দুবাই শহরের মসজিদ ও নামাজী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
দুবাই মেইন শহরের বারডুবাই এলাকায় কাটালাম একদিন। ৩১ জুলাই শুক্রবার। আগেই বলা হয়েছে বারডুবাই এর খালেদ বিন ওয়ালিদ (রাযি রোডের হোটেল সী-শেল ইন্টারন্যাশনালে উঠেছিলাম আমরা। ৩১ তারিখ জুমআর নামাজ আদায় করতে বেরুলাম। এই প্রথম গরমের তীব্র দাবদাহ অনুভব করলাম।
তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস! ভাবলাম এই গরমে মানুষ বাঁচে কী করে আল্লাই জানে।
এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, আমি আমার দেখা আমিরাতকেই বর্ণনা করছি। আমি দাবি করবো না আমি নির্ভুলভাবেই সেখানকার ধর্মীয় ও সামাজিক কালচার তুলে ধরতে পারবো বা পারছি। আমি আমার দেখা ছয় দিনকেই ব্যাখ্যা করছি। হতে পারে আমার দেখা চিত্র সামগ্রিক চিত্র নয়।
হতে পারে এগুলো কিছু খণ্ড চিত্র। হতে পারে বাস্তবতা স্বস্থিকর।
মসজিদে প্রবেশ করে মন ভাল হয়ে গেল। চমৎকার মসজিদ। আমিরাত সম্বন্ধে যাদের একেবারেই ধারণা নেই, তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, সেদেশের শতকরা একশভাগ মসজিদই সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশন্ড এবং কার্পেটিং করা।
মসজিদ ভর্তি মুসল্লি। একটি মুসলিম দেশের মতই পরিবেশ। তবে নামাজীদের অবস্থা খুব করুণ!
আমাদের দেশে যারা পায়ের ঘন্টার নিচে প্যান্ট-পাজামা-লুঙ্গি পরেন, তাদেরও দেখেছি নামাজে দাঁড়ালে প্যান্ট পাজামা ভাজ করে উপরে তুলেন। লুঙ্গির গিট্ট খুলে একটু উপরে তুলেন। ইসলাম ধর্মের ভেতরগত ব্যাপার-স্যাপার সম্বন্ধে যাদের ধারণা আছে, তারা জানেন, ইসলামে মাজহাব বলে একটা ব্যাপার আছে।
মাজহাব মোট চারটি। হানাফী, শাফেয়ী, মালিকী ও হাম্বলি। চার মাজহাবের রয়েছেন চারজন ইমাম বা নীতি নির্ধারক বা পথ প্রদর্শক। তাদের সকলের উদ্দেশ্য ও কাজ এক হলেও কর্মপন্থা ভিন্ন। একটি পরিচিত উদাহরণ দিচ্ছি যার সাথে বাংলাদেশের অনেক বাঙালির পরিচয় রয়েছে।
জামাতে নামাজ পড়লে ইমাম সাহেব সুরায়ে ফাতিহা তেলাওয়াত করার পর মুসল্লিদের আমিন বলতে হয়। এই আমিন বলা নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। মতানৈক্য হল আমিন বলার পদ্ধতি নিয়ে। আমরা বাংলাদেশী মুসলমানরা যার অনুসরণ করি, সেই ইমাম আবু হানিফা (রা’র মতে, মুসল্লিরা আমিন বলবে মনে মনে, নি:শব্দে। অধিকাংশ আরব বিশ্বের মুসলমানরা অনুস্মরণ করেন ইমাম মালিক ও শাফেয়ী (রা কে।
উনাদের মতে আমিন বলতে হবে স্ব-শব্দে, চিৎকার করে।
তবে আরো অনেক মাসআ’লার মত ঘন্টার নিচে কাপড় পরার মাসআ’লায় চার মাজহাবের প্রত্যেক ইমামই পোষণ করেছেন। বিশ্বনবী (সাঃ) বলে গেছেন, “ওয়াইলুল্লিল আ’ক্বাবি মিনান নার”। সারমর্ম হচ্ছে, (পুরুষদের ক্ষেত্রে) ঘন্টার যতটুকু নিচে কাপড় পরা হবে, (হোক নামাজের ভেতরে বা বাইরে) ততটুকু অংশ জাহান্নামের আগুনে পোড়ানো হবে। এই হাদীসের প্রতি লক্ষ্য রেখে চার ইমামই বলেছেন, “পায়ের ঘণ্টার নিচে কাপড় পরা হারাম।
’
অথচ আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলাম, দুবাইসহ আমিরাতের যত মসজিদে নামাজ আদায়ের সুযোগ হয়েছিল, প্রত্যেক মসজিদেই শেখেরা, আরবীরা লম্বা সাদা আলখেল্লা (তাদের ভাষায় তুব) পরেছেন ঘন্টার অনেক নিচে। মহিলাদের শাড়ী ও বোরকার মত মাটি পর্যন্ত ঝুলিয়ে। ফরজ ও হারামের মিশ্রণে তাদের নামাজের অবস্থা যে কী হচ্ছে, সেটা বুঝতে ইমাম গাজ্জালী হতে হয় না।
আমি দেখলাম তারা মসজিদে কোরআন তেলাওয়াত করছেন পদ্ধাসনের মত বসে কোলে এবং পায়ের উপরে কোরআন মজীদ রেখে। ইমাম সাহেবরাও সেটা নিয়ে কিছু বলছেন না।
অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে তারা ওখানে গিয়ে একটা ইমামতি যোগাড় করেছেন। বাংলাদেশে, পাকিস্তানে, ইয়েমেনে, মিশরে তাঁরা তাদের নিজ নিজ দেশের পরিবার পরিজনের অনেক আশা-আকাঙ্খার প্রতিনিধিত্ব করছেন। ভুল শুধরে দিতে গিয়ে চাকরী খোয়ানোর ঝুঁকিটি কেউই নিতে চাইছেন না।
আমাকে সব’চে বেশি অবাক করলো নামাজে তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ব্যাপারটি। আরবী ভদ্রলোক নামাজ পড়তে দাড়িয়েছেন।
দ্বিতীয় রাকাত চলছে। পকেটে সাইলেন্ট মোডে রাখা মোবাইল ফোন কেঁপে উঠছে। ভাইব্রেশন এলার্ট করা। কোনো রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করে বলছেন, ‘নামাজে আছি, পরে কথা বলবো। ’ তারপর আবার আস্তে করে মোবাইলটি রেখে দিচ্ছেন পকেটে।
এবং নামাজও যথারীতি চালিয়ে যাচ্ছেন!
