আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি প্রামাণ্যচিত্র 'দুঃসহ সময়'



'দুঃসহ সময়' ভিও: হাত দিয়ে বলো সূর্য্যরে আলো রুধিতে পারে কি কেউ আমাদের মেরে ঠেকানো যাকে কি জনজোয়ারের ঢেউ। অত্যাচার, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও অপশক্তি কখনই সত্যকে নিভিয়ে দিতে পারেনি। সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম আকাশ তেমনই এক সত্যান্বেষী কলম সৈনিক। সত্যের জন্য লড়াই করে যাওয়া তার আজন্ম নেশা ও পেশা। যেখানে অনেকের কলম নিরব সেখানে অকুতোভয় এই সাংবাদিক জীবনকে বাজি রেখে সদাই সরব।

সত্যের শত্র“রা একানব্বই থেকে মামলা, হামলা করে নিভিয়ে দিতে চেয়েছে এই অনির্বাণ শিখাকে। কিন্তু আজও সমস্ত কালবৈশাখী, মঙ্গার মধ্যেও পদ্মাপাড়ের এই দামাল ছেলে গেয়ে যাচ্ছে সত্যের গান। হতভাগা মৃণালিনী বা দশরথ কবিরাজের কান্নাতে সাহসী এই সাংবাদিকের কলম প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল সরকার, প্রশাসনের নির্লিপ্ততা, নিস্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে। শানিত এই কলমকে চিরতরে থামিয়ে দেবার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের ভকরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম আকাশ: ২০০৭ সালের ২৩ অক্টোবর দিবাগত রাতে আমার জীবনের অন্ধকার অংশের সূচনা হয়েছিল।

রাত অনুমান একটা বা দেড়টা হবে। আমরা ঘরের মধ্যে ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ, আকস্মিকভাবে অনবরতভাবে বাজতে থাকে কলিংবেল। প্রায় ১০ মিনিট ধরে কলিংবেল বাজতে থাকে। আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠি।

অনবরত কলিংবেলের শব্দ আমাদের মাঝে আতংকের সৃষ্টি করে। আমার কোলে আমাদের চার মাস বয়সী শিশু সন্তান। আমার স্ত্রীসহ আমরা ঘরের বাইরে বেলকুনিতে এসে দেখি অনেকগুলেণা মানুষ গোটা বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছে। আমরা জিজ্ঞাসা করি, আপনারা কারা এবং কোথা এসেছেন? তখন তারা বলে যে, আমরা প্রশাসনের লোক। আমরা বলি কোন প্রশাসনের লোক? এসময় তারা বলে যে, তুই দরজা খুলে দে, বেশি বিলম্ব করলে তোর অবস্থা খারাপ হবে।

এক পর্যায়ে তারা আমাকে ছো মেরে ধরে ফেলে। তারা আমাকে এলাপাতাড়ি কিল-ঘুষি, লাথি মারতে থাকে। আমার দু’হাতে হ্যান্ডকাফ লাগায়। আমার ছোখ বেঁধে দেয়া হআে গামছা দিয়ে। এরপর ওরা আমাকে আমার মাথা থেকে গলা পর্যন্ত একটি মোটা কালো কাপড়ের টুপি পরিয়ে দিল।

তারা আমাকে মারতে মারতে নিয়ে গেলো র‌্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব-৫ রাজশাহীর সদর দপ্তরে। তারা আমাকে একটি ঘরের সিলিংয়ের সাথে ঝুলিয়ে রাখলো। তারা আমাকে পরদিন বিকেল পর্যন্ত ১৫ ঘন্টা ধরে নির্যাতন করে। মেজর রাশীদুল হাসান রাশীদ ও মেজর হুমায়ুন কবিরসহ অন্যান্যরা আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছেন। কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে।

আমার ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছিল। মেজর রাশীদ আমাকে ইলেকট্রিক শক্ দেন। তারা আমাকে ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়েছে। বাঁশের লাঠি দিয়ে আমার দু’পায়ের পাতায় মেরেছে। নির্যাতনের ফলে আমি দু’বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

তারপর তারা আমার বুকে নাম লিখে আমার ছবি তুলে থানায় হ্যান্ডওভার করে। কিন্তু যে মামলায় আমাকে থানায় হ্যান্ডওভার করা হয়েছিল সেই মামলায় আমি হাইকোর্ট থেকে জামিনে ছিলাম। এরই প্রেেিত বোয়ালিয়া থানা আমাকে নিতে অস্বীকৃতি জানালে আমাকে আবার র‌্যাব সদর দপ্তরে ফেরত আনা হয়। পরে আবার একই থানায় নিয়ে গিয়ে আমাকে জরুরি মতা বিধিমালার ১৬ (২) ধারায় হ্যান্ডওভার করা হয় পুলিশের কাছে। আমাকে কোর্টে নিয়ে গেল পুলিশ।

