প্রিয় পাঠক, আমার লেখার মাধ্যমে আমিরাত সম্বন্ধে যদি আপনাদের মনে নেগেটিভ ধারণার জন্ম হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আমি আপনাদেরকে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জানাতে চাই, এই ধারণা পুরোপুরি ঠিক না। তাদের চরিত্রে, তাদের কালচারে নিশ্চই এমন অনেক ভাল দিক আছে যেগুলো এই স্বল্প সময়ে আমার চোখে পড়ে নি।
আর একেবারেই যে পড়ে নি, সেটাও ঠিক না। বিশেষ করে দুবাই কালচার আমাকে দারুণভাবে ব্যথিত করেছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে আল আইন ও শারজাহতে যাওয়ার পর আমার মনোভাবে পরিবর্তন আসে।
আল আইন ও শারজাহর মুসলমানরা এখনো তাদের ঐতিহ্যের কদর করছেন দেখে ভাল লাগে আমার। শুনেছি রা’সুল খাইমার পরিবেশও নাকি ভাল। আফসোস! সময়ের স্বল্পতায় অখানে আমাদের যাওয়া হয়নি।
আমিরাতের যে ব্যাপারগুলো ভাল লেগেছে, ভুল পড়ে যাওয়ার আগে সেগুলো এখানে তুলে ধরতে চাই। এই যেমন-
* সে দেশের যে ব্যাপারটি আমাকে সবচে বেশি মুগ্ধ করেছে, তা হল ফজর কিংবা এশা প্রত্যেক নামাজেই মসজিদ ভর্তি মুসল্লি।
কিশোর ছেলেরা, যাদের উপর এখনো নামায ফরজ হয়নি, তারাও হাজির হয় নামাজে।
* আমাদের দেশে লক্ষ্য করেছি বড়রা বসে কথা বলতে থাকলে সেখানে ছোট বাচ্চারা বসলে ধমক দিয়ে তাদের উঠিয়ে দেয়া হয়। বলা হয়-তুমি এখানে কী করছো? দেখছো না মুরব্বীরা বসে কথা বলছে। যাও, বাইরে গিয়ে খেলা করো গিয়ে। কিন্তু ওখানে এটা করা হয় না।
সবাই একসাথে বসে সকল আলাপ-আলোচনা করে। তাদের নীতি হচ্ছে আমরা এমন কথা বলবোই বা কেন, যা বাচ্চাদের সামনে বলা যাবে না।
* আইনের প্রতি সেদেশের মানুষ শ্রদ্ধাশীল। তারা তাদের দেশের আইনকে শতভাগ মান্য করেই চলে।
* সেদেশের সরকারী সেক্টরগুলো দুর্নীতিমুক্ত।
* সেদেশের সরকার জনগণকে সন্তানের মত মনে করে। পিতাসুলভ মনোভাব নিয়ে সন্তানদের সকল চাহিদা পূরণ করে দেয়। যেহেতু ভূমির মালিকানা সরকারের, তাই জনগণকে থাকার জন্য জমি লিজ দেয়। বাড়ী-ঘর করার জন্য সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদী ঋণও দেয়। ঋণের ফরটি/ ফিফটি পারসেন্ট পরিশোধ করার পর বাকীটা আবার মাফও করে দেয়।
* চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি থেকে তাদের দেশটি মুক্ত। সেদেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট করে করে সময় ক্ষেপন করা হয় না। প্রমাণ সাপেক্ষে তড়িত বিচার, ধর তকতা মার পেরেক টাইপ।
* যদিও বর্তমান বিশ্বে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বেশি জনপ্রিয়, তবে আমিরাত সফর করে কিছু সময়ের জন্য হলেও আমার মনে হয়েছে, আসলে রাজতন্ত্র ব্যাপারটিও তো খুব মন্দ না। অধিকারের নামে মিছিল মিটিং, জ্বালাও, পোড়াও, হরতাল, অসহযোগ নেই।
জনভোগান্তি নেই।
* এককথায় বলা যায় সার্বিক বিবেচনায় পুরো আমিরাত দেশটি সুপরিকল্পিত কাঠামোতে গড়ে তোলা হয়েছে এবং সু-নিয়ন্ত্রিত পন্থায় পরিচালিত হচ্ছে।
আল-হাইয়াতুল আ’ম্মা’হ এবং আমাদের ই.ফা.বা.
