ক্লান্ত পথিক
আজকে যা বর্তমান, আগামীকাল সেটা অতীত। এভাবেই সময়ের সাথে জীবন এগিয়ে যায়। সময়ের পরিবর্তন খুব অদ্ভূত। সময় মানুষের চিন্তা-ভাবনা, দর্শন, ইত্যাদি পরিবর্তন করে দেয়। মানুষের স্মৃতি খুব জটিল সমীকরণ মেনে চলে।
সময়ের সাথে মানুষ পরিবর্তিত হলেও মানুষের স্মৃতি অতীতের সাথে বর্তমানের একটা সুক্ষ তুলনার ছাপচিত্র আমৃত্যু এঁকে চলে। আমার জীবনের চলার পথে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে বা সম্পূর্ণ অকারণে নিজেকে বদলাতে হয়েছে। তবুও ছোটবেলার কিছু ঘটনা অথবা সামাজিকতা এখনও মনে উজ্জ্বল রংয়ের পটছবি হয়ে বার বার ধরা দেয়।
স্কুলের অনেক কথা সবসময় মনে পড়ে। এই মুহুর্তে সব'চে বেশী মনে পড়ছে বর্ষাকালে স্কুলে যাবার কথা।
১৯৯১-৯২ সালের দিকের কথা। বর্ষাকালকে নিজের মতো করে বুঝতে পারলাম যখন আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। তখন বর্ষাকাল ছিল কবি-লেখকের বর্ষাকালের মতোই ! সারাদিন ঝুম ঝুম বৃষ্টি হতো। একজন তবলচী যেমন কখনও একই তালের মাঝে দ্রুত লয় যোগ করেন তেমনি বৃষ্টিও মাঝে মাঝে আস্তে আবার মাঝে মাঝে জোরে পড়তো। মনে আছে আমার স্কুলের সামনে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দূর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে খুব অল্প বৃষ্টিতেই হাঁটু পানি জমে যেত।
যেদিন বৃষ্টি হতো সেদিন স্কুলের কড়া নিয়ম কানুনও পানির মতো শিথিল হয়ে যেত। স্কুলে না গেলেও শিক্ষকরা কিছু বলতেন না। কিন্তু আমার জন্য বৃষ্টির দিন স্কুলে যাওয়া ছিল পরীক্ষা দেয়ার মতোই বাধ্যতামূলক । কারণ বৃষ্টির অজস্র ফোঁটার এই সমবেত আহবানকে আমি ফেরাতে পারতাম না। সব'চে মজা হতো বাড়ী ফেরার সময়।
হাঁটু পানিতে জুতা খুলে ,প্যান্ট হাটু অব্দি গুটিয়ে নেমে পড়তাম। সাথে থাকতো সহপাঠিরা। সেই পানিতে কত শত জীবাণু থাকতো এসবের চিন্তা মাথায় আসতো না। যেসব সহপাঠিরা মা-বাবার সাথে স্কুলে যেত, তারা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের এই উন্মাতাল পানিখেলার সঙ্গী হতে পারতো না। তারা কেবলই একটা অসহায় দৃষ্টি নিয়ে আমাদের দিকে তাকাতো।
সেই দৃষ্টি আমাদের দুষ্টুমনের দুষ্টুমিকে আরো বাড়িয়ে দিতো। ময়লা পানি, ড্রেন, খোলা ম্যানহোল, রিকশা, গাড়ি কাটিয়ে রাস্তার মাঝখান দিয়ে আমরা জাতীয় বীরের মতো সামনে এগিয়ে যেতাম।
স্কুলের আরো একটি দিন ছিল খুব কাঙ্খিত। সেই দিন হলো স্কুলের বেতন দেবার দিন। সেই দিন দুই পিরিয়ড মিলে বেতন নেয়া হতো।
এর মানে হলো দুই পিরিয়ডের পড়া একেবারে মাফ! স্যার খুব সাবধানে হিসাব করতেন আর আমরা নিচু গলায় রাজ্যের সব গল্পে মশগুল হতাম।
ছোটবেলায় একটি বাজে অভ্যাসকে আমি ভালোবেসে আলিঙ্গন করেছিলাম। সেটা হলো ভিডিও গেমস খেলা। তখন মাত্র এই ব্যবসা ঢাকায় শুরু হয়েছে। স্কুলের শিক্ষার্থীরা ছিল এই ব্যবসার প্রধান টার্গেট।