একটি রাজনৈতিক প্রভাবশালী দুবক্তৃত্ত চক্র এবং রাষ্ট্রীয় একটি বিশেষ বাহিনীর ষড়যন্ত্রের শিকার আমি। আমি প্রায় ১৯/২০ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছি। সাংবাদিকতাই আমার পেশা, নেশা, সার্বণিক ধ্যান, চিন্তা-চেতনার মধ্যেই আছে আমার সাংবাদিকতা। মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা, জনকল্যাণ, মানুষের ওপর যে অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার হয় এসব নিয়েই আমার কাজ। আমি সবসময় চেষ্টা করি নন পার্টিজানশিপ সাংবাদিকতা করার।

এবং সর্বদাই ইনভেষ্টিগেটিভ জার্নালিজম করার চেষ্টা করেছি। সারাজীবন আমার এই একটিই তপস্যা। কিন্তু আমি কখনই ভাবতে পারি না, কল্পনাও করিনি কোনদিন যে অন্যায়-অবিচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে আমাকেই রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হতে হবে। আমি সংবাদপত্র, রেডিও ও টিভি সাংবাদিকতা করেছি এবং করছি। কিন্তু আমি কল্পনাও করিনি যে যেধরনের অন্যায়-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমি রিপোর্ট করেছি সেইধরনের নিযৃাতনই আমার জীবনটাকে পাল্টে দেবে? সেটা আমি কোনদিনও ভাবিনি।

কিন্তু আজকে এমন একটা বাস্তবতা কিংবা সত্যের মুখোমুখি যে এক ধরনের একটা অনিশ্চয়তা একটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে আমার জীবনটাকে। আমি জানি না এ অবস্থার অবসান হবে কিনা? কারণ আমরা এমন একটি অসভ্য-বর্বর সমাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, যে অপশক্তি এই সমাজকে সবসময় অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে চায় সেই অপশিি দিন দিন সমাজকে আবৃত করে ফেলছে। ভিও: দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, সর্বগ্রাসী সর্বহারা বা সা¤প্রদায়িক জঙ্গিবাদি দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে তার লড়াই চিরকালের। সুলতানা কামাল, মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব: আমাদের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যেই অত্যাচার বিষয়টাকে এমন ঘনিষ্ঠভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে যে একটি ব্যক্তিকে যদি বিচারের জন্য গ্রেফতার করা হয় তাকে গ্রেফতার করার পরে তার ওপরে চলে শারীরিক নির্যাতন। এমনকি যখন কাস্টডিতে মৃত্যুগুলি ঘটে তখনও কিন্তু সমাজ কোন প্রশ্ন করে না আর।

ধরে নেয় যে এটা হতেই পারে। এটা স্বাভাবিক। এই যে অত্যাচারকে এই যে নিষ্ঠুরতাকে, এই যে আইনের বাইরে যে মানুষের জীবন নিয়ে, মানুষের শরীর নিয়ে একটা মতা দেখানোর অধিকার আদায় করে নেয় সরকার কিংবা সরকারের প্রতিভূরা সেটাকে কিন্তু আমরা একটা গোপন বৈধতা দিয়ে আসছি। বিশেষত: আমরা দেখি যে যারা মানুষের নিগ্রহের বিরুদ্ধে কথা বলতে চেষ্টা করে যারা মানুষের দুর্দশার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করে তাদের উপরেই কিন্তু সবচেয়ে বেশি অত্যাচার নেমে আসে। সাউথ এশিয়ায় সাংবাদিকদের জন্য জীবন খুব বিপদজনক।

কারণ সাংবাদিকরা মানুষের কথা বলেন, মানুষের বিপদের কথা তুলে ধরেন এবং তাদের উপরেই কিন্তু সবচেয়ে বেশি নিগ্রহের কষাঘাত এসে পড়ে। আমরা যেমন জাহাঙ্গীর আলম আকাশের উদাহরণ দিতে পারি। জাহাঙ্গীর আলম আকাশ যিনি জরুরি অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছিলেন, তার উপরে যে অত্যাচার চলেছে। আজকে আমাদের দৃঢ়ভাবে নিজেদের কাছে এই কথাটা বলে নিতে হবে যে আমরা আমাদের সমাজ থেকে আমাদের রাষ্ট্রীয় ধারাগুলির ভিতর থেকে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের যে জীবন-যাপন আছে সেটার ভিতর থেকে এবং আমাদের যে মননে আমাদের মনের ভিতরে এই যে বিষয়গুলি গেঁথে গেছে যে অত্যাচারের কোন প্রতিকার নাই, সন্ত্রাসের কোন বিধান নাই, সেটা বার করে সেটার যাতে বিধান হয় সেটার যাতে প্রতিকার হয় সেই দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোচ্চার হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ভিও: রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী র‌্যাবের হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দিনরাত তিনি ছুটে বেরিয়েছেন পুঠিয়া থেকে বাগমারা, কখনওবা ছোটবনগ্রাম কখনও মর্গ থেকে মেডিক্যাল, পুলিশ থেকে ডাক্তার কেউ মুখ খুলতে রাজি না রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে।

