নয়ন
শাশ্বত নিপ্পন
- পেইচি, পেইচি এ্যাই ধর্ ধর্
জল ধলা গ্রামের বিশাল জলাশয়ের উলঙ্গ অর্ধ উলঙ্গ মৎস শিকারীরা একযোগে চিৎকার করে উঠে।
- এই, সবদেল কানা মাছ পেয়েছে; বড় মাছ! সবাই ছুটে যায় সেখানে। সবদেল কানা কে ঘিরে একটা ছোট খাটো জমায়েত গড়ে উঠে। সবদেল বলে উঠে,
- আধ কে.জি. তো হবেই;
- কি মাছ রে সবদেল?
- শোইল গো, শোইল -এর মাঝরা!
সকলে সবিস্ময়ে দেখতে থাকল, সবদেল দু’হাতে চেপে ধরে আছে প্রায় আধা কে.জি. ওজনের একটা আস্ত শোইল!! সকলের মুখে হাসি আর চোখে হতাশা। এর মধ্যে একজন বলে উঠে,
- আল্লাহর কি অসীম দয়া, অন্ধ ছেলেটাকে অত বড় একটা মাছ পাইয়ে দেলে....
জলার পাড়ে যারা মাছ ধরার দৃশ্য দেখছিল তারাও সবদেলের এই সাফল্যে হৈ হৈ করে উঠে।
সবদেলের সর্বাঙ্গে আনন্দ ঝড়ে পড়ে। সবদেলের চোখ নেই। জন্মান্ধ। জন্ম থেকে সে রাত আর দিনের পার্থক্য করতে পারে না, আলাদা করতে পারে না সাদাতে আর কালোতে, অন্ধকার আর আলোতে। কানা সবদেল এই গ্রামে খুব জনপ্রিয়।
সব মহলে একজনের এমন গ্রহণযোগ্যতা সচরাচর দেখা যায় না। অবশ্য সবদেলের গুণের কোন অভাব নেই। মাঠে নিড়ানীতে তার কোন জুড়ি নেই। কালো সাদায় মাখান গায়ের রং, মাথায় ঘন কালো চুল আর ভীষণ সুন্দর গানের গলা তার। শুধু চোখ নেই সবদেলের- চোখ নেই মানে দৃষ্টি নেই তার।
তারপরও প্রচন্ড জীবনী শক্তিতেই হোক, আর কোন আলৌকিক কারণেই হোক, সে সবকিছুই যেন দেখতে পায়; বুঝতেও পারে সবকিছুই। আজান পড়লেই সে বলে দিতে পারে, জোহরের না আছরের ওয়াক্ত। রাত দিনও ঠাওর করতে পারে নিজে নিজে। এমন কি মাছ ধরলেও বলে দিতে পারে এটা কি মাছ। যদিও সে কোনদিন এসব দেখেনি।
রামকৃষ্ণপুর জলধলা গ্রামের জামে মসজিদের পুরনো ইমাম সাহেব বলেন,
- সবই তাঁর ইচ্ছা ভাইছাব। তিনি ইচ্ছা করলে রাত কে দিন করতে পারেন, পারেন পাথরে ফুল ফোটাতে; রাত-দিন, ফুল-পাথর সবই তাঁর সৃষ্টি।
সবদেল শোনে আর হাসে। তার মনে হয় অবশ্যই তিনি সবকিছু পারেন। যেমন, সবদেলের খুব ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মহান করুনাময় তাকে তাঁর এই বিশাল সৃষ্টি সৌন্দর্য রাশি দেখতে দেননি।