সেভেন সিস্টারস্ নামে পরিচিত আমিরাতের সাতটি প্রদেশের মধ্যে একটি হল আবুদাবি। আবুদাবি হল সেদেশের রাজধানী শহর। সাধারণত আবুদাবির শেখই রাজতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত সেদেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে থাকেন।
এই তথ্য আগেই জানানো হয়েছে।
আল-আইন আবুদাবির এরিয়ার সবচে' বড় শহর। আল-আইনবাসীর বক্তব্য হচ্ছে, আল-আইন আলাদা রাজ্য হবার সকল যোগ্যতাই রাখে। যদিও এটা সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তবুও সার্বিক সুযোগ-সুবিধা ও আকার-আয়তন-অবস্থান বিবেচনায় আমার কাছেও মনে হল তারা ভুল বলেননি। আল আইন সত্যিই আলাদা রাজ্য হবার মত।
আমি আব্দুল্লাহ ভাই’র মাধ্যমে জানলাম, আল আইনসহ গোটা আরব আমিরাতের সকল মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হয় আবুদাবির কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাধীন ‘আল হাইয়াতুল আ’ম্মাহ লিশ শুয়ূনিল ইসলামিয়া ওয়াল আওক্বাফ’ বা General Authority of Islamic Affairs & Endowments এর মাধ্যমে। এই সংস্থাটিকে বাংলাদেশি পাঠক আমাদের ইসলামী ফাউন্ডেশনের সাথে তুলনা করে বুঝে নিতে পারেন। অবশ্য আমাদের ই.ফা.বা-এর সাথে সেদেশের আল হাইয়্যাতুল আ’ম্মা’র বেশ কিছু ব্যবধান আছে।
আমিরাতের এই সংস্থাটির স্বরূপ ও প্রকৃতি এবং পরিচালনার নীতিতে কখনো পরিবর্তন আসে না। বর্তমানে এই সংস্থাটির মূল কর্ণধার হলেন তিনজন।
চেয়ারম্যান হলেন শেখ হামদান বিন মুসলিম আল মজরুয়ী। জেনারেল সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করছেন শেখ মতর আল কা’বী। আর সহ সেক্রেটারী হিসেবে আছেন মোহাম্মদ উবায়েদ আল মজরুয়ী। আবার প্রত্যেক ষ্টেট-এ রয়েছেন প্রথম শ্রেণীর সচিবের পদমর্যাদার একজন করে চেয়ারম্যান। এই পদগুলো নিয়ে ওখানে কোনো গ্রুপিং-লবিং হয় না।
ঠিক যেমনটা হয় আমাদের ই.ফা.বা এর ক্ষেত্রে।
আফসোস, আমাদের দেশে যোগ্যতারচে' আবেগ এবং ব্যক্তিগত রিলেশনশীপই বেশি কাজ করে থাকে। ইসলামী ফাউন্ডেশনের চেয়ারগুলো সরকার বদলের সাথে সাথে তার আরোহীদেরও বদলাতে থাকে। বর্তমানে ফাউন্ডেশনের ডিজি বা ডাইরেক্টর জেনারেলের চেয়ারে এমন এক লোককে বসানো হয়েছে, যার সম্বন্ধে খুবকিছু না বললেই চলে। ইসলামের কতটুকু কী বুঝেন, সেটা বোঝা না না গেলেও ব্যালে ড্যান্স- সুইং ড্যান্স সম্বন্ধে যে তার বেশ ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেটা তিনি জানান দিয়েছেন জাতিকে।
এ নিয়ে আর বেশি কথা বলে লাভ কি! ঘরের চালই যদি না থাকে, তাহলে দরজা-জানালা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী?