মনের কল্পনার সুপার হিরোকে যখন ভিডিও গেমসের মনিটরে দেখলাম এবং যখন বুঝলাম তাকে আমি বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রন করছি তখন নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতাবান মনে হতো। যতক্ষন খেলতাম ততক্ষনই একটা ইন্দ্রজালে আটকে থাকতাম। কল্পনায় যতই আমি সুপার হিরো হই না কেন বাস্তবে এই ভিডিও গেমস খেলার ফলাফল শিক্ষক এবং অভিভাবকের সামনে যে আমাকে কিছুটা সুপার ভিলেনে পরিণত করেছিল তা বলাই বাহুল্য।
ছোটবেলায় বাসার সামনে অনেক হকার আসতো। স্বাস্থ্যবিধিমতে নিষিদ্ধ সব খাবারের প্রতি তখন ছিল অপার আগ্রহ।
সে কারণেই কটকটি নামের খাবারটিকে মনে হতো স্বর্গীয় খাবার। এখন হাওয়াই মিঠাই যেমন লম্বা সরু কাঠির চারপাশে মাকড়শার জালের মতো করে সাজিয়ে দেয় আমার ছোটবেলায় তেমনটি ছিল না। ছোট বলের মতো গোল গোল করে বিক্রি করতো। ২৫ পয়সা ছিল একেকটির দাম। আর একটার খাবারের কথা মনে পড়ছে।
এখন এটা আমি আর দেখি না। আমি খাবারের নাম ভুলে গেছি। বাশের আগায় মিষ্টি এই খাবারটা থাকতো, রবারের মতো ইলাস্টিসিটি ছিল। হকার ক্রেতার চাহিদা মতো ঘড়ি, চশমা ইত্যাদি ঐ খাবার দিয়ে বানিয়ে দিত। মনে আছে আমার পছন্দ ছিল ঘড়ি।
ঐ খাবার দিয়ে ঘড়ি বানিয়ে হকার আমার হাতে যখন পড়িয়ে দিত তখন ঐ হকারকে মনে হতো পৃথিবীসেরা শিল্পী। ঐ ঘড়ি হাতে পড়ে আমি মাঝে মাঝে সময় দেখার ভান করতাম এবংখানিক পর পর একটু একটু করে মুখে পুরে দিতাম!
হাজার স্মৃতির মাঝখানে আর একটা পুরোনো কথা লিখে আমার এই ব্লগ শেষ করবো। স্কুলের নতুন ক্লাস শুরু হতো জানুয়ারীর এক তারিখে। এই নতুন ক্লাসের যাবার আয়োজন ছিল আমার জন্য খুব আনন্দের। নতুন বছরের নতুন ক্লাসে বসার কয়েকদিন আগে লাইব্রেরীতে যেতাম।
নতুন বই কিনতাম। নতুন নতুন খাতা, কলম-পেনসিল, ইরেজার, জ্যামিতি বক্স সব একসাথে কিনতাম এক বছরের জন্য। নতুন শার্ট-প্যান্ট বানাতাম। সব জিনিষ কিনে যখন বাসায় আসতাম তখন সেই আনন্দ ঈদের আনন্দের চেয়ে কিছু অংশে কম হতো না। নতুন ক্লাস শুরুর সপ্তাহখানেক এই আমেজ থাকতো।
পড়াশুনা পুরোদমে শুরু হয়ে গেলে এই আমেজের ক্ষয় শুরু হতো এবং ফাইনাল পরীক্ষার শেষ হওয়া পর্যন্ত আনন্দ আমেজের এই ক্ষয় চলতে থাকতো। ফাইনাল পরীক্ষার পর যথারীতি রেজাল্ট বের হতো এবং আবার প্রতিক্ষিত নতুন ক্লাস। আনন্দ আমেজকে শতভাগ সঙ্গী করে আবার নতুন ক্লাসে উপস্থিত থাকতাম।
নস্টালজিয়ার মানে আগে ডিকশনারী ঘেঁটে জানলেও এই শব্দের অর্থ বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে চাকরীজীবনে প্রবেশের পর অন্তর দিয়ে উপলব্দ্ধি করেছি নস্টালজিয়ার মানে, নস্টালজিক হওয়ার স্মৃতিতাড়িত যন্ত্রনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।