দুবাই এর অনেক মসজিদের পাশেই লক্ষ্য করলাম মন্দির এবং মদের বার তৈরি করে রাখা। এক শেখকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, কী ব্যাপার? মসজিদের পাশে মদের বার! মন্দির! এটা কেন? মসজিদের একটা পবিত্রতা আছে না? মন্দির এবং বারের প্রয়োজন থাকলে সেগুলো তো মসজিদ থেকে দূরে কোথাও তৈরি করা যেত।
আমার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালেন ভদ্রলোক। ৫০/৫৫ হবে বয়স। থুতনীতে এক চিলতে দাড়ি।
মুচনা দিয়ে ধরতে কষ্ট হবে পরিমাণ। উনার ভাবভঙ্গি দেখে আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। প্রশ্নটি মনে মনে আবার রিপিট করে চিন্তা করতে লাগলাম মারাত্মক বাজে কোনো প্রশ্ন আমি করে ফেলেছি কি না। অন্তত উনার হাবভাব দেখে তো তেমনই মনে হচ্ছে।
শুনেছি সেদেশের আইন-কানুন নাকি খুব কড়া।
যখন-তখন যে কাউকে ধরে দেশে পাঠিয়ে দিতে পারে। তবে এই ভাবনা আমাকে খুব একটা কাবু করতে পারার কোনো কারণ নেই। আমি ছয় দিনের জন্য গেছি। একদিনের মাথায় ফেরৎ পাঠিয়ে দিলেও খুব একটা মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।
তবে অবস্থা এতটা চরম পর্যায়ে গেল না।
আরবী ভদ্রলোক আঞ্চলিক আরবী ভাষায় আমাকে যে জবাব দিলেন, তার সারমর্ম হচ্ছে-
“দেখো ছেলে, আমাদের দেশ হচ্ছে একটি ফ্রিডম কান্ট্রি। সবার জন্য উন্মুক্ত। সকল ধর্মের সকল গোত্রের এবং সকল কালচারের মানুষের কথা আমাদের সরকার ভাবে। মসজিদ তৈরি করে রাখা হয়েছে। পাশে মন্দির আছে, মদের বারও আছে।
আমরা কাউকেই বাধ্য করছি না। যার ইচ্ছা মসজিদে ঢুকে নামাজ পড়বে, যার ইচ্ছা মন্দিরে প্রবেশ করে পূঁজো করবে, কারো যদি ধর্ম-কর্ম করতে মন না চায়, যদি ড্রিংকস করতে ইচ্ছে করে, তার জন্য বার। আর বার তো আর মসজিদের ভেতরে বা বাউন্ডারী দেয়ালের সাথে ঘেষে তৈরি করা হয়নি। দূরত্ব আছে। সুতরাং মসজিদ অপবিত্র হবে কেন?”
উত্তর শুনে আমি মাথা ঝাঁকাতে লাগলাম।
যেন তিনি অত্যন্ত খাঁটি কথাই বলেছেন।
হাটা শুরু করলাম হোটেল কক্ষের দিকে। বিশাল বিশাল বিল্ডিং এর বেষ্টনীতে আবদ্ধ দুবাই শহরের চাকচিক্য ও আভিজাত্যের ছোঁয়ায় আমরা মুগ্ধ। দেখলেই বুঝা যায় আর যে জিনিষের অভাবই থাকুক তাদের, টাকার কোনো অভাব নেই। বিশাল বিশাল রাস্তা, ধবধবে, চকচকে।
পরিচ্ছন্ন, আবর্জনামুক্ত। সিএনজি বা রিক্সার ঝামেলা নেই। জীর্ণ-শীর্ণ গাড়ী নেই। সম্ভবত সঙ্গত কারণে ট্রাফিক জ্যামের ব্যবস্থাও নেই।
তবে আমাকে ভীষণরকম ভাবিত করে তুললো সেখানকার কালচার।
স্কীনটাইট হাতা ছাড়া গেঞ্জী এবং জিন্সের ফুল কিংবা থ্রি- কোয়ার্টার প্যান্ট পরে মেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে অবাধে। অনেক মেয়ের পোশাকের ধরণ বর্ণনা করাও কষ্ট। সারা শরীরের এক চতুর্থাংশও যদি কাপড়ে ঢাকা না থাকে, তাহলে সেই পোশাকের কি আর খুব কিছু বর্ণনার দরকার আছে?
আমাদের দেশের পান দোকানের মত আছে মদের দোকান। ভদ্র ভাষায় বার। রাস্তার মোড়ে ডান্স ক্লাব, বিউটি ক্লাব, লেডিস ক্লাব।
তবে ওসব লেডিস ক্লাবগুলোতে শুধু লেডিসরাই যায় ভাবলে আপনি ভুল করবেন। আপনি ভুলে গেলে আপনাকে আমি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, তালি কিন্তু এক হাতে বাজে না।
ক্রমশ-------------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।