আকাশ পথের টুকিটাকি
বিমান চলাচলের সিস্টেম এবং আনুসাঙ্গিক ভাবনাগুলোর কিছুটা অবশ্য শুরাহ হয়েছে দেশে ফেরার পর। আমি জানি আমাকে ঘিরে ধরা প্রশ্নগুলো আমার মত বিমান জার্নিতে অনভ্যস্থ আরো অনেককেও ভাবায়। তাই এ ব্যাপারে আমার কৌতুহলের প্রেক্ষাপটে বেরুনো তথ্যগুলো সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য তুলে ধরতে দেরি করা ঠিক হবে না।
দেশে এসে আমি কথা বললাম সব সময় আকাশ পথে জার্নি করে অভ্যস্ত আমার কনসালটেন্ট শ্রদ্ধেয় আহাদ ভাই’র সাথে। বহুমুখি প্রতিভাধর সৈয়দ আব্দুল আহাদ এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় হচ্ছে, তিনি জনতা ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা।
তিনি বাংলাদেশ বেতারের প্রথম গ্রেডের একজন সংবাদ পাঠক। একই সাথে তিনি একজন ভাল আবৃত্তিকারকও।
ইউরোপ-আমেরিকার অনেক ক্লায়েন্ট আহাদ ভাইয়ের শিডিউল পায় না। অথচ কোনো কারণ ছাড়াই লোকটি আমাকে ছোট ভাই’র মত ভালবাসেন। আমার কোনো কাজে আমি উনার কাছে একবার গেলে উনি নিজে আমার কাছে তিনবার আসেন।
আমার কাছ থেকে কোনো কনসালটেন্সি ফি’ও নেন না। দিনে দিনে আমার উপর উনার ভালবাসার ঋণের বোঝা বাড়িয়েই চলেছেন।
তিনি আমাকে যে ব্যাখ্যা দিলেন, সেটা আমার পছন্দ হল। আমার মনে হল তাহলে তো বিমান চালানো খুব কঠিন কিছু না? তিনি বললেন,
বিমানের যে পাখাগুলো রয়েছে, ওগুলোর ঘুর্ণায়নে অপসারিত বাতাসের ওজনের’চে বিমানের ওজন কমে যায়। ফলে বিমানটি বাতাসে ভেসে থাকতে পারে?
প্রাসঙ্গিকভাবে এক্ষেত্রে বিমান আবিস্কারের ধারণাটি কোত্থেকে পাওয়া গেল, সেই ইতিহাসটিও স্মরণ করা যেতে পারে।
উড়োজাহাজ আবিষ্কারের মূল ধারণাটি সংগ্রহ করা হয় পাখি সংক্রান্ত আল-কুরআনের বর্ণনা থেকে।
পাখি আকাশে উড়ে যে কৌশলের মাধ্যমে, তার নাম Lift and Forward thrust কৌশল। পাখি উড়ার সময় তাকে বাতাসের চাপ সামনের দিক থেকে বাধা দেয়। মধ্যাকর্ষণ শক্তি তাকে ভূ-পৃষ্ঠের দিকে টানে। তখন পাখি তার ডানা দোলিয়ে বাতাসের চাপকে বক্ষদেশে এনে কেন্দ্রিভূত করে ফেলে।
সেই কেন্দ্রিভূত বাতাসের আবার একটি ভরবেগ থাকে। ভরবেগ সংরক্ষিত থাকার কারণে পাখি বিপরীত দিকে গতি পায়। এক্ষেত্রে নিউটনের ৩য় সূত্র ‘প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে,’ সূত্রটি সক্রিয় হয়। যার ফলে পাখি ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় আকাশে।
বৈজ্ঞানিক কৌশল ব্যবহার করে পাখিকে এই আকাশে উড়তে কে শেখালেন? তিনিই তো আল্লাহ।
আর এটা করেছেন মানুষকে আকাশযান তৈরির কৌশল শিক্ষা দেবার জন্য। যাতে করে মানুষ বিমান-রকেট ইত্যাদি আবিস্কার করে মহাশুন্যে আল্লাহপাকের আশ্চর্য সৃষ্টি সমূহ অবলোকন করতে পারে। আর এদিকে ইঙ্গিত করেই সুরায়ে মুলকে বলা হয়েছে-
‘তারা কি তাদের উপরের পাখিদের প্রতি লক্ষ্য করে না? কিভাবে পাখিরা উপরে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় আবার কখনো ডানা সংকুচিত করেও উড়ে বেড়ায়। রহমান ব্যতীত কে আছে এমন, যে এভাবে শুন্যের উপর রাখতে পারে?’
