আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঙালির দ্রোহ , বাঙালির খাদ্যাভাস



বাঙালির দ্রোহ, বাঙালির খাদ্যাভাস ফকির ইলিয়াস ========================================= কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গেল এক সপ্তাহে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সাহায্য চেয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমদ চৌধুরী জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের কাছে এ বিষয়ে পরামর্শ সাহায্য চেয়েছেন। এদিকে ‘ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন উপাত্ত, নিদর্শন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ নিয়ে এসব ফ্যাক্টস এবং ডকুমেন্টস জোগাড় করেছে কমিটি।

যে দেশে গণহত্যা সংঘটিত হয় সে দেশে পাঁচ দশক পরও বধ্যভমি আবিষ্কৃত হতে পারে। বিভিন্ন নিদর্শন, সাক্ষী এবং উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে সেসব বধ্যভমির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে একাত্তরে যা ঘটেছে তা একটি নির্মম হত্যাযজ্ঞ। সে ভয়াবহ দৃশ্যের স্মৃতি বহন করে এখনও অনেক মানুষ বেঁচে আছে। ‘চ্যানেল আই’তে একটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান প্রতি দিন প্রচারিত হয়।

‘মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন’­ অনুষ্ঠানটি উপস্খাপনা করেন দেশের বিশিষ্ট নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। এই অনুষ্ঠানে দিবসভিত্তিক উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বর্ণনা করেন একেকজন অতিথি। সেসব স্মৃতি জাগানিয়া বেদনাবিধুর দিনগুলোর বর্ণনা শুনলে কোন মানুষেরই স্খির থাকার কথা নয়। একাত্তরের মার্চ-পরবর্তী সময়ে কি জঘন্যভাবে গণহত্যা ঘটিয়েছে পাক হানাদাররা! বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে জাতিসংঘের সাহায্য চাওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের আরেকদফা দৃষ্টি কেড়েছে, তা সাক্ষী করে বলা যায়। এ বিষয়ে একটি সুরাহা করার চেষ্টা যদি সরকারের আন্তরিকভাবে থেকে থাকে তবে, তা এগিয়ে নিতে সব প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে।

ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি দীর্ঘ সতেরো বছর বিভিন্ন তথ্য, তত্ত্ব, উপাত্ত সংগ্রহ করে এই তালিকা প্রণয়ন করেছে। বিচার কার্যের প্রয়োজনে এই তালিকাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেখার বিষয় হচ্ছে, জনগণের চোখকে অন্য প্রবাহে ঘুরিয়ে দেয়া। এ কাজটি দু’ভাগে ঘটে থাকে বাংলাদেশে। একটি রাজনীতিকদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে।

আর অন্যটি রাজনীতিক, সমাজ নিয়ন্ত্রকদের পরোক্ষ মদদে। যেহেতু বাংলাদেশে চলমান সময়ে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক পেশিশক্তি দেখানোর সুযোগ নেই তাই। পরোক্ষভাবে তা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে কোন কোন রাজনৈতিক দল। আমরা লক্ষ্য করছি­ জাতি যখন যুদ্ধাপরাধী, ঘাতক, দালালদের বিচারের দাবিতে নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখন! দ্রব্যমূল্যের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়ে একটি মহল এই প্রবাহকে ভিন্ন খাতে ঠেলে দিতে চাইছে। আমরা জানি বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকারী একটি শক্তিশালী মহল রয়েছে যারা সরাসরি দেশে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ইন জোগায়।

তারা সামাজিক প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে এক ধরনের ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানোর চেষ্টা করে যত্রতত্র। আজকের বাংলাদেশে সেই চক্রটি আবার বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। এমনকি প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে বসে থাকা আমলারাও ধর্মীয় ঋজুতায় এদের কাছে নত হয়ে, তাদের পারপাস সার্ভ করতেই তৎপর হয়ে পড়েন। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বাড়ার এই চরম সঙ্কট এবং ‘দুর্ভিক্ষের পদধ্বনির প্রাক্কালে এই চক্রটির ওপর বিশেষভাবে নজরদারি রাখা প্রয়োজন বর্তমান সরকারের। মনে রাখতে হবে যে, কোন কািক্ষত প্রত্যাশা চুরমার করে দিতে পারে পরাজিত আলবদর প্রজন্মরা।

যারা এই দেশমাতৃকাকে এখনও মনেপ্রাণে ভালবাসে না। দুই সেনাপ্রধান মি. মইন উ আহমেদ তাৎক্ষণিক চালের বাজার ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনিও সেখানে এ বিষয়টি পরোক্ষভাবে বলেছেন যে, একটি মহল কৌশলে বাজার চড়া রাখার ফন্দি-ফিকির করে যাচ্ছে। সেনাপ্রধান আরও বলেছেন, এদের বিরুদ্ধে সব ধরনের ব্যবস্খা নিতে সরকার বদ্ধপরিকর। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে মজুদদার, মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে।

