প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল এটা মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের বই ‘স্কুলের নাম পথচারী’র সাথে কোনভাবে সম্পর্ক-যুক্ত নয় । এই বইটা আমার খুবি পছন্দের একটা বই এবং নামটাও চমৎকার । আর যেহেতু আমি একটি অজপাড়া গাঁ-এর পথের ধারের স্কুলের গল্প বলব সেহেতু নামটাকে খুব মানাসই মনে হচ্ছে । তো যাত্রা হলো শুরু-
আমি কোন বিশেষ কেউ নই,নিতান্তই সাধারন একজন মানুষ । এটা আমার জীবনের গল্প অথবা বলা যায় এটা আমার মত সাধারন কিছু মানুষের বেড়ে উঠার চিরায়ত গল্প ।
ছোট বেলা খুবি দুরন্ত টাইপের ছিলাম । সারাদিন টইটই, দৌড়া-দৌড়ি, এর ছেলে তার মেয়েকে পিটানো আর খেলা,খেলা আর খেলা । বয়েস যখন ৬
“৬ বৎসর বয়স হইসে আর ছাড়ন নাই ।
ইস্কুলেতে যাইতে হইব মনে রাখা চাই । “
কুদ্দুস বয়াতি ফিচারিং হুমায়ুন আহমেদর গানে আব্বার টনক নড়ল ।
ছেলে উপযুক্ত হয়েছে, এবার তাকে স্কুলে ভর্তি করা হোক (এখন ২৬ চলছে কিন্তু আজ অব্দি আব্বা বললেন না ছেলে উপজুক্ত হয়েছে এবার বিয়ে করানো হোক…আফসুস )। কিন্তু আম্মাদের ফ্যামিলীতে একটা ট্রাডিশান আছে যে বাচ্চা-কাচ্চাদের প্রাথমিক শিক্ষার ঞ্জান ঘরেই দিয়ে দেওয়া হতো । এই দিক দিয়ে আম্মা ছিলেন চ্যাম্পিওন ! তিনি কখনো স্কুলে যান নি, সরাসরি প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরিক্ষা দিয়েছিলেন ১২ বছর বয়েসে । মামাদেরও বুবু-নানাভাই প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই দিয়েছিলেন । আম্মা তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রাখলেন ।
অন্তত ভাইয়ার বেলায় তিনি সফল ছিলেন ভাইয়াকে ক্লাস ফাইভে স্কুলে দিয়েছেলেন । আমার বেলায়ও একি আইন বরাদ্ধ থাকল । আব্বার জোরাজোরিতে কাজ হলো না ।
কিন্তু আমাকে ঘরে রেখে পড়ায় সাদ্ধ কার ? একেক জন গৃহশিক্ষক আসেন আর আমার জ্বালায় টিকতে না পেরে জান নিয়ে পালান । কিছু উদাহরন দেওয়া যাক -
ভাইয়াকে একজন স্যার পড়াতেন, ফ্রী হিসেবে আমাকেও হাতে খড়ি দেওয়ার দায়িত্ব তার উপর বর্তালো ।
উনার একটা বিশেষ সংশোধণি ছিল, ভাইয়া পয়তাল্লিশ লিখলে বা বললে উনি প্রত্যেক বার সংশোধণ করে চিৎকার করে বলে উঠতেন ‘পয়তাল্লিশ নায় পাঁচচাল্লিশ’ । তো আমার দাদাবু(দাদাজী)র একটা লাঠি ছিল হাতার দিকটা বাঁকানো । উনি ওই লাঠি দিয়ে বাড়ির সব বান্দরদের শায়েস্তা করতেন । আমিও উত্তরাধিকার সুত্রে মাঝে মাঝে এটার পৃষ্ঠপোষকতা পেতাম এবং নিজেও ব্যবহারও করতাম… । একদিন স্যার পড়িয়ে চলে যাচ্ছেন ।
