আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুঃসহ তম ১২০ মিনিট (প্রায়)- জীবনটা কত গুরুত্বপূর্ণ, বুঝেছি এই সময়টাতে।

জীবন আসলে চিল্লাপাল্লা ছাড়া কিছুই না। সেটাই করতে চাই, মনের সুখে, ইচ্ছা মতন। আমার সংঘটনের (চোখ ফিল্ম সোসাইটি’র) ইফতার মাহফিল ছিল গত কাল, হরতাল হলেও দিনের বেলায় প্রচুর গাড়ী ঘোড়া চলাচলের কারণে মাহফিলের ডেট পরিবর্তন করা হয় নাই। তো, অনুষ্ঠান শেষে বন্ধুবান্ধব মিলে ১ কিলো রাস্তাটা হেটেই আসছিলাম (আমি শাবিপ্রবির বিখ্যাত ১ কিলো রাস্তার কথা বলছি)। ঐ দিন একটা ম্যাগাজিন পাবলিশ করার ভার পরছিল আমার উপর।

এর জন্য সারাদিন দৌড়ঝাঁপ পেড়ে আসলেই অনেক ক্লান্ত ছিলাম, তাই হাঁটার গতিটাও ছিল অনেক কম। এক একটা জিনিসই মনে হয় গত কাল আমাদের জীবনটা বাঁচিয়ে দিয়েছে, মিছিলের মাঝখানে পরে যাই নি। ভার্সিটি গেটে এসে সব কিছু নর্মালই দেখছিলাম। এর মাত্র ১০ সেকেন্ডের মধ্যে সব চিত্র পালটে গেল। ৮ দিক থেকে লোকজন বিভিন্ন অস্র-পাতি নিয়ে কোথা থেকে যেন হাজির।

সাথে সাথে আগুন জ্বলে উঠলো টায়ারে, দোকান পাঠে, গাড়িতে (এত দ্রুত আগুন জ্বালানোর প্রক্রিয়াটা শিখতে পারলে ভাল হত, গ্রামীণ মহিলাদের অনেক কষ্ট লাগব হয়ে যেত)। মানুষ কোথা থেকে এল, ব্যানার কোন জায়গা থেকে এল, সাথে সাথে টাক ওয়ালা, দাঁড়ি ওয়ালা, পাঞ্জাবি ওয়ালা লোকজনই বা কোথা থেকে নাজিল হল সবই এখনো স্বপ্নের মতো লাগছে আমার কাছে। কিছুই বুঝতে পারি নি এত অল্প সময়ে। মুহূর্তে “নারায়ও তাকবীর....” “বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির জিন্দাবাদ” ধ্বনিতে রাস্তা প্রকম্পিত হল। মাঝে যারা পড়লো সবাই আক্রান্ত হল।

বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। তাই ভার্সিটির গেটের ভিতরে দৌড়ে ঢুকলাম, গার্ড গেট বন্ধ করে দিল। মিনিট খানিকের মধ্যে সেই জায়গাটাও আর নিরাপদ থাকলো না। ইট-পাটকেলের বৃষ্টি আমাদের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। এখানে বলে রাখি গতকাল ভার্সিটির আরেকটা সংঘটন “নোঙ্গর”এর ও ইফতার পার্টি ছিল।

তাই রাত ৮টার মতো বাজলেও লোকজন ক্লাস টাইমের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না, বরং অনেকাংশে বেশী ছিল। একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়ালাম। জেহাদিরা কয়েকজন গেট টপকে ভিতরে ঢুকে পরছিল। আমাদের ধাওয়া করল। আমরা প্রাণ হাতে নিয়ে ‘দে দৌড়... প্রায় অর্ধেক রাস্তা এসে দেখলাম ওরা আর আমাদের ফলো করছে না।

ইফতারির পর শক্তিতে আর কত কোলায়। আমরা জেহাদি না হতে পারি, কিন্তু মানুষ তো। ভার্সিটির দিকে আরেকটু এগুতেই দেখলাম এক লোক রাস্তায় পরে আছে, গুঙ্গাচ্ছে। রিক্সা থেকে পরে নাকি ওর পা ভেঙ্গে গেছে, রিক্সা ওয়ালা নাকি অকে ফেলে রেখেই পালিয়েছে। এই অস্থিরতার মাঝে কি করা যায় কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না।