সুরায়ে নাহল-এ বলা হয়েছে-
‘‘তারা কি পাখিগুলোকে দেখে না কেমন অনুগত হয়ে মধ্য আকাশে উড়ে বেড়ায়? আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ তাদেরকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখেনি। বস্তুত: বিশ্বাসী লোকদের জন্য এখান সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
’’ পবিত্র কুরআনের এই ইঙ্গিত ধরেই আগাতে লাগলেন বিজ্ঞানীরা। সেই সঙ্গে নজরে আনলেন বিশ্বনবীর মে’রাজকে।
বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে স্ব-শরীরে সপ্তাকাশের উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে যার নাম মে’রাজ বা উর্ধগমন। মসজিদে হারাম থেকে শুরু হয়েছিল সেই যাত্রা।
রাস্তায় ফিলিস্তিনের মসজিদে আকসায় সাময়িক যাত্রা বিরতি করে সেখান থেকে সাত আকাশের উপরে, সেখান থেকে সিদরাতুল মুনতাহায়, আল্লাহর একদম কাছাকাছি।
এটা সেই সময়ের ঘটনা, যখন বিমান আবিস্কার হবে দূরে থাক, বিমানের আবিস্কারক রাইট ব্রাদার্সের প্র-পিতামহেরও জন্ম হয় নি। নবীজির এই ভ্রমণ ছিল সম্ভবত সৃষ্টি জগতে ২য় বারের মত কোনো মানুষের আকাশ ভ্রমণ। ১ম বার হযরত ঈসা (আঃ) কে আল্লাহপাক আকাশে তুলে নিয়েছিরেন। অবশ্য তাঁকে সাত আকাশের উপরে নেয়া হয় নি।
ঈসা (আঃ) কে নেয়া হয়েছে ৪র্থ আকাশে।
এর ৫শ বছর পর বিশ্বনবীকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ দাওয়াত করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সাত আকাশেরও আরো উপরে। নবীজির এই যাত্রায় বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। বোরাক। বোরাকের ব্যাখ্যা এই মুহুর্তে অপ্রাসঙ্গিক।
তবে বোরাক নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে গেল তখন থেকেই। আর বলাই বাহুল্য, এই গবেষণার ক্ষেত্রে এগিয়ে এলেন অমুসলিম বিজ্ঞানীরা। তারা ভাবলেন, বোরাক নামক বাহনটির আকৃতি-প্রকৃতি বা গঠনপ্রণালী যাই হোক, এটি নবীকে পীঠে তুলে উপরে গেল কেমন করে? অবশ্যই বাতাসে ভর করে। তাহলে বাতাসের উপর ভেসে বেড়ানো নিশ্চয়ই সম্ভব। কিন্তু এটা কেমন করে সম্ভব? শুরু হল চুলচেরা বিশ্লেষণ, অনুসন্ধান।
পাশে রাখা হলো, পাখিদের আকাশে উড়ার কলা-কৌশলের বর্ণনা। এর সময় সফল হলেন রাইট ভাইদ্বয়।
এক সময় এই হাওয়াই জাহাজের কল্যাণে মানুষ চাঁদ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে গেলো। ১৯৬৯ সালের ২১শে জুলাই রাত ২টা ১৭ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডে আমেরিকার বিজ্ঞানী নীল আর্মষ্টং, মাইকেল কলিন্স এবং এডুইন অলড্রিন গিয়ে পৌছলেন চাঁদের দেশে। এই তথ্য তো সকলেরই জানা।
