ সজীব শস্যক্ষেত করে তুলে, আমি আরও কাছে আসি তোমার, এবং ধীরে ধীরে আরও কাছে আসি।

আমরা আরও অনেক বেশি কাছে আসতে চাই, যতটা কাছে কেউ কখনও আসেনি। ধীরে ধীরে আমার সাহারা হারিয়ে যায়, আমার আল্পস হারিয়ে যায়, আমার নির্জনতা হারিয়ে যায়, তোমাকে আমার গোটা পৃথিবী খুঁজেও আমি নির্জনতা এনে দিতে পারি না যেখানে আমরা কাছে আসতে পারি। একদিন নির্জনতা পাওয়া যায় সাময়িকভাবে, আমরা কাছে আসি, আমরা অনুভব করি দু'বছরে তুমি নারী হয়ে উঠেছ এবং আমি পুরুষ হয়ে উঠেছি। আমরা এরপর আর অনুভব করি না কিছুই, আমরা উন্মত্ত হয়ে উঠি, আমরা আদিম হয়ে উঠি, আমরা হিংস্র হয়ে উঠি, আমরা নির্মম হয়ে উঠি পরবর্তী কয়েক খর্ব-নিখর্ব কাল। আমরা ক্লান্ত হয়ে উঠি প্রচন্ডভাবে।

আমার বিষণ্নতা হারিয়ে যায়, দীর্ঘশ্বাস থাকেনা কিছুদিন, আমার আনন্দ থাকে, উচ্ছাস থাকে, বেঁচে থাকা আমার কাছে তীব্র সুখের মনে হয়, আমি প্রতিদিন আরও বেশি করে পুরুষ হয়ে উঠি। একসময় খুব দ্রুত তুমি চলে যাও, হারিয়ে যাও আমার পৃথিবী থেকে, যেতে বাধ্য হও, আমি কিছুই করতে পারি না, আমার সাহারাগুলো আবার অনন্ত মরুভূমি হয়ে ফিরে আসে, আমি সেই তপ্ত মরুতে অস্ফূট গগনবিদারী চিৎকারে বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠি। তোমার বিষাদ, তোমার অশ্রু, তোমার আর্দ্র কাজল আমাকে বুঝিয়ে দেয় আমি পুরোপুরি পুরুষ হইনি, বুঝিয়ে দেয় আমার অনেক কিছুই নেই, নেই পুরুষ হওয়ার জন্যে যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি প্রথমে অবাক হই, বিস্মিত হই, এরপর কষ্ট পাই এবং খুব দ্রুতই বুঝতে পারি মুদ্রাস্ফীতির এই দেশে কেউ পুরোপুরি পুরুষ হয় না। তারপর আমি আর চেষ্টা করি না পুরুষ হওয়ার, আমার বয়সের সঙ্গে বেড়ে চলে মুদ্রাস্ফীতি, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকি, সেই নিরন্তর দীর্ঘশ্বাস বেড়ে চলে অবিরাম, আমার জীবন একাকীত্বের অভিশাপে পূর্ণ হয়ে উঠে, আমি নিঃসঙ্গতায় মরে যেতে থাকি প্রতিদিন এবং আমি ক্লান্ত হয়ে উঠি ভীষণ, জীবন আমার কাছে নিরর্থক এক আবর্জনাস্তূপ হয়ে উঠে।

দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠে মূহুর্তগুলো, নষ্ট স্বপ্নগুলো কুপির শিখার মতো প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে সামান্য জ্বলে থাকার, অথচ আমি ব্যর্থ হয়ে উঠি সম্পূর্ণ। আমি এখন সুদীর্ঘ মূহুর্তগুলোতে ধারণ করছি জীবনকে বোঝার মতো, ধারণ করতে থাকব অনন্তকাল, কারণ মৃত্যু আর নেই আমার, আসবে না জীবনে আর কখনও; মৃত্যু একবারই আসে, সেটা চলে এসেছে আমার জীবনে, জীবনের স্রোতধারা আর কখনোই খুঁজে পাব না আমি। আমার হতাশ, বিধ্বস্ত, উন্মূল মূহুর্তগুলো ভীষণ দীর্ঘ হয়ে উঠেছে তোমার অভাবে, আমার পৌরুষত্বের অভাবে, মহাকাল জুড়ে যাপিত জীবনের অভাবে। আমি অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে আছি বাইরের নিকষ অন্ধকারে, আমার নিষ্প্রাণতায়, আমার অলস সময়ে, আমার কিছুই এখন করার নেই, কারণ, আমার অপরূপ জোৎস্নাময় নিষ্কলঙ্ক চাঁদ ডুবে গেছে বহুক্ষণ আগে। আজকাল প্রায়ই চুপচাপ শহীদ মিনারে বসে থাকি গভীর রাতে, সম্পূর্ণ ক্যাম্পাস যখন নিঃস্তব্ধ।

নির্জনতারও এক ধরণের কোলাহল আছে, সেটাই উপভোগ করি। শীত কমে গেছে, তাই কপোলে অশ্রুর শীতল ছোঁয়ায় ঈষৎ শিউরে উঠি না আর। মাঝে মাঝে একটা সিগারেট ধরাই, অনুভব করি আমার মতো আরও একজনকে, পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হচ্ছে। সিগারেট পুড়ে গেলে শেষ হয়ে যায়, আমি নতুন করে পুড়তে থাকি। তখন গভীর ঘুমে মগ্ন থাকে আমার পৃথিবী, আমার বিশ্ববিদ্যালয়, নির্জন পথ, সুবিশাল বৃক্ষরাজি এবং নিরন্তর নৈশ প্রহরীর মতো ক্লান্ত পাহাড়।