দেননি তার মা-কে এক ঝলক দেখতে। অথচ সবদেলের মা সোনাই বিবি খুব ধার্মিক ছিল। দিনে দু’বেলা করে মজিদ ঘর ঝাঁড় দিত সে। সবদেলের বাপ তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে তার মসজিদ প্রীতি আরো বেড়ে যায়। মাঝে মাঝেই এটা ওটা এনে সবদেল কে তার মা আদর করে দিয়ে বলত,
- নাও বাপজান নাও- আমার সোনা বাপ, আমার মানিক বাপ--
সবদেলের এই ডাক-টা ভাল লাগত।
বুঝত এই আওয়াজের পরপরই মা আসবে কাছে। মায়ের গায়ের গন্ধ পাওয়া যাবে। কি সুন্দর সে গন্ধ, সাথে খাবার। খিল খিল করে হেসে উঠত শিশু সবদেল, আর সেই হাসিতে মুগ্ধ সোনাই বিবি বুঝতে পারতনা যে তার ছেলে অন্ধ। এভাবেই বড় হয় সবদেল।
তার মাও একদিন বুঝতে পারে, তার সোনা বাপ, মানিক বাপ অন্ধ। এ ভাবেই সোনাই বিবির জন্মান্ধ সাবদেল বেড়ে উঠতে থাকে। চিনতে থাকে তার চারপাশ, গ্রাম, গ্রামের মসজিদ, ইমাম সাহেব আর অপার করুনাময় সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ক্ষমতাকে। তীক্ষ্ণ হতে থাকে তার অনুভূতি। একদিন গলায় গান উঠে আসে-
তারপর বিশ্বময় এই সৌন্দর্য উপলব্ধি করেও উপভোগ করতে পারে না সে।
এই পৃথিবী কি সুন্দর- ভাবতেই সবদেলের ছেলে বেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়....
সবদেলের অন্ধত্ব প্ররিস্ফুট হওয়ার পর সোনাই বিবি দিশেহারা হয়ে পড়ল। আল্লাহর ঘর মসজিদ সাফ করার পাশাপাশি অন্যান্য কাজও হাতে নেয় সে। দড়ি পাকানো, কাঁথা সেলাই করার মাঝে ঈমাম সাহেবের বাড়ীতে পাক সাফ করাসহ সব দায়িত্ব নিয়ে ফেলে সোনাই বিবি। ঈমাম সাহেবের বিবিকে জ্বীনে ধরেছে। উনি গত দু’মাস বিছানায়, পঙ্গু।
বাড়ী ঘরের সব কাজ সোনায়ের হাতে। ব্যস্ত দিন কাটে সোনায়ের আর দিনের শেষে একপেট খাওয়া। সামান্য কিছু খেলনা নিয়ে সবদেল বসে থাকে বারান্দায়। অন্যদিকে একটার পর একটা কাজ করে চলে সোনাই। গলা ঝেড়ে ঈমাম ছাব বাড়ীতে ঢোকেন, গলা ঝেড়ে বলেন,
- কে আছে, পানির জ্বালায় জান যায়; এক গেলাস পানি লাগে ঘরের ভিতর থেকে বিবি ছাব তীক্ষ্ণ কষ্ঠে বলে উঠে-
- বুকটা ফাটে না ক্যানে? বুকটা ফেটে জানটা বেড়িয়ে যায় না ক্যানে- আমার প্রাণডা বাঁচে-
- চোপ হারামজাদী, ঈমাম সাব ধম্ক দেয়- ঈমাম সাহেবের সুরালা কণ্ঠ হঠাৎ রক্ত জল করা জলধগম্ভীর হয়ে উঠে।
এর মধ্যেই পানি নিয়ে সোনাই আসে,
- এই ন্যান্ পানি, ঠান্ডা পানি!
