আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুর্নীতিতে ডুবল স্বপ্নের পদ্মা সেতু

সবাইকে দ্রব্যমূল্যের উষ্ণ শুভেচ্ছা দুর্নীতি যেন বাংলাদেশের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনার প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশের কপালে লেগেছিল দুর্নীতির তিলক। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশকে বিশ্বের এক নম্বর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এরপর থেকে দুর্নীতি বাংলাদেশের পিছু ছাড়েনি। সময় সময় কম-বেশি হয়েছে এতটুকুই পার্থক্য।

শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের সরকার বর্তমানে ক্ষমতায়। দুর্নীতির অভিযোগ সর্বত্র। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির বিষয়টি এখন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্নীতি পদ্মা সেতুর স্বপ্নকেই সম্ভবত ধূলিসাত্ করে দিচ্ছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি এখন দেশ-বিদেশে একটি আলোচিত বিষয়।

এই দুর্নীতি বাংলাদেশের মানুষের জন্য হতাশার খবর হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন পদ্মা সেতু। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই স্বপ্ন দেখে আসছে। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটবে, খুলে যাবে সম্ভাবনার দ্বার, মংলা বন্দরের সঙ্গে সুন্দর যোগাযোগ স্থাপিত হবে এবং বাস্তবায়িত হবে ট্রান্স-এশিয়ান রুট। এমন আশাই ছিল সবার।

কিন্তু ‘রক্ষক যখন ভক্ষক হয়’ তখন করার কিছুই থাকে না। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু প্রকল্প এখন স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কা হয়েই দেখা দিয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলারের ঋণ-সহায়তা স্থগিত করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক এই দুর্নীতির তদন্ত করছে। তারা জানিয়ে দিয়েছে, দুর্নীতির তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অর্থ ছাড় করবে না।

দুর্নীতির তদন্ত কবে নাগাদ শেষ হবে তাও বলা যাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের জন্য সত্যিই এক খারাপ খবর। একদিকে স্বপ্নের পদ্মা সেতু হচ্ছে না, অন্যদিকে বাংলাদেশের দুর্নীতির কথা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। শেখ হাসিনার সরকার ২০১৩ সালের মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করে যানবাহন চলাচলের জন্য সেতুটি খুলে দেবে ঘোষণা দিয়েছিল। প্রথমে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে কাজ শুরু হবে।

এরপর বলা হয়, ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মূল সেতু, নদী শাসন, টোল প্লাজা ও সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ পদ্মা প্রকল্পের ৬টি দরপত্রের কার্যক্রম শেষ হয়নি। পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরুতেই ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীরা এসব দরপত্রের অনুমতি দিচ্ছে না। অবশ্য এখন পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, গাড়ি ক্রয়সহ নানা কর্মকাণ্ডে ১ হাজার ২১ কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। ৬ দশমিক ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার (প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা)।

এর মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকাই ঋণ-সহায়তা থেকে ব্যয় হবে। বিশ্বব্যাংক ঋণ-সহায়তা দেয়ার কথা ১২০ কোটি ডলার (প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা)। এছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬১ কোটি ডলার, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ১৪ কোটি ডলার এবং জাইকা ৪০ কোটি ডলার। বাকি অর্থ দেবে বাংলাদেশ সরকার। বিশ্বব্যাংক ঋণ-সহায়তা স্থগিত করে দেয়ায় প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়াটাই স্বাভাবিক।

কারণ বিশ্বব্যাংক ছিল এই প্রকল্পের অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সমন্বয়ক। স্বাভাবিকভাবেই আটকে যেতে পারে এডিবি, জাইকা ও আইডিবির ঋণ-সহায়তা। আবার যেহেতু বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়ে গেছে, কাজেই বিকল্প কোনো ব্যবস্থা খোঁজার সুযোগও সরকারের হাতে থাকছে না। ফলে প্রকল্পটি আদৌ এ সরকারের আমলে হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত ১০ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর জন্য তাদের প্রতিশ্রুত ঋণ-সহায়তা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের পরিচালক এলেন গোল্ডস্টেইন এক বিবৃতিতে বলেছেন, জালিয়াতি ও দুর্নীতির বিষয়ে সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আমরা পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে আর আগাব না। বিশ্বব্যাংক আরও জানায়, সুশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিশ্বব্যাংক। পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রকল্পের ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থায়নের ব্যাপারে আমরা অগ্রসর হব না। এটি বাংলাদেশের মানুষেরও চাহিদা বটে। এ বিষয়টি আমরা আমাদের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়েছি।

