আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুমূর্ষ ব্যক্তির আত্মকথা

একদিন বসার ঘরে বসে পত্রিকা পড়ছি। এমন সময় এক ব্যক্তি উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে আমার সামনে মেঝেতে বসে পড়লো। আমি সোফায় বসার ইঙ্গিত করলেও সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। চেহারা মলিন, হতাশার ছাপ চোখেমুখে। মনে হলো শেয়ার বাজারে সর্বস্ব খুইয়েছেন অথবা প্রেমে চরম ব্যর্থ এক যুবক।

আমি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই তিনি প্রশ্ন করলেন- আগন্তুক : স্যার, একটি প্রশ্ন করতে চাই। উত্তরটা জানা আমার খুবই জরুরি। আমি : ঠিক আছে। উত্তরটি আমার জানা থাকলে আমি অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করবো। আগন্তুক : স্যার, আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।

আমি : তার মানে কি? আগন্তুক : আমি মারা যাচ্ছি। আমি : ডাক্তার দেখিয়েছেন? তারা কি বলেছেন? আগন্তুক : ডাক্তাররা বলেছেন, এ রোগের চিকিৎসা নেই। আমি : তাহলে… বিদেশে গিয়ে চেষ্টা করতে পারেন! আগন্তুক : না, ডাক্তাররা বোর্ড গঠন করে বলে দিয়েছেন, বিদেশে গেলেও কাজ হবে না। আমি : আল্লাহ তো আছেন। তাকে ডাকেন।

নিশ্চয়ই তিনি আপনাকে সুস্থ করে দেবেন। আগন্তুক আমার দিকে চরম বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। মনে হচ্ছে অনেক দূরের কোন বস্তু তিনি গভীর মনযোগ দিয়ে দেখছেন। বললেন- আগন্তুক : আমি যদি মরে যাই, তবে কি প্রমাণ হবে আল্লাহ নেই? আমার টনক নড়লো। বুঝলাম চেহারায় বিধ্বস্ত হলেও গভীর জ্ঞানী ব্যক্তি।

চাপা মেরে পার পাওয়া যাবে না। বললাম- আমি : ঠিক বলেছেন। এবার আসল কথায় আসুন। আপনি একটি প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন। আগন্তুক : "আমি যেদিন বুঝতে পারলাম যে মারা যাচ্ছি, সেদিন আমার ভীষণ মন খারাপ হয়।

ঘর থেকে বের হইনি। বেশ কিছুদিন নিজের কক্ষে বন্দী হয়ে ছিলাম। কোন কিছুই ভালো লাগছিল না। শুধু হতাশা আর যন্ত্রণা… হঠাৎ একদিন নিজের মনকে প্রবোধ দিলাম- আর কতদিন এভাবে মৃত্যুর প্রহর গুণবো? মনে দৃঢ়তা এনে একদিন ঘর থেকে বেরিয়ে কাজে যোগ দিলাম আর দশটি প্রাণীর মতো। " "কিন্তু এবার আগের তুলনায় আমার আচরণে আকাশ পাতাল পরিবর্তন এলো।

কারণ, আমি মারা যাচ্ছিলাম এবং বাকি কারো মনে মারা যাওয়ার কোন চিন্তা ছিল না। " "ভীষণ দয়ালু হয়ে গেলাম। অন্যদের খারাপ কাজ, মিথ্যা কথা, পরচর্চা, পরনিন্দা, হত্যা, লুণ্ঠন, পরকিয়া, ব্যাভিচার… ইত্যাদি দেখলে বা শুনলে আগে যেমন গা ঘিন ঘিন করে উঠতো, সেরকম আর হতো না। অনুভূতিহীন হয়ে পড়লাম। কারণ, আমি যে মারা যাচ্ছি।

এসবে আমার আর কোন লাভ বা ক্ষতি নেই। " "আমার টাকা মেরে দিয়ে যে চলে গেল, তার জন্যও অভিশাপ দিতে মন চাইলো না। মনে হলো, থাক না, আর তো মাত্র দু’দিন। তারপর ওই টাকা দিয়ে আমারই বা কি হবে। তার চেয়ে বরং ও একটু ভালো থাক।