ঈমাম সাহেব হাত সহ গ্লাসটা ধরেন। তারপর ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে থাকে হাত। একটা ঘোর লাগা নেশা মাখানো গলায় সোনাই বিবি বলে উঠে-
- ছাড়েন, দিনে-দুপুরে; আমার লজ্জা করে না বুঝি ---
- আরে লজ্জা কি ছোট বিবি; তাছাড়া দিন-রাত সবই আল্লার।
খুক-খুক হেসে উঠে সোনাই। পশ্রয় মাখানো গলায় বলে উঠে-
- ছাড়েন, ভাল হচ্ছে না, এখন না পরে।
আমার সবদেল এখনো জাগনা আছে
ইমাম সাহেব বলে উঠেন,
- আরে, তোর ছেলে তো কানা, অসুবিধা কিসে ---
হঠাৎ ঘর থেকে তীক্ষ্ণ গলায় ইমাম সাহেবের বিবি চিৎকার করে উঠে,
- এই হারামজাদী মাগী, পানি দেতে কত সময় লাগে?! বেরু বেরু আমার বাড়ী থেকে
অসহায় সবদেল, শূন্য দৃষ্টি নিয়ে সবশুনে এসবের অর্থ বোঝার চেষ্টা করে-
আজ অনেক কিছুই সবদেল বোঝে। এও বোঝে দৃষ্টি শক্তি থাকলে সেদিন সে নিজেই তার চোখ উপড়ে ফেলত। তাই এত কিছুর পর মনে হয়, তার চোখ না থেকে ভালই হয়েছে। সেদিনগুলো আর নেই। সবদেলের মাও এখন আর নেই।
তবে সেই ঈমাম হুজুর আছেন কি না সবদেল ঠিক জানে না, তবে জলধলা গ্রামের জামে মসজিদ থেকে জুম্মার খুতবা যখন হয়; তখন গলাটা সবদেলের কাছে খুব পরিচিত লাগে। তালগোল পাকিয়ে যায় সব। সবদেলের আর নামাজে যাওয়া হয় না...
জ্যৈষ্ঠ মাসের সন্ধ্যায় জামাল ফকিরের উঠানে গলা ছেড়ে গান ধরেছে সবদেল। ভারী মিষ্টি গানের গলা ওর। একটু আড়ালে গ্রামের মেয়েছেলেরাও জড়ো হয়েছে।
গান গাইছে সবদেল ‘‘সেই মানুষ ধরার সাধ নাই / আমি অনুভবে পাই / দেখা নাহি যায় / যেথায় শব্দ করে মানুষ / হাওয়া নাই সেথায় ...
জামাল ফকির চোখের জল মুছে বলে,
- ওর তো গলা হবেই, ওতো স্ময়ং দয়ালগুরু; ওরে ফকির সম্রাট নালনের ও এক চোখ কানা ছিল
সবদেল বলে,
- আমার তাতি কোনই দুখ ন্যাই বাবা
- দুঃখ থাকবে ক্যানে গো, ওরা চোখের দৃষ্টিতে দ্যাখে আর তুমি দ্যাখ্ অন্তরের দৃষ্টিতে, দিব্যজ্ঞানে
পাশ থেকে এক মহিলা বলে ওঠে-
- ফকির চাচা, তুমার সাকরেদ কে এবার একটা বিয়ে দাও। চারপাশে একটা হাসির রোল উঠে-। জামাল ফকির একটু চুপ থেকে বলে উঠে,
- ঠিকই তো, আমার সবদেলের এখন একজন সাধন সঙ্গিনী প্রয়োজন। তোমরা দেখতে থাক; বেশ বাদ্য বাজনা করে আমাদের গায়েনের বিয়ে দেব আমরা।
লজ্জা পায় সবদেল।
মনে মনে পুলকিত হয়। বিয়ে !! অদ্ভূত একটা সম্পর্ক। একজন অপরিচিত মহিলা হঠাৎ আপন থেকে আরো আপন হয়ে উঠে। তারা এক সাথে শোয় ক্রমেই একে অপরের আপন হয়ে উঠে। সবদেলের মা মারা যাওয়ার পর থেকে তেমন কোন আত্মীয় হয়নি তার।
আজ হঠাৎ বিয়ে শব্দটা শুনে বৌ এর একটা ছবি নিজের মধ্যে ভেসে উঠে তার। তারপর হঠাৎ বলে উঠে,
- থাক্ বাবা, অন্য একটা জীবন নষ্ট করে লাভ কি। তাছাড়া কেই বা কানা-র বউ হতে চাইবে ? ! ...