একটা অটোরিকশা আমাদের সাথে পালাচ্ছিল ওকে আটকালাম। অটোতে লোকটাকে তুলে দিয়ে বললাম বিকল্প রাস্তা দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের থেকে ৫-৬ হাত দূরে আবার “নারায়ও তাকবীর” গর্জন উঠলো, কক্টেল ফাটল। সাথে সাথে ঝনঝন আওয়াজ, অটো রিক্সা ভাঙ্গার আওয়াজ। যেটা পা ভাঙ্গা লোকটাকে হসপিটালে নিয়ে যাবার জন্য দাঁড়িয়েছিল, সেটার।

ওরা আগে থেকে আওয়াজ দিয়ে আসে নি, আমাদের মতই হয়তো হেঁটে আসছিল। কিংবা কে বলবে, হয়তো আমাদের সাথেই ছিল। কোথায় জামাত, কোথায় শিবির কে বলে তা বহু দূর? আমাদের মাঝেই জামাত শিবির, আমাদের মাঝেই সুরাসুর। দৌড়ানোর সময় মনে হচ্ছিল যেন ফুসফুসটা মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসবে। কয়েক বার ভাবছিলাম এভাবে আর দৌড়লে কি হবে।

এমনি তো দৌড়াতে মরে যাব, এর চেয়ে বরং দাঁড়িয়ে মার খেয়ে মরি; কষ্ট কম হবে। কিন্তু জীবনের মায়াটাও ত্যাগ করতে পারিনি তখন। আমাদের মধ্যে যারা একটু স্থূল স্বাস্থ্যের অধিকারী, তাঁদের অবস্থা দেখে রীতিমত কান্না চলে আসছিল। জীবন বাঁচানোর কি প্রাণান্তকর চেষ্টা। আমরা দউরাচ্ছি, কিন্তু জানি না কোথায় যাব।

ভার্সিটির ভিতরেই বা কোন জায়গায় সেফ!!! কোন একাডেমিক বিল্ডিঙে ঢুকলেই কি আমরা নিরাপদ? বিল্ডিঙে ধাওয়া করলে তো দৌড়ে পালানোরও সুযোগ পাবো না। পাশের বন্ধু প্রস্তাব করছিল, “দোস্ত, মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নিবি?” সাথে সাথেই প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেল। ওদের কি আর ধর্ম আছে? সব কয়টা তো নাস্তিক। আমরা প্রায় ২০০-২৫০ জন মানুষ, কোথায় যাব? চিন্তা করার সময় নাই। সব চেয়ে কাছে ছিল একাডেমিক বিল্ডিং “A”, সেখানেই ঢুকে পড়লাম সবাই।

গার্ডকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সে গেট খোলা রেখে কোথায় যেন গিয়েছে। গার্ডকে খোঁজে এনে গেট আটকে দিলাম আমরা। সব লাইট অফ করে দিলাম, “ব্ল্যাক আউট”। যাতে আমাদের অবস্থান ওরা বুঝতে না পারে। এর পর প্রায় ১ ঘণ্টা অন্ধকারে উৎকণ্ঠার মাঝে বসে বসে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখলাম কক্টেল আর চকচকে ধারালো অশ্রের মহড়া।

একটু আগে সাথে যারা ছিল, এখন নেই; তাঁদের খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করছিলাম ফোনে। কোন এক অদ্ভুত কারণে নেটওয়ার্ক জ্যাম। ফোন ঢুকছে না, কোন অপারেটরেই না, খালি গ্রামীণ কয়েকটা নাম্বারে কল গেল। কেও ধরছে না ফোন, হয়তো অরাও চেষ্টা করছিল। সে কি উৎকণ্ঠা!!! জেহাদিরা স্লোগান দিতে দিতে ছেলেদের হলের দিকে মহড়া দেখাতে চলে গেল।

তবুও তেমন একটা নিরাপদ বোধ করছিলাম। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, মরলে সব এক সাথে মরি। চলেন সবাই এক সাথে বের হই, বাসায় যাই। রাত তখন ১০ টার মতো হবে, রাত যত বাড়তে থাকে জেহাদিদের দাপট তত বাড়তে থাকে। আমরা হাঁটছি, রাস্তা সুনসান... কোন যান বাহন নেই।

এত গুলো মানুষ এক সাথে তবুও কেমন যেন ভৌতিক নীরবতা। মদিনা মার্কেট পর্যন্ত হেঁটে এসে দেখলাম, কিছু দোকানও এখনো খোলা আছে। এতক্ষণ পর প্রথম বারের মতো মনে হল, আজকের মতো মনে হয় বেঁচেই গেলাম। তখন সব আজে বাজে চিন্তা মাথায় এসে ভর করল। তাঁদের মধ্যে একটা চিন্তা এমন, “আচ্ছা, যুদ্ধের সময় কি মানুষ এর চেয়েও বেশী আতংকে থাকতো?” ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.