আমাদের ই.ফা.বা’র আওতাধীন অন্যতম প্রতিষ্ঠান বায়তুল মুকাররাম আমাদের জাতীয় মসজিদ। বর্তমানে এমন এক লোককে বায়তুল মুকাররামের খতীবের আসনে বসানো হয়েছে, যার কবল থেকে মুক্তি পেতে খোদ্ বায়তুল মুকাররামের মিম্বরটি পর্যন্ত আর্তনাদ করছে। বলছে, ‘‘আমি বাংলার তেরো কোটি মুসলমানের সকলের মিম্বর হয়ে থাকতে চাই। বিশেষ কোনো গোষ্ঠির নয়। আমি আমার পীটে একজন দেশ সেরা আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তিকে পেতে চাই।
কোনো ডক্টরকে নয়। ডক্টরেট ফলানোর জায়গা মসজিদের মিম্বর নয়। ’’ সম্পূর্ণ অযোগ্য, অথর্ব মাজারপন্থী এই লোকটির অশুভ কবল থেকে আমাদের জাতীয় মসজিদটি কবে যে পরিত্রাণ পাবে, সেটা এই মূহুর্তে কেউ বলতে পারবে না।
এই খতিব'র কথা খুব কিছু না বললেও চলে। উনাকে ফিতরার পরিমাণ জিজ্ঞেস করলে সোজা সেঞ্চুরী করে বসেন! কোথাকার এক দেবনারায়ণ যখন কুরবাণীর বৈধতা নিয়ে হাই কোর্টে রিট করে বসলো, কালের কণ্ঠ থেকে জানতে চাওয়া হলো খতীবের কাছে।
তিনি বললেন, ছোটবেলা থেকেই তো শোনে আসছি হযরত ইসমাঈল আ, কেই কুরবাণীর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। এখন যখন এ নিয়ে কথা উঠেছে, ব্যাপারটি খতিয়ে দেখবো। একজন সাধারণ মুসলমানও যে ব্যাপারটি জানে, আমাদের খতিব সাহেবকে সেটা খতিয়ে বের করতে লাগে। আমড়া কাটের ঢেঁকি আর কাকে বলে!!
অবশ্য পেশীশক্তি নিয়ে অনেকটা কমান্ডো স্টাইলে বায়তুল মুকাররাম দখল করা ডক্টর সালাউদ্দিনের যোগ্যতা যে একেবারেই নেই, সেটা বলা যাবে না। একটা যোগ্যতা কিন্তু তার ঠিকই আছে।
আর এটা হল তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বাল্য শিক্ষক।
এই স্বাভাবিক বোধগম্য কারণেই লোকটি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন।
তো এই কারণে যদি এই লোককে বিশেষ সম্মান বা কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়, তাহলে কাজটি তো অন্যভাবেও করা যেত। জাতীয় মসজিদের খতীব হিসেবে জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে না দিয়ে প্রয়োজনে উনাকে ‘জাতীয় বাল্য শিক্ষক’ টাইপের কোনো পদবিতে ভূষিত করা যেত। মনে রাখা দরকার জাতীয় মসজিদ দেশের সকল মসজিদের জন্য অনুস্মরণীয়।
আমি জানি আমার এই লেখা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে না। তবুও মনকে একটু হালকা করার জন্য হলেও বলি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ডক্টর সালাউদ্দিনের মত লোককে জাতীয় খতীব হিসেবে আমাদের সহ্য করতে হবে, এমন কোনো কথা কিন্তু আপনাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল না। আপনি কি জানেন মাজারপন্থি এমন লোককে খতীব হিসেবে পছন্দ করা হবে, এমন কথা আগে বললে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ভোট আপনার বাক্সকে পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে চলে যেত।
আমার ব্যবহৃত ‘মাজার পন্থি’ শব্দটির অপব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই।