তিনি এ ব্যাপারে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যাপারে তদন্ত করতে বলেছেন। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজনকে নিয়ে বৈঠক করেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সিনিয়র মন্ত্রীদের নিয়েও তিনি বিশ্বব্যাংকের অবস্থান নিয়ে বৈঠক করেন। প্রধানমন্ত্রী বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না সে বিষয়ে পরামর্শ চান। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এতে সায় না দিয়ে বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়ে গেছে।

সেখান থেকে ফিরে আসার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় চারদিক থেকেই সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছে। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) রফিকুল ইসলামকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সরকার কিছুটা চাপ সরানোর চেষ্টা করছে। দুর্নীতি দমন কমিশন বিশ্বব্যাংকের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির বিষয়ে দুই পক্ষ এক হয়ে তদন্ত করার প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দিয়েছে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পটি শুরু থেকেই একের পর এক জটিলতায় পড়ে। এ প্রকল্পের তদারকির জন্য প্রাক-নির্বাচনী তালিকায় থাকা কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের দুর্নীতির তদন্তে বিশ্বব্যাংক কানাডা পুলিশকে অনুরোধ করলে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ পায়। গত সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভায় অর্থমন্ত্রী যোগ দিতে গেলে তাকে জানানো হয় যে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের তদারকি পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েছে বিশ্বব্যাংক। কানাডা পুলিশ ও বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতিবিরোধী ইউনিট এ বিষয়ে তদন্ত করছে। তদন্ত শেষ হলেই কাজ শুরু হবে।

শুধু তদারকি পরামর্শক নিয়োগের দরপত্রই নয়, নদী শাসনের দরপত্রের প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়েও দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইন্দ্রাবতী মুলায়নীর সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বৈঠকের সময়ে তাকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক সব ধরনের সহায়তা বন্ধ রাখবে। দুর্নীতির ব্যাপারে তাদের কাছে ৭টি সুস্পষ্ট প্রমাণপত্র রয়েছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিষয়ে যার দিকে বিশ্বব্যাংকের আঙুল, সেই যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এখনও নির্বিকার। তিনি বলেই যাচ্ছেন, দুর্নীতির প্রশ্নই ওঠে না।

উল্টো তিনি বলছেন, ‘আগামী জানুয়ারি মাস থেকেই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করার সব প্রস্তুতি আমাদের আছে। ’ দুর্নীতি নিয়ে দাতাসংস্থা ও কূটনীতিকরা যা বলছেন সম্প্রতি উইকিলিকস সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির একটি তারবার্তা ফাঁস করেছে। ওই বার্তায় মরিয়ার্টি লিখেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের দায়িত্ব এমন এক মন্ত্রীর কাঁধে, যার সততা প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো এই গোপন বার্তায় মরিয়ার্টি আরও লিখেন, দুর্নীতির অভিযোগ এখনও যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে ঘিরে আছে।

বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনগোজি ওকোনজো ইউয়েলা এ বছরের ২৭ এপ্রিল ঢাকা সফরে এসে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের অবস্থান তুলে ধরে বলেছিলেন—আমরা দুর্নীতিমুক্ত পদ্মা সেতু চাই। বিশ্বব্যাংকের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইসাবেল এম গুয়েরেরোর কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ সরেজমিন দেখতে গিয়ে তিনি ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে সাংবাদিকদের বলেন, কোনো রকম করাপশন টলারেট বা দুর্নীতি বরদাশত করা হবে না। তিনি বার বার আঙুল উঁচিয়ে বলছিলেন, ‘নো করাপশন, নো করাপশন, নো করাপশন। ’ কিন্তু সরকারের কাউকে সেদিন কোনো প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি।

