শ্রদ্ধা আর মমতাই তোমাকে জয়ী করতে পারে; তুমি তোমার জ্ঞান প্রয়োগ কর।
"জাতিতে জাতিতে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বস্থাপন, স্থায়ী সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি বা হ্রাসকরণ, এবং শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠান ও প্রবর্তনের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি সর্বোচ্চ কিংবা সর্বোৎকৃষ্ট কাজ করে থাকবেন, তার জন্য এক অংশ..." —১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্বে এভাবেই শান্তি পুরস্কারের কথা ব্যক্ত করে যান আলফ্রেড নোবেল তাঁর উইলে।
একজন রসায়নবিদ বিজ্ঞানের পাশাপাশি শান্তিকেও কেন বেছে নিলেন পুরস্কারের বিষয় হিসেবে, সঠিক জানে না কেউ; নোবেল নিজেও কিছু বলে যাননি এ ব্যাপারে। নিজের যুগান্তকারী সৃষ্টি ডাইনামাইট পৃথিবীতে শান্তি আনয়ন করবে বলে বড় যে বিশ্বাস ছিল তাঁর, সেটি যখন বরং ধ্বংসাত্মক হয়ে আঘাত করলো হৃদয়ে, তখন নিশ্চয়ই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন,নিরবিচ্ছিন্ন শান্তিই হবে মানবজাতির চূড়ান্ত অর্জন।
শুধু বিষয় হিসেবেই নয়, শান্তি পুরস্কার নির্বাচক সমিতি নিয়েও বিশ্বকে অবাক করেন নোবেল, মাতৃভূমিক সুইডেনকে রেখে এর ভার দেন নরওয়ের সংসদের উপর।
১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে জীবনের শেষ দিনগুলোতে, নোবেল যখন তাঁর উইলের পরিকল্পনা করেন, নরওয়ে-সুইডেনের রাষ্ট্রীয় সংঘ—যাতে নরওয়ে একপ্রকার সুইডিশ শাসনাধীনই ছিল—পতনের মুখে, দু'দেশের মধ্যে বিরাজ করছে উত্তেজনা। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে, নরওয়ের উপর দায়িত্ব দেয়া তুলনামূলকভাবে ভালো সিদ্ধান্ত, কারণ সুইডেনের মতো সমরবাদী ইতিহাস নেই নরওয়ের (মাথাপিছু মারণাস্ত্র রপ্তানীকারী দেশ হিসেবে সুইডেনের অবস্থান বর্তমানে দ্বিতীয়), শান্তিপূর্ণ মধ্যস্থতা ও আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত নিরসনই মূল লক্ষ্য থাকে তার। তবে এ বছর লিবিয়াতে নরওয়ের বোমারুরা সবচেয়ে বেশি বোমা ফেলে তাদের জাতীয় ঐতিহ্যে বিরাট কালিমা লেপন করে দিয়েছে, যা জ্বলজ্বল করবে আগামী বহু যুগ।
উইল অনুযায়ী, নরওয়ের সংসদ পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নোবেল কমিটি নিয়োগ করে, যার সদস্যগণ বিভিন্ন মনোনয়ন বাছাই করে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী নির্বাচিত করেন। বোমারুদের মতো না হলেও বিজয়ী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির সিদ্ধান্ত প্রায়ই জন্ম দিয়েছে বিতর্কের।
২০০৯ সালে, ওভাল অফিসে বসতে না বসতেই, বারাক ওবামার নোবেল পাওয়া ছিল বিস্ময়; এর পরের বছরই চীনের ভিন্ন মতাবলম্বী নেতা লু জিয়াবাওকে পুরস্কার প্রদান বিশ্বকে সমালোচনায় করেছে দ্বিধাবিভক্ত, চীনের সাথে নরওয়ের কূটনৈতিক সম্পর্ক ব্যাহত হয়েছে মারাত্মক। এখন দাবি উঠছে কমিটির সদস্য নিয়োগ পদ্ধতিটি বাতিলের, কারণ রাজনৈতিক দলগুলো সংসদে তাদের অবস্থানের ভিত্তিতে দলের প্রাক্তন কোনো নেতাকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে, ফলে পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ উঠে এবং পুরস্কারটিকে নরওয়ের পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন হিসেবে দেখার অবকাশ থাকে, যদিও সদস্যগণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গোপনে সম্পন্ন করা হয়। অভিযোগ অবশ্য অসততার নয়, মানবীয়তার—সদস্যগণ আবেগসম্পন্ন মানুষ এবং তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ রয়েছে।
