আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বপ্ন ভঙ্গের পরের ক্ষণগুলো...

কিছুটা আমার কিছুটা তোমার.. মেলেনা তো কিছু এখন আর! দেশের বাইরে পড়তে যাবার এতদিনের স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে জারার। কত চেষ্টা,কত দোয়া,কত কিছুর পর অবশেষে যাচ্ছে সে,আসলে স্বপ্ন ছিল অনেকদিনের তবে পূরন হওয়াটাও অনেক অপ্রত্যাশিত ভাবেই হয়েছিল। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে জারা,ওদের দুটি বোনকে নিয়ে বাবা-মায়ের সব স্বপ্ন। পড়াশুনায় খারাপ ছিলনা কখনোই তবে দেশের বাইরে পড়তে যাবার স্বপ্নটা পূরন হওয়াটা অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার ছিল বলা যায়,একে তো বাবার অনেক টাকাও নেই তার উপর দেশের বাইরে থাকে তেমন কোন কাছের আত্নীয়-স্বজন ও নেই । গ্রাজুয়েশন শেষ করে তাই দেশেই মাস্টার্স করার চিন্তায় ছিল কিন্তু হঠাৎ করেই বাবার এক বন্ধুর ফ্যামিলি ওকে দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার ব্যাপারে খুব সাহায্য করল,আর ব্যাপারগুলো এত দ্রুত হয়ে গেল যে ভালোভাবে জানার সুযোগ ও পেলনা বাবার এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে আর ও এতদিন জানলনা কেন... ল্যাগেজটা গোছানো শেষ করে,বারান্দায় দাড়ালো জারা।

কাল সকালেই চলে যাবে ও,এই বারান্দা,এই ঘর,এই বাড়ি সব কিছু ছেড়ে...বাসায় কাছের কিছু কাজিন আর ফ্রেন্ডরা এসেছে ওকে বিদায় জানাতে,আজ রাতে সবাই একসাথেই থাকবে,খুব আড্ডা দিবে,তারপর সকালে ও চলে যাওয়ার পর যে যার মতো চলে যাবে... আড্ডা দিতে দিতে চোখটা কিছুটা ধরে এসেছিল জারার,কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই শুনতে পেল,ফুপাতো বোন নীপা আপু আরেক বোন রিনিকে বলছে, --ব্যাপারটা শোনার পর থেকে খুব অস্থির লাগছে আমার,জানিনা জারা যখন শুনবে তখন কি রিএক্ট করবে... --আমিও আম্মুর কাছে শুনে অনেক অবাক হয়েছি,কিন্তু আরও অবাক হচ্ছি,জারা একবারের জন্যেও নাকি জিজ্ঞেস করেনি যে হঠাৎ করে বড় মামার এমন কোন বন্ধু আসলো যে জারাকে দেশের বাইরে পড়তে নিয়ে যাচ্ছে,সব সুযোগ সুবিধা দিয়ে। --আসলে রিনি,জারা হয়তো সেভাবে ভাবার সুযোগ পায়নি,কিন্তু পরে এটার খারাপ রেজাল্ট আসবে কি না বুঝতেছিনা,জারা যথেষ্ট ইমোশনাল মেয়ে,সত্যিটা সহ্য করতে পারবে কি না জানিনা... জারার তন্দ্রাভাব ভালোভাবেই কেটে গেছে। কিন্তু চোখ খুললো না,মাথায় চিন্তাগুলো খুব দ্রুত ঘুরছে...এতদিন ধরে বিদেশে পড়তে যাবে বলে চেষ্টা করছে,ওর চেষ্টা সফল হচ্ছেনা দেখে বাব-মায়ের কতো আফসোস,কিন্তু একবারের জন্যেওতো বলেনি যে তাদের এমন কোন বন্ধু আছে যে জারা কে বাইরে যেতে এভাবে সাহায্য করবে,এই এক দু'মাসের মধ্যে এমন বন্ধু কোথা থেকে এলো...?!নীপা আপুকে জিজ্ঞেস করবে কি?কিন্তু যদি না বলে...তারপরেও যাওয়ার আগে অন্তত জেনে যাওয়া উচিত। উঠে বসল জারা,নীপা আপুকে খুব করে রিকোয়েস্ট করল সত্যি কথাটা ওকে বলার জন্য,অনেকক্ষন ভেবে নীপা বলল, --দেখ জারা,আমরা তোর খারাপ চাইনা,কিন্তু কথাগুলো শোনার পর তোর হয়তো কাল আর যেতে ইচ্ছা নাও হতে পারে... --আরে ধুর আপু,কি যে বলনা,আমার সারা জীবনের স্বপ্ন আমি এত সহজেই ছেড়ে দিব,কিচ্ছু হবে না তুমি বল,আমি শুধু সত্যিটা জানতে চাই। কিন্তু নীপার কেন যেন মনে হল,অনেক সময় মানুষের সারা জীবনের স্বপ্ন এক নিমিষেই শেষ হয়ে যায়...কিন্তু মুখে কিছু বলল না,জারার মুখের দিকে তাকালো নীপা,ছোট বোনের থেকে কখনো কম আদর করেনি জারাকে সে,যতটা পেরেছে জারার জন্য সুযোগ মতো করেছে,নীপার কাছে জারা এখনো সেই ছোট্ট জারাই রয়ে গেছে,কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন,সেদিনের ছোট্ট জারা আজ অনেক বড় হয়েছে দেশের বাইরে পড়তে যাচ্ছে,কিন্তু তারপরেও...যে সত্য এতদিন সে জানেনি আজ কি তা সহ্য করতে পারবে...?...তবুও বলে শুরু করে নীপা, --জারা,তুই তখন অনেক ছোট,এক বছরও হয়নি বয়স,বিয়ের তিন বছর পর তোকে আর মামীকে নানুর বাসায় রেখে বড় মামা চাকুরী নিয়ে চলে গেলেন সিলেট,আমি তখন ক্লাস টু কি থ্রি তে পড়ছি,খুব সাজানো সংসার ছিল বড় মামীর,নানা-নানুতো বড় মামী বলতে অজ্ঞান ছিল।