বাংলাদেশে নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজেনা ঢাকায় নতুন দায়িত্বে আসার আগে মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে শুনানিতে অংশ নেন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ড্যান মোজেনা বলেন, দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, দুই মেরুতে বিভক্ত রাজনৈতিক দল, দুর্নীতি এবং নাগরিক সমাজের প্রতি সরকারের অস্পষ্ট অবস্থানই বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। ড্যান মোজেনা যখন সিনেট কমিটিতে এ বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সেদিন অর্থমন্ত্রীকে ড্যান মোজেনার বক্তব্যের জবাবে বলতে শোনা যায়নি রাবিশ বা বোগাস। বরং নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ মন্তব্যকে আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ অর্থবহ হিসেবে বিবেচনা করছে।

এর মাধ্যমে বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের দুর্নীতির বিষয়টি যে এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সেটাই উঠে এসেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত নতুন ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন গত ৩ অক্টোবর ঢাকায় তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনেও বাংলাদেশের দুর্নীতির বিষয় নিয়ে কথা বলেন। গিবসন বলেন, ব্রিটেন বাংলাদেশে যে উন্নয়ন সহায়তা দেয় তা ব্রিটিশ জনগণের ট্যাক্সের টাকা। সাধারণ মানুষের এ ট্যাক্সের টাকার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যয় হচ্ছে তা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মনিটরিং করা হবে।

সরকারের দুর্নীতির কারণেই জলবায়ু তহবিলের কোনো অর্থ পাচ্ছে না বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ১০ বিলিয়ন ডলারের যে তহবিল গঠন করা হয়েছে, সেই তহবিল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ পায়নি বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের অনুরোধ সত্ত্বেও কোনো সাড়া মেলেনি। দাতারা বলেছেন, সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাদের প্রশ্ন রয়েছে। অর্থাত্ দুর্নীতি নিয়ে বড় ধরনের চাপে আছে সরকার।

যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতি ফাঁস করল বিশ্বব্যাংক এরই মধ্যে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় রিপোর্ট বের হয়েছে যে, পদ্মা সেতু নির্মাণে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের দুর্নীতির কথা সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তারা বলেছে, মন্ত্রীর জড়িত থাকার বিষয়ে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রমাণাদিও রয়েছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক অর্থমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেয়। বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা লিওনার্দ এফ ম্যাকার্থির লেখা এই চিঠির সঙ্গে তদন্তের সারসংক্ষেপও পাঠানো হয়। এতে জানানো হয় বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি (আইএনটি) বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে নির্মিতব্য এ সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল অগ্রিম ক্রয় কার্যাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ প্রাকযোগ্যতা যাচাইয়ের বিজ্ঞপ্তি দেয়। ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর দুর্নীতি ও প্রাকযোগ্যতার শর্ত পরিবর্তনের কারণে এই প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। তার পরদিন সেতু বিভাগ কর্তৃপক্ষ ফের প্রাকযোগ্যতা তালিকার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালের জুলাইয়ের শুরুতে প্রধান সেতু চুক্তির প্রাকযোগ্যতা তালিকায় অনাপত্তি প্রদান করে। তারপর আইএনটি যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ও তার কোম্পানি সাকো’র ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিদের ব্যাপারে বিপুলসংখ্যক অভিযোগ পায়।

এসব অভিযোগে বলা হয়, সাকো পরোক্ষ কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে আইএনটি তদন্ত হাতে নেয় এবং পাঁচ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ৪টি দেশের সম্পৃক্ত একডজনেরও বেশি লোকের সঙ্গে কথা বলে। আইএনটির মতে, গ্রহণযোগ্য এমন কিছু তথ্য-প্রমাণ আসে যা যোগাযোগমন্ত্রী ও তার কোম্পানি সাকোর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সাপোর্ট করে। যোগাযোগমন্ত্রীর কোম্পানি সাকোকে ‘সাইলেন্ট এজেন্ট’ হিসেবে নিয়োগ ও মোটা অংকের ‘ঘুষ’ দেয়ার শর্তে কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলা হয়। অন্যথা হলে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার হুমকিও দেয়া হয়।