গত শুক্রবার কমিটি এ বছরের বিজয়ী নির্বাচন করে ফেলেছে, আগামী শুক্রবার ঘোষণা। নানা সমালোচনায় চাপের মুখে থেকে সর্বজনগ্রাহ্য কোনো বিজয়ী নির্বাচন করা অবশ্য খুব সহজ কাজ নয়, তবে কমিটির সভাপতি থরবিয়র্ন ইয়াগলান্দের ভাষ্যমতে, এ বছর বিজয়ী নির্বাচন করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি।
এ থেকে আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এ বছর পুরস্কার পেতে যাচ্ছে তিউনিসিয়া ও মিশরের আরব বসন্তের সূচনাকারীগণ। ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করলে এগিয়ে থাকবেন,
১. তিউনিসিয়ার ২৭ বছর বয়স্কা ব্লগার লিনা বেন মেহেনি
২. মিশরের ৩৩ বছর বয়স্কা নেত্রী ইশরা আবদেল ফাত্তাহ
তবে দুদেশের জনগণ, বিশেষ করে তিউনিসিয়ার জনগণ, পুরস্কার পেলে সবচেয়ে যথার্থ হবে।
রাশিয়ার মানবাধিকার সংস্থার নেত্রী সভেতলানা গান্নুশকিনাও (৬৯) জোরালো প্রার্থী। তবে রাশিয়ার সাথে দীর্ঘ দরকষাকষি করে ব্যারেন্টস সাগরে নরওয়ে সম্প্রতি ১৭৫,০০০ বর্গমাইলের বিশাল যে জলসীমানা পেয়েছে তেল ও খনিজ আহরণের জন্য, তাতে দু'দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন ভালো; কাজেই ভিন্নমতাবলম্বী সভেতলানাকে নির্বাচিত করা কমিটির জন্য সহজ হবার কথা নয়, বিশেষ করে লু জিয়াবাওসংক্রান্ত বিতর্কের পর।
আফগানিস্তানের চিকিৎসক ও মানবাধিকার কর্মী সীমা সামের-এর (৫৪) নামও শোনা যাচ্ছে বেশ।
তবে আরব বসন্ত এতই চমকপ্রদ যে সীমা সম্ভবতঃ আরও এক বছর অপেক্ষা করলেও সমস্যা নেই।
বহু বছর আগে সক্রেটিসের জবানবন্দিতে প্লেটো বলেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের নিজেদের মঙ্গল করার ক্ষমতা নেই। যুক্তিটি এরকম, সাধারণ যেসব মানুষের ভূমি আছে, নিজেদেরকে তারা ভূমিহীন মানুষ থেকে পৃথক করে ফেলবে; সাধারণ যাদের ভুমি আছে তারা আবার নিজেদের মধ্যে পার্থক্য করবে কম ভূমি আর বেশি ভূমির মালিক হিসেবে। এভাবে মানুষ নিরন্তর বিভাজন হবে শ্রেণীতে, এবং চূড়ান্তভাবে গুটি কয়েক মানুষের হাতেই থাকবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা।
প্লেটোর আড়াই হাজার বছর পর এক দেশে গরীব এক ফেরিওয়ালার জিনিসপত্র কেড়ে নেয় নগরকর্তার লাঠিয়াল বাহিনী, নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ করে তাকে নিয়ে।
অপমানে অভিমানে নিজের শরীরেই আগুন ধরিয়ে দেয় ফেরিওয়ালা, ক্ষুদ্র সাধারণ মানুষের কী-ই বা করার আছে। মৃত মানুষদের নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় না, কিন্তু প্লেটোকে ভুল প্রমাণ করে ক্ষুদ্র একজন মোহাম্মদ বু আজিজি'র আত্নাহূতি পৃথিবীর ইতিহাসের পথই পরিবর্তন করে দিতে পারে কখনো কখনো। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।