আমার মাথায় বাঁদরামি চাপল । লুকিয়ে লুকিয়ে স্যারের পিছনে গিয়ে গলায় লাগিয়ে দিলাম হ্যাচকা টান । বেচারা এরপর আর আসেন নি আমাদের বাড়িতে ।
আর একজন ছিলেন হুজুর । যেহেতু হুজুর মানুষ, তাই পড়াতেন বাহির ঘরে ।
তিনি বিকালে আসতেন । আমার মতো বাহিরমুখী বিচ্ছুকে বিকেল বেলা বাঁদরামির পিক আওয়ারে আটকে রাখা কার সাদ্ধি ? ১০ মিনিট পড়েই আমার বাথরুম চাপত । মুখটা কাচুমাচা করে এমনভাবে বলতাম যেন ছুটি না দিলে ওই মুহুর্তেই অঘটন ঘটিয়ে দিব । অতএব ছুটি দিতেই হয়, আমি বাড়ির ভিতরে গিয়ে সেই যে গুম হতাম আর ফিরে আসতাম না । বেচারা হুজুর অনেক ক্ষন অপেক্ষা করে গলা খাকারি দিতেন, এতদুর থেকে সেটা স্পস্ট শোনাও যেতো না ।
অবশ্য উনি আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতেন সেটা আমার জন্য না চা-নাস্তার জন্য উনিই ভাল জানতেন ।
আর একজনকে এলিমিনেট করেছিলাম উনার দুষে । উনি কথায় কথায় খালি মাথায় গাট্টা মারতেন । একদিন বীজী(দাদিকে আমরা বীজী দাকতাম)র সামনে আমাকে গাট্টা মারলেন স্যার । আমাকে বীজী অনেক আদর করতেন ।
আমিতো ভাবলাম এই সুজুগ স্যার হাতেনাতে ধরা খেলেন আর আমি দিলাম গগন-বিদারী চিৎকার । আমার চিৎকার দেখে বীজীও দিলেন চিৎকার
-আমার নাতিরে মারি লাইলো হারামজাদায়…!!!...
বেচারা স্যার পুরো অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন । ওই দিনই উনার শিক্ষাদান কার্য্যক্রম স্থগিত ঘোষনা করলেন বীজী ।
এই ছেলেকে যে বাড়িতে রেখে পড়ানো যাবে না সেটা সবাই ভালভাবে বুঝতে পারলেন । তাই একটি শুভদিন দেখে আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হলো ।
ওই দিন সকাল থেকে আমি লাপাত্তা । অনেক কষ্টে আমাকে খুজে বের করলেন আব্বা । উনি যেহেতু একজন শিক্ষক মানুষ তাই শিক্ষা দিতে গিয়ে আমাকে হালকা উত্তম-মধ্যমও দিলেন । অবশ্য ভাইদের মাঝে আমিই আব্বার পৃষ্ঠপোষকতা বেশি পেয়েছি । আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আব্বা, বীজী, চাচাতো ভাই,গ্রামের বাচ্চা-কাচ্চার এক বিশাল দল রওয়ানা দিল ।
ক্রন্দনরত আমি আর হাতে বেত নিয়ে আব্বার নেত্রীত্বে এক বিশাল কাফেলা ছুটল শংকরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়’র দিকে ।
ওই স্কুলে আব্বার বন্ধু প্রিন্সিপাল মামার( বড়মামা,ছোটমামা,মেঝোমামা আর প্রিন্সিপাল মামা । উনি ছিলেন আমাদের কলেজের প্রিন্সিপাল আর আম্মার পাতানো দাদাবাবু তাই এহেন নাম করন )বোন শিপ্রা পিসি ওই স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন । প্রথমদিন উনার রুমে নিয়ে আমাকে বসালেন । রুম বলতে বৃত্তির কোচিং করাতেন যে ক্লাসরুমে সেটা আর কি ।