তদন্তকারীদের একটি কোম্পানির কর্মকর্তা তথ্য-প্রমাণ দেন যে, তার কাছে সাকোর পরিচয়ে এক ব্যক্তি দেখা করতে আসে এবং তাকে বলে, তিনি যোগাযোগমন্ত্রীর নির্দেশনা নিয়ে এসেছেন। সাকোর ওই প্রতিনিধি তদন্তকারীকে বলেছেন, পদ্মা সেতুর মোট চুক্তির মূল্যের একটি অংশ কমিশন হিসেবে দিলে পদ্মার মূল সেতু নির্মাণের প্রাকযোগ্যতা বাছাইয়ে ওই কোম্পানিকে মন্ত্রী সহযোগিতা করবেন। তদন্তকারী আইএনটি আরও বলেছে, মন্ত্রী হওয়ার পর যোগাযোগমন্ত্রী সাকো থেকে পদত্যাগ করলেও ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, তার স্ত্রী ও দুই কন্যা ঠিকই কোম্পানি পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন। অন্য কোম্পানির কাছেও সাকোকে পরোক্ষভাবে এজেন্ট হিসেবে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন মন্ত্রী। তবে এতকিছুর পরও যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে সরকারের তরফে কোনো দুর্নীতি হয়নি।

তবে বিশ্বব্যাংক, দুদক এবং প্রয়োজনে বিএনপিকে বিষয়টি তদন্ত করে দেখার কথা বলেন। বড় প্রকল্প ছোট প্রকল্পে দুর্নীতি শুধু পদ্মা সেতু নয়, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এখন দুর্নীতির খনি। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বড় বড় প্রকল্প নিয়েই বেশি উত্সাহী এবং স্বপ্নে বিভোর। ছোটখাটো কাজের দিকে তার একেবারেই মন নেই। এ সরকারের সময়ে দেশের ১৫ হাজার কিলোমিটারের বেশি সড়ক নাজুক অবস্থায় পড়ে আছে।

কিন্তু মন্ত্রী ব্যস্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার ও ফোর লেন নিয়ে। কারণ একটিই দুর্নীতি—যা বিশ্বব্যাংক চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে পদ্মা সেতুর কাজে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বাইরে অন্যান্য মন্ত্রণালয় এবং দফতরেও চলছে দুর্নীতি। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্রিকায় দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোয় রিপোর্ট হচ্ছে, টকশোতে বিশিষ্টজনরা বলছেন।

এমনকি বিরোধী দলও তাদের কর্মসূচিতে দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরছে। কয়েকটি পত্রিকার রিপোর্টের শিরোনাম দেখলেই দুর্নীতির বিষয়টি বোঝা যাবে। ৫ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদন ‘মন্ত্রীর বাড়ির সামনেই শেষ হলো জেলা সড়ক। ’ সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশায় যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সমালোচিত হলেও নিজের বাড়ির জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সড়ক নির্মাণ করেছেন। রিপোর্টটিতে সেই চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে।

২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ‘খাদ্যের যত কেলেঙ্কারি’ শীর্ষক রিপোর্ট। এতে টেন্ডার, নিয়োগ, টিআর ও কাবিখায় অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ২৪ আগস্ট ১১ যুগান্তর পত্রিকায় ‘অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে নৌমন্ত্রীর কোটি কোটি টাকা অপচয় : ১৪ বার বিদেশ ভ্রমণ’ শীর্ষক রিপোর্ট ছাপা হয়। ১৫ আগস্ট ২০১১ প্রথম আলোতে ছাপা হয়, ‘সড়ক নিরাপত্তা উপেক্ষিত : নৌমন্ত্রীর চাপে ২০০৯ সালে ১০ হাজার লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল, এবার চান ২৪ হাজার’ শীর্ষক রিপোর্ট। এ রিপোর্টে ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়টিই তুলে ধরা হয়েছে।

২৮ জুন ২০১১ দৈনিক আমার দেশ-এ ‘আ’লীগ এমপির আদম পাচার : মালয়েশিয়ায় তোলপাড়’ শীর্ষক রিপোর্ট ছাপা হয়। ১৫ মে ২০১১ একই পত্রিকায় ‘সরকারের সঙ্গে মন্ত্রীদের ব্যবসা : বিদ্যুত্ এক মন্ত্রীর, রাস্তা-সেতু আরেক মন্ত্রীর’ শীর্ষক রিপোর্টে দুই মন্ত্রী তাদের প্রভাব খাটিয়ে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে কাজ পাইয়ে দিচ্ছেন তার চিত্র তুলে ধরা হয়। ২৪ ডিসেম্বর ২০১০ কালের কণ্ঠ পত্রিকায় ‘সংসদীয় কমিটিতে যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি’ শীর্ষক রিপোর্টে রেল দুর্ঘটনা ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দরপত্র নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে এমপিরা বাগিবতণ্ডায় লিপ্ত হন। এতে বিভিন্ন প্রকল্পে মন্ত্রীর দুর্নীতির বিষয়টিও উঠে আসে। ১৫ ডিসেম্বর ২০১০ বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ‘অভিযোগের শেষ নেই জ্বালানি উপদেষ্টার বিরুদ্ধে, তদন্ত হয় না’ শীর্ষক রিপোর্টে জ্বালানি উপদেষ্টার বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