মামা সপ্তাহে সপ্তাহে আসতেন,কিন্তু বছরখানেক পর থেকে মামা আর নিয়মিত আসতেন না,আসলেও তেমন একটা আগের মতো তোকে বা মামীকে সময় দিতেন না,ব্যাপারটা আস্তে আস্তে সবারই চোখে পড়ল,নানা লোক লাগালেন সিলেটে মামার খবর নিতে,তারও প্রায় ছ'মাস পর একদিন খবর আসল বড় মামা সিলেটে আরেকটা বিয়ে করেছেন,মেয়েটা তার কলিগের ছোট বোন ছিল... --কি?!!!!আপু তুমি এসব কি বলছ?আব্বু আম্মুকে রেখে আরেকটা বিয়ে করেছিল?আমার আব্বু?...হতেই পারেনা...কিছুতেই না... --শক্ত হো জারা,আমি কিছুই মিথ্যা বলছিনা,সব সত্যি,আমার চোখের সামনেই সব হতে দেখেছি,আচ্ছা,তুই কি কখনো দেখেছিস বড় মামার সাথে আমাকে হাসি মুখে কথা বলতে?এটা নিয়ে তুই কত রাগ দেখাতি,কিন্তু কারনটা তুই জানতি না,আজ শুনে রাখ,আমি বড় মামার অনেক আদরের ভাগ্নি হওয়া সত্ত্বেও শুধু মাত্র এই কারনে তাকে মন থেকে ঘৃ্ণা করি অনেক,আমার চোখে মামা একজন বিশ্বাস ভঙ্গকারী,স্বার্থপর মানুষ। জারা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,অনেকক্ষন পর নীপার দিকে তাকায়, --তারপর বল আপু। --তারপর সব শুনে নানা মহা ক্ষেপে যান,সোজা কথায় ছেলেকে ত্যায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন,আমরাও মামার এই কাজ মানতে পারছিলাম না,অন্যদিকে তোর মামারাও তোর মা কে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু বাঁধা হয়ে দাড়ান বড় মামী নিজেই,তোকে ছেড়ে এই সংসার ছেড়ে বড় মামাকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। তিনি নানাকে খুব করে অনুরোধ করেন যেন মামাকে ত্যায্য না করেন,নানা নিজের মেয়ের মতো মামীকে আদর করতেন,মামীও নিজের বাবার থেকে কম ভাবেননি কখনো,বড় মামা মাফ পেয়ে যান। এক বছর পর ঐ মহিলা তাকে ডিভোর্স দিয়ে এক বিদেশি লোককে বিয়ে করে চলে যান কানাডা,মহিলা অল্প বয়সি আর সুন্দরী ছিল তাই ঘোর কাটতে বেশি দিন সময় লাগেনি।