সবার একটাই ভয়...কারওবা চাকুরি আবার কারও জীবন হারাবার ভয়। কিন্তু সন্তানহারা মায়ের মুখতো কেউ থামিয়ে রাখতে পারেনি। ভাই হারানো বোনের কান্না, ভাইয়ের আকুতি, প্রতিবেশিদের মিছিল চরম জরুরি অবস্থাকেও নিস্তব্ধ করে দিয়েছিল সেদিন। যখন অন্যের কলম ক্যামেরা ভয়ে থর থর করে কাঁপে তখন সত্যের পূজারি এই সাংবাদিক লিখেই যাচ্ছেন সত্যের ইতিহাস। ইকবাল সোবহান চৌধুরী, সভাপতি, বিএফইউজে: এই নির্যাতনের ঘটনাগুলো নতুন নয়।

জাহাঙ্গীর আলম আকাশকে হেফাজতে নিয়ে গিয়ে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, শারীরিকভাবে নিরর্যাতন করা হয়েছে মানসিকভাবে যেভাবে পর্যুদস্ত করা হয়েছে তার প্রতিকার আমরা চেয়েছিলাম। কিন্তু তার কোন প্রতিকার হয়নি আজও। তাই আমরা সাংবাদিক হিসেবে এদেশের সচেতন নাগরিকদের প থেকে যেকোন হেফাজতে কোন নাগরিককে সে সাধারণ নাগরিক হোক অথবা তিনি রাজনীতিবিদ হোক অথবা তিনি পেশাজীবি হোন কারও কোন নির্যাতনের ঘটনা যেন না ঘটে। সেটা আমরা দাবি করি। এবং যদি কোন এই ধরনের কোন ঘটে তার সুষ্ঠু তদন্ত করে যারা এর সাথে জড়িত থাকবে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় আনার আমরা দাবি করি।

উইলিয়াম গোমেজ, মানবাধিকারকর্মী: জাতির বিবেক, জাতিকে যারা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেই সাংবাদিক ভাইদের উপরে র‌্যাবের নির্যাতন চরমে এসে পৌঁছায় জরুরি অবস্থার সময়ে। তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে আমাদেরই সাহসী সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম আকাশ। তার উপর যে বর্বর নির্যাতন হয়েছে আজও সে তার শরীরে সেই তচিহ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াচেছ। তার চোখে-মুখে একটি মাত্র আকুতি আর কেউ যেন নির্যাতনের বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার না হয়। তার কলম আজও থেমে যায়নি।

নির্যাতন তার কলমকে থামাতে পারেনি। রবীন্দ্র ঘোষ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ স্রপ্রিম কোর্ট: আমি শক্তভাবে নিন্দা জানাচ্ছি আমাদের দেশের একজন মানবাধিকারকর্মী সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম আকাশের ওপর নির্যাতনের ঘটনার। যিনি র‌্যাব হেফাজতে দীর্ঘ সময় ধরে নির্যাতিত হয়েছেন। কতিপয় স্বার্থানেষী ব্যক্তি কর্তৃক আকাশের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলা এখনও বিচারাধীন আদালতে।

এটা খুবই উদ্বেগজনক এই জন্য যে, এটা একজন মানবাধিকারকর্মী-সাংবাদিকের ওপর হুমকিস্বরুপ। যখন আমি ২০০১-২০০২ সালে আমি যখন রাজশাহী বিভাগ পরিদর্শন করি তখন আমি দেখেছি রাজশাহী জেলা ও রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের অধিকার রায় সাংবাদিক আকাশ চমৎকারভাবে কাজ করেছেন। আমি আরও পর্যবেণ করেছি যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার তথ্যানুসন্ধান কাজেও সহযোগিতা করেছেন আকাশ। ভিও: সত্যের জয় চিরদিনই হয়। অবশেষে সাংবাদিক আকাশ আজ মুক্ত।

কিন্তু জঙ্গিরা আজও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ চক্রের মিথ্যা অভিযোগে করা হয়রানিমূলক মামলাগুলো এখনও ঝুলছে আকাশের ওপর। আকাশ আজও সেই মূলমন্ত্রে বলীয়ান- বিদ্রোহী রণকান্ত আমি সেইদিন হবো শান্ত যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাশে ধ্বনিবে না অত্যাচারির খড়ক কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না। (জরুরি অবস্থার সময়ে এলিট ফোর্সের হাতে সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম আকাশের গ্রেফতার ও তার ওপর বর্বর নির্যাতনের কাহিনী অবলম্বনে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের উপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র 'দুঃসহ সময়' )

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.