আমি তো মরে যাচ্ছি। ও হয়তো অনেকদিন বেঁচে থাকবে। " আমার বসার ঘরে দামি কার্পেট। বিদেশ থেকে আনা। সেদিকে তাকিয়ে এক মনে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিলো আগন্তুক।

এবার মাথা তুলে আমার মুখের দিকে তাকালো- আগন্তুক – আপনার সময় নষ্ট করছি আমি… আমি – না, না, আপনি বলুন। আমার এই মুহুর্তে জরুরী কোন কাজ নেই। আগন্তুক : "আমি আমার দৈনন্দিন কাজগুলো পুনরায় রুটিন মাফিক করতে লাগলাম। কিন্তু এবার আমার মনের মধ্যে কোন ভয়, শঙ্কা, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা… কিছুই ছিল না। সবার সঙ্গে সবার মতো মিশতাম, কিন্তু কারো ক্ষতি করার চিন্তাও করতাম না।

সবাইকে ভালোবাসার চেষ্টা করতাম। " "…বিয়ের অনুষ্ঠান দেখলে বর কনের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করতাম ওদের দাম্পত্য সুখের জন্য। শুধুমাত্র ভিক্ষুক দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যেত। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিতাম এবং হাতে যত টাকা উঠে আসতো ভিক্ষুককে দিয়ে দিতাম। কারণ, আমার কোন চিন্তা ছিল না, আমি যে মারা যাচ্ছি।

কী হবে এসব টাকা পয়সা দিয়ে ?" আমি বোকার মতো প্রশ্ন করলাম : তারপর? আপনার সেই রোগের কি হলো? ভালো হয়ে গেলেন? মনে হলো আমার কথা তিনি শুনতে পাননি। আগের কথার রেশ ধরে বলতে লাগলেন- "দেখলাম, ধীরে ধীরে আমি একজন আদর্শ মানুষ হয়ে গেছি। বিবেকের তাড়ণা আর আমার মধ্যে নেই। দিনের শেষে নিজেকে একজন পরিতৃপ্ত মানুষ মনে হয় যার কোন অনুশোচনা নেই। " "এবার আমার সেই প্রশ্ন-" তিনি ঘাড় কাত করে আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকালেন।

আগন্তুক : মৃত্যুভয়ে আমি ভালো হয়ে গেছি। আল্লাহ কি আমার এই ভালো হওয়া গ্রহণ করবেন? আমি : হ্যা, আমি যতটুকু পড়াশুনা করেছি বা আলেমদের কাছে শুনেছি, আল্লাহ মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তার বান্দাদের ভালো হয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। তিনি প্রতি মুহুর্তে চান মানুষ তওবা করে ভালো হয়ে যাক। আগন্তুক : বুঝলাম না। একটু বুঝিয়ে বলুন।

আমি এবার আল্লাহর সঙ্গে অভিশপ্ত শয়তানের একটি কথোপকথোন তুলে ধরলাম। বললাম, ফেরেশতাদের চেয়ে মানুষের মর্যাদা বেশি। কারণ, আদি পিতা আদমকে সব ফেরেশতা সেজদা করেছিলেন, কিন্তু জিন থেকে ফেরেশতাদের সর্দার বনে যাওয়া ইবলিস মানুষকে সেজদা করেনি। এ কারণে সে অভিশপ্ত শয়তান হয়ে যায়। তখন সে আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করে, আমি যখন আপনার বেহেশতে যেতে পারলাম না, তখন যার কারণে আমার বেহেশতে যাওয়া হলো না, সেই আদমের সন্তানদেরও আমি বেহেশতে যেতে দেবো না।