সত্যিকার ওলি-আউলিয়াদের কবরের পাশে গিয়ে তাদের ওসিলা নিয়ে দো’আ করলে কবুল হবার সম্ভাবনা বেশি। আমরাও সময় পেলে আমাদের বাড়ীর পাশে শুয়ে থাকা শাহজালাল (রহ.)’র কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। জিয়ারত করি। মাজারপন্থি বলতে আমি বুঝাতে চাচ্ছি সেই সব লোককে, যারা সাধারণত মসজিদ থেকে মাজারকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। মাজারে মাজারে গিয়ে এমন সব কু-কীর্তি করে বেড়ায়, যেগুলোর বিরুদ্ধে ইসলামী শরীয়াতে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে।
তো হতে পারেন বর্তমান খতীব আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বোনের বাল্য শিক্ষক। হতে পারেন এই লোক ইনকিলাবের বাহাউদ্দিন সাহেবের আত্মীয়। হতে পারে ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা মাওঃ মান্নানের ছেলে বাহাউদ্দিন ড. সালাউদ্দিনের বেয়াই। তার মানে তো এই হতে পারে না যে, সহিহ-শুদ্ধভাবে সুরায়ে ফাতেহা তেলাওয়াত করতে পারা না পারার সন্দেহযুক্ত এই লোককে বায়তুল মুকাররামের মত একটি মসজিদের খতীব করে নেয়া হবে। হতে পারে এই লোককে খতীব করার জন্য ইনকিলাব পরিবার জোর লবিং করেছে।
তবে আমার প্রশ্ন হল, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কেন ইনকিলাবের পাতানো জালে পা দেবেন?
ইনকিলাব ঘরানার মাজার পন্থী একজন, একজন ডক্টরকে বায়তুল মুকাররামের মত মসজিদের খতীবের জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী কীভাবে যে পছন্দ করলেন সেটাই এক রহস্য। তেল আর জল কখনো এক হয় না বলেই জানতাম। আমাদের সরকার প্রমাণ করে দিল ইচ্ছা থাকলে সেটাও সম্ভব হয়। স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি আওয়ামীলীগ স্বাধীনতার প্রকাশ্য বিরোধীতাকারী মাওঃ মান্নানের ইনকিলাব ঘরানার লোকের সাথে সখ্যতা করে সেটাই প্রমাণ করলো! ফিরে যাচ্ছি আল-আইনে।
আল আইনসহ আমিরাতের প্রায় সকল মসজিদের ইমামতি করেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিশর, ওমানসহ বাইরের লোক।
আমিরাতের নিজস্ব কোনো ইমাম নেই বললেই চলে। মাদরাসাই নেই যে দেশে, সে দেশে ইমামের জন্ম হবে কোত্থেকে? মাহাদুল ইসলামীর মতো যে সকল ইসলামী (?) প্রতিষ্ঠান আছে, তাতেও আরবী ছেলেরা খুব একটা লেখাপড়া করে না। মূলত ওমান-চেচনিয়ার ছেলেরা এখানে পড়ালেখা করে।
সেখানে ইমামকে ধরা হয় ৮ম গ্রেডের কর্মকর্তা বা কর্মচারী এবং মুয়াজ্জিনকে ৯ম গ্রেডের। বেতন বৈষম্যও চোখে পড়ার মত।
বাংলাদেশী টাকায় হিসাব করলে কারো মাসিক বেতন ১৫০,০০০ টাকা, কারো ৮৫,০০০ টাকা, কারো ৪৫,০০০ টাকা আবার কারো ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা। মুয়াজ্জিনের বেতন গড়ে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা।
বর্তমানে সেখানে কর্মরত ইমামগণ বেশ আতংকিত আছেন। কখন কার চাকরী চলে যায়, এ নিয়ে বাঙালি ইমামরা চরম আশংকাজনক দিন কাঠাচ্ছেন। আমিরাত কর্তৃপক্ষ ইদানিং ‘তওত্বিন’ বা স্বদেশী ইমাম নিয়োগের একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
সেই সঙ্গে জর্দ্দান, ফিলিস্তিন, মিশরের আল আজহারের সার্টিফিকেটধারী ইমামদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা করছে। এতে করে বাংলাদেশী ইমামরা ভোগছেন চরম আতংকে। এ ব্যাপারে তারা বাংলাদেশ সরকার থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা কামনা করছেন।
......ক্রমশ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।