মেয়েদের মধ্য থেকে সকলে বলে উঠে,
- সে চিন্তা তুমার লয়, তুমি এখন জামাই, জামায়ের মত থাক।
সবদেলের বিয়ে হতে বেশী সময় লাগল না। পাশের গ্রামের বাপ মরা আর প্রথম স্বামীর ভাত না খাওয়া মোমেনার সাথে জন্মান্ধ সবদেলের বিয়ে হয়ে গেল একদিন।
একটা কম দামের লাল শাড়ি মুড়ি দিয়ে মোমেনা পাটির উপর চাদর বিছান চৌকিতে জড় হয়ে বসল। মোমেনার মাথার তীব্র গন্ধরাজ তেলের সুগন্ধ ছাপিয়ে সহস্র ঝি ঝি পোকার এক সাথে ডাক শুরু করছে। আজ যেন সন্ধ্যা নেমেছে কিছুটা আগেই। কে বা কারা এই কুঁড়ে ঘরের দেয়ালে রঙিন কাগজ মেরে কুঁড়ে টিকে বাসর ঘরের রূপ দিতে চেষ্টা করছে। সবদেলই নীরবতা ভাঙ্গে,
- আইজ তুমার খুবই ধকল গেছে আর গরমও পরছে বেজায়
- হ্যাঁ, এক গ্লাস পানি দ্যান, তিয়াস লেগিচে; তবে এসব আমার গা সওয়া
মোমেনার গলা দিয়ে খন্ খন্ করে কথা গুলো কুঁড়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
নতুন বউয়ের কথায় কিছুটা চমকে উঠে জীবনের প্রথম বর সাজা সবদেল। আরো কিছু ভাবতে গিয়ে মোমেনার কথায় সবদেলের ভাবনায় ছেদ পড়ে ; মোমেনা বলে আবার বলে উঠে,
- গেলাসটা ভাল করে ধুইচেন তো?
পানি খেয়ে তিয়াস মিটিয়ে মোমেনা ঘুমানোর প্রস্ত্ততি নিতে শুরু করে। চুলের ফিতে খোলে, কাপড় খোলে, ব্লাউজ খোলে। নতুন কাপড়ে খস্ খস্ আওয়াজ আর কাঁচের চুড়ির শব্দে এক অন্য রকম মাদকতার সৃষ্টি হয় কুঁড়ের কোনে আর সবদেলে মনে। শাড়ী আর চুড়ির শব্দে সবদেলের শরীরে এক নতুন অনুভূতি দোল খেয়ে যায়- যে অনুভূতি এতকাল হয় নি।
তারপর মোমেনা বলে উঠে,
- কুপির বাতি নিবিয়ে দ্যান- আমার চোখে লাগে- আপনের তো অসুবিধা নেই আপনে হলেন, কানা। আপনের রাইত দিন সমান।
আবার সবদেলের পড়ে যায় মনে, সে কানা। তার সবকিছু সমান মানায় না। সবদেলের বউ হয়েছে কিন্তু তাকে দেখা যাবে না হয়তো ছোয়াও যাবে না! কানা মানুষের শরীরের স্পর্শ অন্যের সহ্য নাও হতে পারে।
কুপিটা নেভাতেই কুঁড়েটা অন্ধকার কবরে পরিণত হয়। কিছু পরে একফালি চাঁদের আলো উঁকি মারে কুঁড়ের বিছানায় সেখানে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমায় সবদেলের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী মোমেনা। আজ চলে যাওয়ার কথা থাকলেও মোমেনা যেতে চায়নি। তাই সবদেলকেও থাকতে হয়েছে এখানে। ঘুম আসছে না সবদেলের।
