আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ছোটবেলার ঈদ

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার। আমার ছোটবেলাটা কেটেছে গ্রামে। গ্রাম বলতে একদম প্রত্যন্ত গ্রাম- যে গ্রামে আজ অবধি বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি, যে গ্রামে এখনও সন্ধ্যা নামে ঝি ঝি পোকার ডাকে। কুপি বাতির টিমটিমে আলোয় যে গ্রামটা এখনও সন্ধ্যা হতে না হতেই গভীর অন্ধকারে ডুবে যায়। এমনি একটা গ্রামে আমার শৈশবকে কাটাতে পেরে আমি নিজকে ভাগ্যবানদের একজন মনে করি।

আমার মতো যাদের শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপণার দিনগুলো কেটেছে গ্রামে এবং যাদের সুযোগ হয়েছে সেই সময় গ্রামের বাড়িতে ঈদ করার, তারা নিশ্য়ই স্বীকার করবেন যে, গ্রামাঞ্চলের ঈদের আনন্দ তুলনাহীন। এ এক অন্য রকম পাওয়া। কোন কিছুর সাথে এর তুলনা চলেনা। এমনকি শহরের জৌলুসপূর্ণ ঈদের সাথেও না। আজ এতটা বছর পেরিয়ে এসে, শহরের এত আনন্দঘন ঈদের সময়টাতে আমার ছোটবেলার ঈদের দিনগুলোর পিছুটান কিছুতেই ভুলতে পারিনা।

বার বার ইচ্ছে করে অন্তত একটি বারের জন্য ফিরে যাই আমার ছায়া সুনিবিড় গ্রামে ঈদের দিনটা কাটাতে। ফিরে যাই আমার শৈশবের আনন্দ মুখর ঈদের দিনগুলোতে। কিন্তু হয়ে উঠেনা। কারণ, এর জন্য দরকার যে নাড়ির টান তা আমার ছিঁড়ে গেছে চিরতরে। মাটির মায়ায় গ্রামের ছায়ায় আমার যাওয়াটা আজও অব্যাহত থাকলেও কোন উৎসবের আনন্দ সেখানে গিয়ে উপভোগ করার মতো সুযোগ আর নেই।

তাই ঈদ আসলেই আমার ছোটবেলার দিনগুলোর পিছুটান বার বার বড় হয়ে দেখা দেয়। আজও চোখের সামনে ঝলঝল করছে সেই দিনগুলো। আমরা যারা বাড়ির ছোট ছিলাম যাদের ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত রোজা শুরু হবার সাথে সাথে। আমরা গ্রামে থাকলেও চাকুরীর সুবাদে আমার আব্বা ঢাকায় থাকতেন। তাই আমাদের ঈদের জামা-কাপড় কেনা হতো ঢাকা থেকে।

আব্বা প্রায় পতি সপ্তাহে বাড়ি যেতেন। রোজা আসলেই আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম কবে আব্বা আমাদের জন্য নতুন জামা-কাপড় নিয়ে আসবেন। আমাদের পাড়ার আমাদের সম বয়সী আর কারও জামা-কাপড় ঢাকা থেকে কেনা হতো কিনা জানিনা। তবে আমাদের জামা-কাপড় ঢাকা থেকে আনা হতো বলে সবাই দেখতে চাইত। কিন্তু ঈদের আগে ঈদের জামা কেউ দেখে ফেললে ঈদ হবেনা।

কাজেই আব্বার আনা জামা ঈদের দিনের আগে কাউকে দেখানো চরবে না। অথচ আব্বা বাড়ি ফিরে আমাদের হাতে জামা তুলে দেয়ার পর ওটা পরে দেখার লোভও সামলাতে পারতাম না। তাই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে জামা গায়ে দিয়ে দেখতাম কেমন দেখাচ্ছে। তারপর আবার ভাঁজ করে আলমারিতে তুলে রাখতাম। আম্মাকে বার বার সাবধান করে দিতাম কাউকে যেন জামাটা না দেখায়।

তারপর ঈদের দিন। আনন্দ শুরু হয়ে যেত আগের দিন বিকেল থেকে। আসরের পর পর বাড়ির সব ছেলেমেয়েরা পশ্চিমের খেতে গিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। একজনের ঘাড় ব্যথা হয়ে গেলে আর একজন তাকাতাম। এভাবে পালাক্রমে চলত।

কে আগে চাঁদ দেখতে পায় এ নিয়ে চলত প্রতিযোগীতা। চাঁদ দেখা যাওয়ামাত্র সবাই মিলে হৈ-হলে¬াড় করতে করতে বাড়ি যেতাম। তারপর সারারাত যেন ঘুম আসত না। কখন রাত পোহাবে, কখন নতুন জামা-কাপড় পরে ঈদের মাঠে যাব আব্বার সাথে এই চিন্তায়। ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যেত।

শীত হোক, গ্রীষ্ম হোক, সেই ভোরেই গোসল সেরে নতুন জামা-কাপড় পরে সাজ-গোজ করতাম। আম্মা সেমাই-পায়েস রান্না করে, নানা রকম পিঠা ভেজে আমাদেরকে খেতে দিতেন। আব্বার সাথে আমরা সব ভাই-বোন ঈদের নাস্তা খেতাম। তারপর আম্মা প্রতিবেশীদের জন্য নাস্তা সাজিয়ে দিতেন। আমরা খুশীমনে সবার ঘরে ঘরে নাস্তা পৌঁছে দিতাম।

আগ্রহ সহকারে ঈদের দিন এই কাজটা করার একটা কারণও ছিল। সেটা হলো ঢাকা থেকে আনা ঈদের জামাটা সবাইকে দেখানো। তাছাড়া ঈদের সেলামীর ব্যাপারটা তো ছিলই। তবে ১/২ টাকার বেশী সালামী কেউ দিত না। আব্বা/আম্মা অবশ্য ৫/১০ টাকা দিতেন।

তবে সেই দিনের ১ টাকা এখনকার দিনের তুলনায় কোন অংশে কম ছিলনা। ততক্ষণে আব্বা এদর মাঠে যাবার জন্য তৈরী হয়ে যেতেন। আমরাও যেতাম আব্বার সাথে সাথে। বড় দীঘির পাড়ে ঈদের জামাত হতো। আব্বা আমাকে অন্যান্য মেয়েদের সাথে পুকুড় পাড়ের আম গাছের তলায় দাঁড় করিয়ে রেখে নামাজ পড়তে যেতেন।

বলে যেতেন নামাজ শেষে উনার ফিরে না আসা পর্যন্ত যেন এখান থেকে না নড়ি। আমি বাধ্য মেয়ের মতো আব্বার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। আম গাছতলায় দাঁড়িয়ে সবার নামাজ পড়া দেখতাম। কাতারে কাতারে এতগুলো মানুষ যখন সিজদায় যেতো তখন তাদের পিঠের সমতল অবস্থান এক অদ্ভূত দৃশ্যের সৃষ্টি করত। আমি অবাক বিস্ময়ে সেই দৃশ্য দেখতাম।

আজ বয়সের সীমারেখার কারণে সেই দৃশ্য কাছ থেকে দেখতে পাইনা ঠিকই, কিন্তু শৈশবের দেখা সেই দৃশ্য আজও চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে আছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।