আমাকে ভর্তি করা হল ক্লাস থ্রি’তে । প্রথমদিন হিসেবে সেদিন আর আমি ক্লাসে গেলাম না । ছুটির পর বাড়ি চলে গেলাম । পরের দিন আমাকে নিয়ে আমার ক্লাসরুম অর্থাৎ থ্রি’তে বসানো হল । প্রথম ক্লাস করান অর্থাৎ ক্লাস টিচার ডাহুক স্যার … ।
উনার এরকম নামকরনের সার্থকতা হলো উনি সারা বছর প্যান্টের মুড়ি ভেঙ্গে প্রায় থি-কোয়ার্টার করে পরতেন । এর ফলে উনার লম্বা টিংটিঙ্গা পা দুটো বের হয়ে আসত । আর উনি লম্বাও ছিলেন অনেক । তো ডাহুক স্যারের গাধা পিটিয়ে গরু বানানোর রেকর্ড বেশ উজ্জ্বল । মানুষ গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানায়, উনি এমন পিটানো পিটাতেন যে ছেলে গুলো ভয় পেয়ে স্কুল ছেড়ে দিয়ে হালচাষে লেগে পরত ।
অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থেই গরু হয়ে যেত ।
প্রথমদিন প্রথম ক্লাস, হাতে বেড়া দেয়ার বাঁশ (গ্রামে বলা হয় গরসি) নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন ডাহুক স্যার । রুল-কল করে আসলেন হোমওয়ার্ক ধরতে । অনেকেই এনেছে,অনেকেই আনে নি । আমি তো জানিই না ।
প্রথমেই আমাকে ধরলেন ।
আমি তো হা করে তাকিয়ে আছি ।
উনি আবার জিঞ্জেস করলেন ।
আমি যথারিতি ভেবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে আছি । উনার মুখে দেখলাম একটা জগত জয়ের হাসি ।
শিকার ধরার জন্য আমার সমান ‘গরছি’ হাতে এক লাফে চলে আসলেন আমার সামনে । আমি তো এত বড় বাশ দেখে চোখে সরষে ফুল দেখছি । উনি তার মাহান দায়িত্ব পালন করতে যাবেন ঠিক তখন একটা ছেলে দাঁড়িয়ে বলল
-স্যার সে আজ প্রথম স্কুলে এসেছে ।
নিশ্চিত গ্রাশ মুখের সামনে থেকে চলে গেলে ক্রুদ্ধ শিয়াল যেভাবে তাকায় উনি তার দিকে এভাবে একবার তাকালেন আর আমার দিকে একবার তাকালেন । জিঞ্জেস করলেন
-এতদিন আসিস নি কেনো ?
আমি ঢুক গিলে বললাম
-স্যার আমি কাল ভর্তি হয়েছি ।
তার পর উনি হতাশ হয়ে আমার নাম,বাবার নাম ইত্যাদি জিঞ্জেস করলেন । আব্বাকে চিনে আর একটু হতাশ হলেন কারন উনি পাশের হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং স্থানিয় প্রভাবশালি ব্যক্তি । অবশ্য এ ব্যপারে আব্বা বোধয় সায়ই দিতেন ।
এর পর ক্ষুধার্থ স্যার উনার ডিউটিতে লেগে গেলেন । এই প্রথম চোখের সামনে গাধা পিটিয়ে গরু বানানোর প্রক্রিয়া দেখলাম আর থরথর করে কাঁপতে থাকলাম ।
ঐ দিন মনে মনে আল্লাহ্র কাছে দুয়া করতে থাকলাম যদি আজ বেচে বাড়িতে যেতে পারি তাহলে ঠিক মতো বাড়ির স্যারের কাছে পড়ব ।
এর পর প্রতিদিন আমার সকালের রুটিন স্কুল টাইমে আমি নিরুদ্ধেশ । যথারিতি আব্বার পিটুনি খেয়েছি কারন উনিও তো শিক্ষক ছিলেন । কিন্তু ক্লাস থ্রি’তে আর স্কুলে খুব কমই গিয়েছি । ক্লাস ফোরে উঠেই সুখবর ডাহুক স্যার ট্রান্সফার ! আমদের খুশি দেখে কে ।