অবশ্য আর্মষ্টংরা চাঁদে যেতে পেরেছিলেন কি না, সে বিষয়ে খোদ আমেরিকা থেকেই বিভিন্ন সুর শুনা যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, আর্মষ্টংরা নাকি আদৌ চাঁদে গিয়ে পৌছতেই পারেন নি। রাস্তা থেকেই নাকি তাদেরকে গিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল বা ফিরিয়ে আনতে হয়েছিল আমেরিকান যুদ্ধ বিমানের। পরে নাকি কোনো এক সমুদ্র বন্দর অথবা মরুভূমি অঞ্চলে ফিল্মের শ্যূটিং এর ষ্টাইলে ছবি-টবি তুলে সেটাকে বিশ্ববাসীর সামনে ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছিল। সঙ্গত কারণেই তাদের চাঁদে যাওয়া না যাওয়ার ব্যাপারটি সন্দেহের বেড়াজালে ঘুরপাক খাচ্ছে, বলাই যায়।
তো বাস্তবতা কী, সেটা আরো অনেকের মতো আমিও জানি না। শুধু জানি, মুসলমানদের ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল একটি অধ্যায় মে’রাজের সাথে সংশ্লিষ্ট বোরাক এর উপর গবেষণা করেই এক সময় সফল হলেন অমুসলিম বিজ্ঞানীরা।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ২য় যে প্রশ্নটি আমার মাথায় ঘুরঘুর করছিলো, অর্থাৎ চতুর্দিকে সমান মহাশূন্যে বিমানগুলো রাস্তা চিনে সামনে আগায় কী করে?
এই সমস্যাটির সমাধান আহাদ ভাই আমাকে এভাবে দিলেন যে, প্রত্যেকটি এয়ারপোর্টের নিজস্ব এবং আলাদা একটি সিগনাল আছে। এই সিগনালকে বলা হয় ‘বিকন ট্রান্সমিশন সিগনাল’।
যেমন ঢাকা থেকে দুবাইগামী বিমান ঢাকা থেকে উড্ডয়নের আগেই দুবাই বিমানবন্দরের সিগনাল এডজাষ্ট করে নেয়। বিমানটির অভ্যন্তরের মনিটরে একটি কাটা রয়েছে। অটাকে দুবাই বিমানবন্দরের সিগনালের সাথে সেট করে বিমানের ষ্টিয়ারিংকে এই কাটার সাথে ফিক্সড করে ফেলা হয়। তারপর বিমানটি আকাশে উঠে অই সিগনাল ফলো করেই অগ্রসর হয়। এখানে বিমানের চলার গতি দূরত্ব অতিক্রমের সময় এবং গন্তব্যের মোট দূরত্বও হিসাবে রাখা হয়।
ব্যাখ্যাটি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হল। এছাড়া বিকল্প কোনো ব্যাখ্যা যদি থেকেও থাকে, সেটাও তো আমার জানা নেই।
আমার মনে ৩য় প্রশ্নটি ছিল, মহাকাশে হঠাৎ ঝড়ের কবলে পড়লে বা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মুখোমুখি হলে তখন উপায় কী? তাছাড়া প্রতি ঘন্টায় প্রায় হাজার কিলোমিটার বেগে চলতে থাকা বিমানগুলো বুঝবে কেমন করে সামনে ঝড় বা অন্য কোনো দুর্যোগ রয়েছে।
আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম, বিমানগুলো যখন আকাশে থাকে, তখন সেগুলো কোনো না কোনো দেশের কোনো না কোনো এয়ারপোর্টের রাডারের আওতায় অবশ্যই থাকে। এমন মনে করা যাক কোথাও ঘণ্টায় ১২০ মাইল বেগে ঝড়ো হাওয়া বইছে।
ব্যাপারটি কিন্তু সংশ্লিষ্ট এলাকার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নজরে ঠিকই ধরা পড়বে। তারা সেটা রাডারে পরিষ্কার দেখতে পারবে। তখন তারা যদি দেখে সরাসরি ঝড়ের দিকে ছুটে আসছে কোনো বিমান, তখন সাথে সাথেই তারা যোগাযোগ করবে বিমানটির সাথে। বিমানটির ক্যাপ্টেনকে জানাবে, তুমি যেদিকে যাচ্ছো, সেদিকে আরো ১ হাজার কিলোমিটার সামনে একটি বিশাল ঝড় আছে।
তখন ক্যাপ্টেন হয়ত জিজ্ঞেস করবে, “অই ঝড়ের গতিবেগ কত?”