হঠাৎ খুব অসহ্য লাগে সবকিছু, মনে হয় মহাজগতের সব সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, আর্তনাদ করছে গভীর নিনাদে, ডাকছে আমাকে অই ধ্বংসলীলায় অংশ নিতে, আমাকেও শেষ করে দিতে চাইছে, চূর্ণ করে দিতে চাইছে। একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছি, এখন আঘাত আসলে আমি আর কখনোই দাঁড়াতে পারব না, সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ব, যতটুকু বিশ্বাস আছে সবটুকু নিঃশেষ হয়ে যাবে একেবারে, অবশেষটুকুও বিলীন হয়ে যাবে। অনেক দিন আমি বৃষ্টি দেখিনি, অনেকদিন আমি পাখিদের কোলাহলে আনমনা হইনি, অনেকদিন আমি রোমন্থন করিনি বহু সুখকর স্মৃতি, অনেকদিন আমি খুঁজে পাইনি আমাকে, অনেকদিন আমি নিশাচর হয়ে আছি। অনেকদিন আমি নির্জন রাতে হাঁটি আমার ছোট্ট ঘরের বাইরের প্রশস্ত বারান্দায়, আমার অসংখ্য অন্ধগলিতে; আমি মনের অন্ধকার অংশের অচেনা অনুভূতিগুলোকে বিচিত্র আবেগে তুলে এনে অনেকক্ষণ ধরে বোধ করি, ওরা আমার নিঃসঙ্গতাকে ব্যঙ্গ করে, ওরা অশ্লীল হয়ে উঠে আমার প্রতি, ওরা ভয়ানক হিংস্র হাসি হাসে আমার একাকীত্ব দেখে, আমি সহ্য করতে পারি অনেকটা সময়, এবং একসময় আমি আর পারি না, আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠি, আমি হাহাকার করে উঠি সহস্র বছর ধরে, আমি দু'হাতে মাথা চেপে বসে থাকি অগুনতি অজস্র মূহুর্ত, আমি চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে চাই, কিন্তু আমি আরও বেশি অক্ষম হয়ে উঠি, আমার সমস্ত শুভ বোধ বিবস্ত্র বালিকার মতো কুঁকড়ে উঠে আতঙ্কে। একসময় ঘরে ফিরে আসি, চারপাশে তাকাই, একরাশ চেনা পরিবেশ স্মিত হেসে আমার দুর্দশাকে ক্লান্ত পদক্ষেপে প্রদক্ষিণ করে চলে।

আর অল্প কিছুদিন, আমি নিজেকেই বলি, তারপর আর থাকব না এখানে, যেমন ছিলাম না এখানে জীবনের অনেকগুলো মূহুর্ত। এই থাকা আর না থাকার মাঝখানে অস্পষ্ট ধোঁয়াশার মতো পাক খেয়ে চলে কিছু সময় এবং অসময় এবং তারা আমাকে নিজের কাছে অনেক অচেনা করে তোলে। মুক্তি আসছে, আসছে স্বাধীনতা, আর মাত্র কয়েকটি ঋতু, একটি বসন্ত, একটি গ্রীষ্ম, একটি বর্ষা, একটি শরৎ এবং হয়তো একটি শীত। আমি হারিনি হেরে যাওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত, আমি অসীম সাহসিকতায় লড়াই করেছি অনেকগুলো বছর এবং এখন ক্লান্ত, বুড়ো সৈনিক হয়ে গেছি। মুক্তির প্রতীক্ষা বড় আনন্দের, কিন্তু এটা মানুষের বয়সকে এক ধাক্কায় অনেক বাড়িয়ে দেয়।

এখন বসন্ত, সম্ভবত এটাই শেষ বসন্ত এখানে, শেষবারের মতো আবার দেখতে চাই কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়ার আগুন রাঙ্গা শোভা, আবার উপভোগ করতে চাই পলাশ-শিমুলের আলো, শেষরাতে জানালার ফাঁক গলে আসা একচিলতে হিমশীতল বাতাসে আর একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই এবং গোপন করতে চাই যত অপূর্ণতা গভীর, গোপন, মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাসে; ভোরের নরোম আলোয় নাম না জানা পাখির বিস্মিত নয়নে আমি পৃথিবীকে আরও কিছুদিন দেখতে চাই- অথচ আমি জানি, এখনই শেষ সময়। জীবনের যেই শক্তির জন্যে এতোটা পথ অবিশ্রান্ত চলে এসেছি, যেটুকু বাধা দিয়ে রেখেছিল সকল কামনা, ব্যর্থতা আর স্বাধীনতার সুখ, ওরা আজ গোধূলীলগ্নে এসে পৌঁছেছে। হয়তো পারব, হয়তো পারব না, আজকাল আর কিছুই ভাবি না। যাক না যেমন চলে যাচ্ছে সব দিনরাত্রিগুলো, আসুক যেভাবে খুশি কালবোশেখী ঝড় তার সমস্ত শক্তি নিয়ে, আমি উদ্বিগ্ন নই আর; আমি এখন বড় ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ, পরিত্যক্ত, বিপুল সম্ভাবনাময় একরাশ স্বপ্নের স্তিমিত স্পন্দন, আমি এখন হার না মানা পরাজিত নিরর্থক আবেগের এক সুবিশাল ধ্বংসস্তূপ, আমি এখন অনুভূতিহীন এমন অনেক কিছু যার কোনও প্রকাশ নেই। আমি ধ্বংসের অপেক্ষায় ন্যুব্জ হয়ে থাকা অনন্ত জীর্ণ মহাকাল।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।