আমরা দেখছি, মৌলবাদী দলগুলোর রাজনৈতিক নেতারা বলতে শুরু করেছে­ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণই প্রধান ইস্যু হওয়া দরকার। ঘাতক দালালদের বিষয়টি নাকি তাদের মতে ‘মীমাংসিত’। কে মীমাংসা করেছে, কীভাবে মীমাংসিত হয়েছে, তা দেশের জনগণ কিছুই জানেন না। যে খুনি তার অপরাধের জন্য সাজাপ্রাপ্ত হয়ে দণ্ডভোগ করে না­ সে ইস্যু তো অমীমাংসিত থেকেই যায়। এবং তা কয়েক যুগ পরও মীমাংসিত হতে পারে।

যেমন এখনও বুড়ো নাৎসিবাদীদের বিচার হচ্ছে। তাদের দাঁড় করানো হচ্ছে কাঠগড়ায়। বর্তমান সেনাপ্রধানের কার্যসীমার মেয়াদ একবছর বাড়িয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। বলা হয়েছে জনস্বার্থে এই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সে অনুযায়ী সেনাপ্রধান জুন ২০০৯ সাল পর্যন্ত পদে থাকবেন।

এদিকে ২০০৮-এর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার দৃঢ়তা ব্যক্ত করেছেন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা। তিনি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে ডিসিদের সে নির্দেশই দিয়েছেন যাতে তারা সার্বিক প্রস্তুতি রাখেন। প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর সার্বিক সহযোগিতা ও সমর্থন প্রশ্নাতীত। সব মিলিয়ে আমরা ধরে নিচ্ছি, নির্বাচন এ বছরের মধ্যেই তারা সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এ বছর নির্বাচন হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া তার আইনজীবীর মাধ্যমে জানিয়েছেন দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। বর্তমান সরকার বনাম সম্মিলিত রাজনৈতিক দল, এই দু’পক্ষের কথা প্রবাহিত হচ্ছে বিভিন্ন মেরুতে। এর মধ্যে সরকারের শীর্ষ স্খানীয় কিছু ব্যক্তি কথা বলছেন, দেশের মানুষের খাদ্যাভাস পরিবর্তন নিয়ে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বাঙালি জাতিকে ভাতের বিকল্প হিসেবে আলু খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। কিংবা করা উচিত।

এক সময় ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ বলে একটা সুপরিচিত ছিল এ জাতির। সেই মাছ এখন ক্রমান্বয়ে অগ্নিমূল্য ধারণ করেছে বাংলাদেশে। মাছের ঝোল এখন অনেকের কাছেই স্বপ্নের মতো। চৌদ্দ কোটি মানুষের দেশে যেখানে প্রায় ছয় কোটি মানুষই অভুক্ত থাকছে­ সেদেশে ভাতের বদলে আলু খাওয়ার পরামর্শ দান কিছুটা বাকপটুতা বলেই মনে করছেন সাধারণ মানুষ। আলুর খাদ্য গুণগত কি­ তা নিয়ে কাউকে হয়তো সহজে বুঝানো যাবে।

কিন্তু সবাইকে বুঝানো যাবে না। আলু পশ্চিমা দেশগুলোতে খুব আদৃত খাদ্য। ফেন্সঞ্চ ফন্সাই, ম্যাশড পটেটো, পটেটো সালাদ, এমনকি ইন্ডিয়ান ফুড হিসেবে ‘আলু টিক্কা’, ‘পটেটো রোল,’ ‘কারি পটেটো’­ আইটেমগুলোও অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু এই ধনিক শ্রেণীর খাদ্য মেন্যু কি বাংলাদেশের হতদরিদ্র জনগণের বেলায় প্রযোজ্য? না, তা কোন মতেই প্রযোজ্য নয়। আর নয় বলেই ধনী বাঙালিরা ফাস্টফুডের দোকানে দু’চারটা আলু চপ’ গিললেও, আলুকে মেইনডিশ হিসেবে নিতে এখনও অভ্যস্ত নন।

তাই এই তত্ত্ব যে হালে পানি পাবে না, তা এর প্রবক্তারাও ভাল জানেন। চাইলেই সবকিছু চালিয়ে দেয়া যায় না। বাঙালিকে ভাতের বদলে আলু খাওয়ানো যেমন যাবে না, তেমনি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও মুছে ফেলা যাবে না বাঙালির হৃদয় থেকে। যে শিশু জন্মেই শুনেছে তার পিতা মহান স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, সে দ্রোহী হয়েই বড় হবে সব অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে। সে বিচার চাইবেই সেসব ঘাতক রাজাকারের।

একটি সংবাদ বেশ আলোচিত হচ্ছে দেশে-বিদেশে। সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ একজন মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্রের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে। সেনাপ্রধান বলেছেন, একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সম্মান দেখাতেই, খুনের সাজাপ্রাপ্ত আসামি রাখাল চন্দ্রের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছেন তিনি। সেনাপ্রধানের এই বদান্যতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার চেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বর্তমান সেনাপ্রধান, যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক পুনর্বাসন এবং ঘাতক দালালদের বিচার কার্যটি সম্পন্ন করে যেতে পারেন।

তার মেয়াদ বেড়েছে এক বছর। সে সঙ্গে বেড়েছে মানুষের এই প্রত্যাশাটিও। নিউইয়র্ক, ০৯ এপ্রিল ২০০৮ -------------------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ । ১১ এপ্রিল ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.