তাদেরকে আমি নাফরমানির পথে নিয়ে যাবো। আল্লাহ বললেন, তুই নাফরমানির পথে নিয়ে যাবি, আর আমার বান্দা যখনই তওবা করবে, তখনই আমি তার সব গোনাহ মাফ করে দেবো। শয়তান বললো- আমি আবার তাকে খোদাদ্রোহী করবো। আল্লাহ বললেন, আমি আবার তার তওবা কবুল করবো। শয়তান বললো- আমি আবার তাকে বদকার লোকে পরিণত করবো।

সন্তান অবাধ্য হওয়া সত্ত্বেও মা যেমন তার পক্ষে সাফাই গায়, তেমনি আল্লাহ তার বান্দার পক্ষ নিয়ে বললেন, আরে শয়তান, আমি বান্দার মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তওবার দরজা খোলা রাখলাম, দেখি তুই কি করতে পারিস, হতচ্ছাড়া… আগন্তুক এবার হাত উঠিয়ে আমাকে থামিয়ে দিলেন। মনে হলো, এই গল্প তার অনেক দিনের জানা। স্বগোতক্তির মতো বলে উঠলেন- "কিন্তু মৃত্যুর আগ মুহুর্তে যদি বান্দা তওবার সুযোগ না পায়? এই দেখুন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। মিশুক মুনির আর তারেক মাসুদরা কি তওবার সুযোগ পেয়েছিল? যে ব্যক্তিকে ঘুমের মধ্যে জবাই করে হত্যা করা হচ্ছে, তিনি কি তওবা করার সুযোগ পান? আল্লাহ তো সুযোগ দিয়েছেন, বান্দা কি তা গ্রহণ করার অবস্থায় আছে?" এবার উঠে দাঁড়ালেন তিনি। জানেন, এ প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই জেনেও প্রতি মুহুর্তে বিভ্রান্তির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি।

আমার দিকে হাত নাড়িয়ে বাইরের দিকে পা বাড়ালেন। হঠাৎ আমার মনে হলো, আমার আসল কথাটিই জানা হয়নি। আমি : বলে গেলেন না, আর কতদিন আছেন আমাদের মাঝে? ডাক্তাররা কি কোন তারিখ বলে দিয়েছেন? আগন্তুক : ডাক্তাররা তারিখ বলতে পারেননি। তবে বলেছেন, একদিন থেকে কয়েক হাজার দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে। হাতে থাকা মুঠো ফোনেই ক্যালকুলেটর আছে।

এক নিমিষে হিসেব কষলাম, কয়েক হাজার দিনে কত বছর হয়। দেখলাম, আগন্তুকের চেয়ে আমার সময় বেশি নেই। আমরা দুজনই প্রায় একই সময়ে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো। জিজ্ঞাসা করলাম- - আপনার অসুখটি কি? - আমার কোন অসুখ নেই। আমি সুস্থ মানুষ।

তার এ উত্তর শুনে হতভম্ভ হয়ে গেলাম। হতভম্ভের চেয়ে কঠিন কোন বাংলা শব্দ মনে পড়ছে না আমার সে অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্য। সে অবস্থায়ই জানতে চাইলাম- - তাহলে এতক্ষণ ধরে এত কথার কি মানে থাকতে পারে? - স্যার, মনে কিছু করবেন না, হঠাৎ একদিন আমার মনে হলো, আমাকে তো একদিন মরতেই হবে। ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার, এমন কোন ওষুধ আছে কি যা দিয়ে মৃত্যুকে জয় করা যায়? ডাক্তার সাহেব বললেন, না।

আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, বিদেশে গেলেও কি কাজ হবে না? ডাক্তার সাহেব এবারও নেতিবাচক জবাব দিলেন। ... স্যার, পরে বুঝলাম, আমার মৃত্যু হবেই, আজ না কাল, নাকি দুই বছর পর কিংবা বিশ বছর পর, সেটি কি খুব গুরুত্বপূর্ণ? এ কথা বলতে বলতে গভীর চিন্তামগ্ন মনে হাসতে হাসতে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চলে গেলেন তিনি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.