আমিও তখন অভয় পেয়ে স্কুলে জেতে
থাকলাম । তবে ডাহুক গেলে কি হবে হ্যাড স্যার অর্থাৎ ট্যাঁরা স্যার তো ছিলেন । উনার বিশেষত্ব ছিল দুই চোখ দুই দিকে ফোকাস করে থাকত সব সময় । এর ফলে তিনি কোন দিকে তাকাতেন বেশির ভাগ সময়ই বোঝা যেত না । এটা উনার জন্য বিরাট সুবিধার ছিল ।
১৮০˚ কোনে সারা ক্লাস উনি নজরদারিতে রাখতে পারতেন । উনারও ছাত্র পৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তর সুনাম ছিল । আমার উপর অবশ্য কোনদিন হাত তুলেন নি । কিন্তু চোখের সামনে উনার কর্মকান্ড দেখে প্রতিদিনই গলার মধ্যে শাহারা মরুভূমি হয়ে যেত ।
প্রতিদিন ৯টার সময় ক্লাসে এসে আমরা উত্তরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম আর দুয়া করতাম স্যার যেন আজ না আসে ।
কারন ঐ জানালা দিয়ে উনার বাড়ি পর্যন্ত দেখা যেত । বেশিরভাগ দিনই আমাদের দুয়া আল্লাহ কবুল করতেন না । এর ফলে নিজেদের বিরাট পাপী মনে হতো । মনে করার চেস্টা করতাম গতকাল কি পাপ করেছি, কাকে পিটিয়েছি, কাকে কাকে টিভি দেখতে দেই নি । টিভি দেখা নিয়ে আর একটি মজার উপাক্ষান লিখব বলে ঠিক করেছি ।
সেটা পরে কোন দিন হবে ।
যাই হোক সব যায়গায়ই খারাপ ভাল থাকে, এখানেও ছিলেন সিতেশ স্যার,পুলিন স্যার আর আমার শিক্ষা জীবনের প্রথম কোন আদর্শ শিক্ষক শিপ্রা পিসি ।
উনার বৃত্তির কোচিং ক্লাসগুলো আমাদের ভবিষ্যতে অনেক উপকারে লেগেছে ।
আমাদের স্কুলের একটা মজার বিষয় ছিল স্কুলে দপ্তরি/পিওন/দারোয়ান ছিল না । আমার মনে হয় দেশের বেশিরভাগ সরকারি স্কুল গুলোতে এখনো এই পদ গুলো নেই ।
এই কারনে ঘন্টি বাঝাতে হতো ছাত্রদের । বেশিরভাগ ক্লাস ফাইভের ছাত্ররাই এটা করত । ঘন্টি বাঝানোর একটা বিশেষ পদ্ধতি ছিল, প্রথমে ৩টা টং টং টং…এরপর একনাগারে টং টং টং টং টং টং টং টং টং টং টং টং টং টং টং এর পর শেষে একটা বড় টং ! ঘন্টিটা রেল লাইনের স্লিপার দিয়ে তৈরি তাই স্বাভাবিক ঘন্টির মতো ঢং ঢং করতো না, মিষ্টি একটা আওয়াজ বের হতো । এখনও সুরটা কানে লেগে আছে । আমিও অনেকদিন বাঝিয়েছি ।
বাঝানোর সময় একটা উত্তেজনা কাজ করত শরীরে । প্রথম দিন ছুটির ঘন্টা বাঝাতে গিয়ে উত্তেজনার ডোজ বেশি হয়ে গিয়েছিল তাই আধা ঘন্টা আগে বাঝিয়ে দিয়েছিলাম । হ্যাড স্যার দৌড়ে আগে বের হয়ে এসেছিলেন বলে সবাই যেতে পারে নি । তবে আমি সবার ভিরে লুকিয়ে গিয়েছিলাম তাই চিনতে পারন নি বলে রক্ষে পেয়ে গিয়েছিলাম ।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।