তাকে গতিবেগ জানানোর পর যদি তার সাহসে কুলোয় আর সম্ভব মনে করে, তাহলে বলবে, Don't worry, I’m confident to over come.
তখন অই এয়ারপোর্ট থেকে বলা হবে Well, that is up to you but keep alert for safety.
আর যদি পাইলট মনে করে ঝড়ের ভেতর দিয়ে যাওয়াটা রিস্কি হয়ে যাবে, তখন সে সাজেশন চাইবে অই এয়ারপোর্টের কাছে।
তখন তাকে হয়ত বলা হবে তুমি ১ হাজার ফুট বামে অথবা ডানে মোড় নিয়ে ঝড়টি এড়িয়ে যেতে পারো।
আমার মাথায় সবচে’ বড় যে চিন্তাটি বাসা বেঁধেছিল, তা হল বিপরীত মুখি দু’টি বিমানের মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানোর উপায় কী?
আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম বিমানগুলো চলাচলের নীতিমালা ও ডিসিপ্লেন এমনভাবে মেন্টেন করা হয় যে, তেমন সম্ভাবনারই নাকি জন্ম হয় না। এছাড়া খোদা না খাস্তা হঠাৎ যদি কোনো কারণে কখনো এমন পরিস্তিতির তৈরি হয়েও যায়, তাহলে সেই ব্যবস্থাও আছে। আগেই জানানো হয়েছে বিমানগুলো কোনো না কোনো এয়ারপোর্টের আওতায় ঠিকই থাকবে। আর যখন কোনো এয়ারপোর্টের রাডারে দেখা যাবে পরস্পর বিপরীত দিক থেকে সমান উচ্চতায় দু’টি বিমান এগিয়ে আসছে।
তখন তারা দু’টি বিমানকেই এ ব্যাপারে জরুরী ইনফর্ম করবে। একটাকে বলবে, “তুমি একহাজার ফিট উপরে উঠে যাও। ” অন্যদিকে বলবে, “তুমি এক হাজার ফিট নিচে নেমে যাও। ” আর এটা তারা করবে কারণ একে তো দায়িত্ব ও মানবিক কর্তব্যও। অন্যদিকে প্রতিটি বিমান থেকেই সেইসব দেশের এয়ারপোর্ট ট্যাক্স পেয়ে থাকে, যে দেশগুলোর আকাশ সীমায় প্রবেশ করতে হয়।
এই যেমন আমরা আমিরাত বিমানে দুবাই গেলাম। এটা সর্বপ্রথম অতিক্রম করলো কলকাতা বিমানবন্দর। নিয়ম অনুযায়ী কলকাতার আকাশসীমা অতিক্রম করার সময় কলকাতা বিমানবন্দর থেকে আমিরাতকে সর্বপ্রথম জিজ্ঞেস করা হবে কে তুমি?
এ্যামিরেটস বলবে, “আমি এ্যামিরেটস। ঢাকা থেকে দুবাই যাচ্ছি। আমার ফ্লাইট নং EK.......
তখন প্রশ্ন করা হবে, “আমার আকাশসীমা অতিক্রম করার অনুমতি তোমার নেয়া হয়েছে কি না? হয়ে থাকলে তোমার ক্লিয়ারেন্স নাম্বার বলো।
”
তখন এ্যামিরেটস থেকে ক্লিয়ারেন্স নাম্বার বলা হবে। কলকাতাঅলারা সেটা মিলিয়ে দেখবে। বলবে, Welcome to our aeronautical territory
.
তারপর স্থানীয় আবহাওয়ার রিপোর্ট এবং গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়ে বলবে, have a nice jurny
পাঠক, চলুন আবারো ফিরে যাই দুবাইর গল্পে।
ক্রমশ-------------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।