"এই যে,একটু সরে বসেন না । "লোকটাকে কখন থেকে বলে চলেছি । না,সে সরবে না । গোঁ ধরে সিটি বাসের দুটো সিট দখলে নিয়ে বসে আছে । এদিকে মানুষের চাপে আমার অবস্থা কেরোসিন ।
শেষে লোকটাকে কোনমতে ঠেলেঠুলে তার বাঁয়ের সিটের এক চিলতে জায়গা দখল করলাম । তখন থেকেই দেখছি লোকটা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে । আবেদন অগ্রাহ্য করার কৌশল হতে পারে ! থাক,বজ্জাতটার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই । তবু কেন যেন উত্সুক দৃষ্টি তার দিকেই যেতে লাগল । হঠাত্ ঘাড় ফেরালেন ।
একটু বিব্রত মনে হল তাকে । আমিও হলাম বৈকি !
"দেখেন দেখি,বেয়াক্কেলের মত সিট দখল করে বসে আছি !"বলেই ডানে চাপলেন । এবার আরাম করে বসলাম । নাঃ,লোকটা ভদ্র আছে !
"কৈ নামবেন ?"জিজ্ঞেস করল লোকটা ।
"বহদ্দারহাট।
আপনি?"
"আমিও বহদ্দারহাট। "
"কী কাজে বলা যায় ?"
"কেন নয় ? বাড়ি যাব,টার্মিনাল থেকে বড় গাড়িতে উঠে সোজা সাতকানিয়া । "একটানা বলে দম ফেললেন !
"আরে,আমিও তো সাতকানিয়া যাব। যাক ভালই হল,একসাথে কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে। "ফুলটাইম সঙ্গী পেয়ে ভালই লাগছে।
দুজনেই বহদ্দারহাটে নামলাম । তিনি আমার হাত ধরে টেনে শাহআমিন কাউন্টারে নিয়ে গেলেন ।
"দুইটা কেরাণীহাটের টিকেট দেন দেখি। "আমার দিকে তাকিয়ে আবার বললেন,"কেরাণীহাটেই তো নামবে,না?"আপনি থেকে তুমি ! অসুবিধা নেই,আমার থেকে বয়সে অনেক বড়,ষাট-পঁয়ষট্টি তো হবেই । হাসিমুখেই বললাম,"হ্যাঁ"।
আরে,আমার টিকেটের টাকাও তিনি দিয়ে দিলেন ।
"আরে,আরে!করছেন কী ?"
"কিছুনা। তুমি আমার ছেলের মত,তোমার জন্য ৬০ টাকা খরচ করলে কিচ্ছু হবে না। "
"তা হবেনা। কিন্তু..."
"কোন কিন্তু না,টিকেট নিয়ে উঠে বস,আমি আসছি।
"আমি কথা না বাড়িয়ে বাসে উঠে টিকেট দেখে সিটে বসলাম ।
একটু পর দুটি জ্যুসের বোতল আর দুটি ছোট বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে তিনি এলেন । আমাকে একটা বোতল আর প্যাকেট দিতে চাইলেন । আমি নিতে চাইলাম না,আর যাই হোক,তিনি এখনো একজন অপরিচিত ব্যাক্তি । তিনি বোধহয় আমার মনের ভাব বুঝতে পারলেন ।
তিনি আমাকে যেকোন একটি বোতল আর প্যাকেট নিতে বললেন । বুদ্ধি খারাপ না ! নিলাম । বাস চলতে শুরু করল ।
"নাম কি তোমার ?"
"সোহাগ"
"কে দিয়েছে নামটা ?"
"বাবা। মা বলেছে,বাবার নাকি প্রথম সন্তান হিসেবে ছেলের খুব শখ ছিল।
প্রবাসে যাওয়ার আগেই নামটা দিয়ে গেছেন। "
"কেন?তোমার বাবাকে তুমি দেখনি?"
"না। বাবা চাকরির খোঁজে দুবাই গিয়েছিল। কিন্তু এর পর আর কোন খবর দেননি। কিছুদিন আগে বাবা ওখানে মারা যান।
তারা প্লেনে লাশ পাঠিয়ে দিয়েছে। "
"তারা বলতে?"
"বাবা যেখানে চাকরি করত। "
"তারপর?"
"গতকাল চাচারা বাবার লাশ আনতে ঢাকা গেছেন। লাশ নিয়ে বাড়ি আসবেন। (ঘড়ি দেখে)এতক্ষণে চলে আসার কথা।
বাবাকে প্রথম ও শেষবারের মত দেখতে যাচ্ছি। "চোখের কোণে পানি এল,এমন একজনের জন্য,যাকে আমি আজো দেখিনি !
"কি দুঃখজনক!তোমার মা আর বিয়ে করেননি?"