মামা ঢাকায় ফিরে আসলেন,তোর ছোট বোন ফারাহ জন্ম হলো,মাঝখান থেকে হারিয়ে গেল প্রায় তিনটা বছর। মামা ফিরে আসলেন ঠিকই কিন্তু অন্য মানুষ হয়ে,তার কাছে এ বাড়ীর সবাই শক্র,তোর মা তো ছিল তার চোখের বিষ। আমরা সবাই অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম,কিন্তু তোর মা...সব সহ্য করেছেন,দিনের পর দিন রাতের পর রাত...সব ঘৃণা সব রাগ মাটি করে দিয়ে,কেন জানিস? সবার মতো আমিও ভাবতাম বোধহয় তোদের মুখের দিকে তাকিয়ে,কিন্তু না,অনেক দিন পর জেনেছিলাম মামীর কাছে, আসলে তিনি মামাকে অনেক ভালোবাসতেন,এতটা যে মামার দেয়া বড় আঘাতের পরেও তিনি সামনে আসলে মামীর সব রাগ শেষ হয়ে যেত,মফস্যলের সহজ-সরল এই মেয়েটির কাছে মামা ছিলেন স্বপ্নের রাজপুত্র। তাই তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা তিনি কখনোই ভাবতে পারেন না যত কিছুই হোক,যত কষ্টই দিক...তুই এখন যার বাসায় উঠবি সে তোর বাবার সেই বউ এর ভাই,ঐ মহিলার অনুরোধেই মামা তোকে ওখানে পাঠাচ্ছে,ঐ মহিলা চান মামা সুখে থাকুক আর মামা চান তুই সুখে থাক...তাই তোর স্বপ্ন পূরন হচ্ছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে জারা,আস্তে আস্তে কান্নার বেগ যেন বাড়ছে।

নীপার চোখও বার বার ভিজে উঠছে,জারার পাশে বসে আস্তে করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল,আদর পেয়ে জারা নীপাকে জড়িয়ে শিশুর মতো কাঁদতে লাগল, --আপু,কেন এমন হলো,আব্বু...যে আব্বুকে আমি এতো ভালোবাসি সেই আব্বু এমন একটা কাজ কিভাবে করল?জা্নো আপু,আমি আম্মুর থেকে আব্বুকেই বেশি পছন্দ করতাম,আব্বুকে বেশি কাছের ভাবতাম,আর সেই আব্বু...যাইহোক এত বছর পর আবার কেন এটা আমার সাথে জড়ালেন?এত বছরেও তার ভুলের অনুভুতি তার ভেতর জাগেনি?... একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নীপার বুক থেকে... --আমার কষ্ট কোথায় জানিস জারা?মামা এখনো বড় মামীর প্রতি অবিচার করছেন,তিনি ঐ মহিলাকে এখনো মনে রেখেছেন,বড় মামীর ভালোবাসার কোন মূল্যই মামা দিলেন না। আমি নিজেও একটা মেয়ে জারা,বড় মামীর জায়গায় নিজেকে দাড় করালে বুকটা ফেটে যায় আমার,কি পেলেন তিনি ভালোবাসার বিনিময়ে? বিশ্বাসের কি মূল্যটা পেলেন তিনি?অথচ জানিস,আমাদের পরিবারের অনেকেই আছেন,যারা মামীকে দোষ দেয়,বলে নিশ্চয়ই ওরই কোন দোষ ছিল,স্বামীর মন জয় করতে পারেনি,অথচ আমার কি মনে হয় জানিস?বড় মামাই আসলে মামীর যোগ্য না। --আমি এখন কি করব আপু?কেমন করে আমি সব ফেস করব? তুমি এত দূরের হয়েও আম্মুর কষ্ট বুঝেছ অথচ আমি আম্মুর এত কাছে থেকেও বুঝিনি...আমি ও তো মেয়ে আম্মু কিভাবে সহ্য করছে এসব?!এত গুলো বছর...আর আমি কেমন করে ওখানে যাব?কেমন করে ঐ মানুষ গুলোকে সহ্য করব?...আমি পারব না আপু...কোনভাবেই না... বলতে বলতে আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল জারা,নীপা জড়িয়ে ধরে রাখল জারাকে,সে জানে না কাল সকালে কি হবে...কি জারার জীবনে?কি হবে এই বাড়ির মানুষ গুলোর জীবনে...একদিকে স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্ট অন্যদিকে এত দিকে এত বছরের চাপা দেয়া কষ্ট...কোনটা বেশি?...জানেনা নীপা... জারার দিকে তাকায় নীপা, স্বপ্ন ভঙ্গের পরের ক্ষণ গুলো কেমন হয় তা কি জারা জানে?...  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.