১ আগস্ট ২০১১ আমার দেশ-এ ছাপা হয় দুর্নীতির ঘাঁটি বিমান। ২৮ আগস্ট ২০১১ যুগান্তরে ছাপা হয় উড়োজাহাজ মেরামতে কোটি কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য। দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের প্রধানমন্ত্রী ডিফেন্ড করছেন কেন আওয়ামী লীগ সরকার সম্পর্কে একটি কথা চালু আছে, দুর্নীতি মুন্সিয়ানার সঙ্গে কীভাবে করতে হয়, সেটা তাদের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। বড় বড় প্রকল্প বানিয়ে যেমন তারা টাকা হাওয়া করে দিতে পারে, তেমনি ছোট প্রকল্প থেকেও টাকা লুটতে পারে। এ সরকারের একটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে ২ কোটি টাকার কমে প্রকল্প বরাদ্দ বাস্তবায়নে ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির অনুমোদন কিংবা টেন্ডার লাগবে না।

বর্তমানে এ ধরনের অসংখ্য প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে। আর এর মাধ্যমে সুন্দরভাবে টাকার হাতবদল হচ্ছে। বড় বড় প্রকল্পের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এখানে আরেকটি উদাহরণ দেয়া যায়। বর্তমানে ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি থাকতে আরেকটি বড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কী প্রয়োজন আছে? বিশেষজ্ঞরা অনুসন্ধান করে দেখিয়েছেন যে, বর্তমান শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ৩০ শতাংশের কম ব্যবহৃত হচ্ছে।

এর মধ্যে শেখ হাসিনার সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর জন্যে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করতে হবে। প্রথমে ভালুকা-ময়মনসিংহ এলাকায় বিমানবন্দরটি করার চিন্তা করা হলো। কিন্তু আবার মত পরিবর্তন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো সেটি হবে মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিলে। শুরু হলো প্রক্রিয়া। জীববৈচিত্র্যের আধার হিসেবে পরিচিত এই বিলের ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হলো।

প্রকল্প নেয়া হলো ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে। বিমানবন্দর ছাড়াও সেখানে করা হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সিটি নামের উপশহর। অবশ্য শেষ পর্যন্ত গণবিক্ষোভের মুখে আড়িয়াল বিল থেকে সরকারকে সরে আসতে হলো। তবে প্রকল্প এখনও বাতিল হয়নি। ৫০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প আসলে কোন উদ্দেশ্যে নেয়া হয়েছে, সেটা জনগণের বুঝতে বাকি নেই।

দুর্নীতি নিয়ে যখন পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে, তখনই দেখা যাচ্ছে সরকারের মন্ত্রীরা এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ক্ষেপে যাচ্ছেন। শুধু রাগই নয়, প্রধানমন্ত্রী অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত মন্ত্রীদের ডিফেন্ড করছেন। সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় তিনি মন্ত্রীদের বলে দিলেন দুর্নীতি নিয়ে ভিত্তিহীন রিপোর্ট করলে মামলা করতে। এ নির্দেশ না দিলে কি হতো না। প্রধানমন্ত্রীর তো উচিত কোনো অভিযোগ উঠলে তার তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া।

সেটা না করে তার এ নির্দেশের কারণে দেখা যাবে দুর্নীতিতে মন্ত্রীরা যেমন আরও বেপরোয়া হয়ে যাবে, তেমনি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারাও আশকারা পেয়ে যাবেন। মূল লেখক : আমার বড়ভাই সৈয়দ আবদাল আহমদ, উপ-সম্পাদক, দৈনিক আমার দেশ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.