"না। তিনি সারাটি জীবন আমার বাবার আশায় কাটিয়ে দিয়েছেন। চাচাদের বিয়ে দিয়েছেন। বাবার সব দায়িত্ব পালন করেছেন।
"
"তোমার মা এত দায়িত্বশীল!অসাধারণ!"
গাড়ি বেশ কতদূর চলে এসেছে । আশপাশে দোকানপাট দেখছি না,নাহলে এলাকাটা চিনতাম । থাক ।
"আপনার পরিচয় জানা হল না । "
"আমি যাচ্ছি আমার বাড়িতে।
আজ আমার ছেলে আসবে। আমি ওখানে সাইকেল পার্টসের ব্যবসা করি। ব্যবসার কাজে শহরে গিয়েছিলাম। ছেলে আসবে,তাই কাজ ফেলে চলে আসছি। "
"ও"কথা বলতে ভাল লাগছে না ।
ভেতরে সামান্য শিহরণ অনুভব করছি । জন্মদাতাকে দেখার আনন্দ,নাকি মৃত পিতাকে দেখার শোক,বুঝতে পারছি না ।
বাস কেরাণীহাট এসে থামল । আমি আর তিনি নামলাম ।
"চলেন,আজকে দুপুরের ভাতটা আমাদের বাড়িতে খাবেন ।
"তাকে নিয়ে বাড়ি যেতে চাইলাম ।
"না বাবা,আমার বাজারে একটু কাজ আছে,তোমার বাড়ির ঠিকানাটা বল। "
"হাসান চৌধুরীর বাড়ি বললেই সবাই চিনিয়ে দেবে। "
"ঠিক আছে,আমি সন্ধ্যে বেলা আসব। "বলে তিনি আমার গালে হাত বুলিয়ে দিলেন ।
সারা শরীর কেঁপে উঠল । আমি তাকে সালাম দিয়ে একটা রিকশা করে বাড়িতে এলাম ।
বাড়ি এসে দেখি সবাই চুপচাপ । অবশ্য হবে নাই বা কেন ? তেইশ বছর আগে সবাই যাকে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিল,সে যে মৃতদেহ হয়ে ফিরে আসবে সেদিন কেউ কি তা ভেবেছিল ? সবাইকে সালাম করলাম । কিন্তু লাশ কৈ ?
দাওয়ায় মা বসেছিলেন ।
নির্বাক । সালাম চাচা যাননি । বললেন,রাস্তায় জ্যাম । তাই বাবার লাশ বহনকারী গাড়িটার আসতে দেরী হচ্ছে । আমি গোসল করে কাপড় পাল্টালাম ।
ভাত খেয়ে পুকুরঘাটে বসে থাকলাম ।
সন্ধ্যা হয়ে এল । হঠাত্ লোকটিকে আসতে দেখলাম । আরে ধূর,উনি তো রহিম চাচা । মানে লাশ এসে গেছে ! চাচা বললেন,"ভাইপুত,গাড়িতো ব্রীজে উঠবার পারতাছে না।
তাড়াতাড়ি আয়,ধরন লাগবো। "আমাদের গ্রামে একটা চিকন ব্রীজ আছে । গাড়ি ঢুকার মত যথেষ্ট চওড়া নয় । তাড়াতাড়ি গেলাম । কফিনে হাত লাগালাম ।
তেমন ভারী নয় । নিয়ে এসে উঠানে রাখলাম । সবাই আমাকে আগে দেখতে বললেন । কম্পিত বুকে কফিনের ঢাকনা উঠিয়ে মুখ থেকে কাপড় সরাতেই আমার রক্ত হিম হয়ে এল ! বিকট চিত্কার করে ছিটকে পড়লাম । লাশ আসার পর যারা কান্নাকাটি শুরু করেছিল তারা হতভম্ব হয়ে গেল ।
ব্যাপার কী ? আমার মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না,"এ- এ-এইতো সে-সেই লোক !!!"সবাই অবাক !
"কোন লোক ?"
"যার সাথে আমি সারা রাস্তা কথা বলতে বলতে এলাম!"
"কি বলিস ?"
"হ্যাঁএএ ! বাজারে উনার সাইকেল পার্টসের দোকান আছে। আমাকে খাওয়ালেন,আদর করলেন!এএইতো,এখনি উনি আসবেন !"বলেই চুপ হয়ে গেলাম । একটু পরই শিশুর মত "বাবা" বলে চিত্কার করে কেঁদে উঠলাম ! বাবাকে এত কাছে পেয়ে আবার হারালাম ! তিনি শেষবারের মত সবার খোঁজ নিয়ে,তাঁর সোহাগের অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করে দিয়ে গেলেন ! বাবা,তুমি আরেকবার এসো ! তোমাকে শিশুর মত জড়িয়ে ধরি,একটিবার বাবা বলে ডাকি..... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।