আর মোমেনার নিঃশ্বাসের দোলায় দুলছে সবদেলের বাসর, তার ফুলশয্যা। আর থাকতে পারে না সে, হাতড়ে উঠে বসে চৌকিতে; তারপর হাত দিয়ে স্পর্শ করে মোমেনার মুখ, চোখ, ঠোঁট, থুতনি, গলা; তার বউ এর চেহারাটা সবদেল তার মনের মাঝে খোদাই করে রাখতে চায়। সবদেলের চঞ্চল হাত থুতনি গলা থেকে ধীরে ধীরে নেমে থামে মোমেনার উঠা নামা করা বুকে। বিদ্যুৎ শিহরণ খেলে যেতে থাকে সবদেলের শরীরে। মুহূর্তে জেগে যায় মোমেনা।
এক ঝাটকায় উঠে বসে বলে উঠে,
- উহঃ ঘুম বাদ দিয়ে এসব কি করেন? কানা মানুষের দেখি এদিক নাই ওদিকে ঠিক আছে!! ঘুম যান সকালে কাজ আছে...বলেই মোমেনা আবার ঘুমিয়ে যায়। নির্ঘুম রাত, অতি ধীরে ধীরে কাটাতে থাকে সবদেলের। পূর্বে আকাশ ফর্সা হয়ে উঠে ধীরে ধীরে।
পরদিন একটা ভ্যানে বর বধু বরের বাড়ীর উদ্দেশ্যে যখন রওনা হল, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। মোমেনা একটা টিনের বাক্স নিয়ে ভ্যানে উঠে বসে।
ভ্যানওয়ালা তার বিশেষ পরিচিত। মোমেনার দুর সম্পর্কের আত্মীয় বলে মোমেনা দাবী করল মাঝ পথে। মোমেনা বলে উঠে,
- কাইল কিন্তুক তুমি ফিরতি পারবা না হাশেম ভাই। এক গাল হেসে হাশেম আলী বলে,
- তাই কি হয়? পরের বাড়ী কি কাজ ফেলে থাকা যায়?
- পরের বাড়ী হবে কেনে, এটাতো তুমারো বাড়ী।
- হ্যাঁ, তুমার বাড়ী মানেই তো আমার বাড়ী।
হা-হা-হা কি বুলো গো দুলা ভাই?
বলেই বিশ্রী ভাবে হেসে উঠে হাশেম আলী। তখন আর কোন কথা খুঁজে পায় না সবদেল। মোমেনা বলে উঠে,
- আচ্ছা আপনে কি সত্যিই কানা, কিছুই দেখেন না-
কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে সবদেল।
নানা রাস্তা ঘুরে রিক্সা ভ্যান টা সবদেলের ঘরের সামনে এসে থামে। সকলেই নতুন বউ দেখে, ঠাট্টা করে চলে যায় সন্ধ্যার একটু পরেই।
রাতের খাওয়া দাওয়াটা আজ ফকির বাড়ীতেই সম্পন্ন হয়। ফকির জামাল বলে,
- হাশেম বাবাজি তালি, তুমি আমার এখানেই শয়ন যাও, না কি?
তীক্ষ্ম কণ্ঠে মোমেনা বলে উঠে।
- অন্য জায়গা শুলি, হাশেম ভাই-এর ঘুম হয় না ফকির বাবা- আর কথা না বাড়িয়ে ওরা সকলেই সবদেলের ঘরে চলে আসে। সবদেল বলে উঠে
- একটা ঘর, ভাই তুমাকে কুতাই যে শুতে দিই; তবে কথাই বলে, ‘‘যদি হও সুজন তেঁতুল পাতায় ন’জন। ’’
চৌকি আর ঘরের বাইরের বারান্দায় সকলের শোয়ার জায়গা হল শেষমেশ।
ক্লান্তি আর অবসন্নতা মূহুর্তেই গ্রাস করল সবদেল কে। হঠাৎ একদমকা বাতাস ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে দিল একরাশ বকুল ফুলের গন্ধ। তারপর ঘুম। শান্তিময় ঘুম। মাঝে রাতে সেই প্রশান্তির ঘুম ভেঙ্গে গেল সবদেলের, ফিসফিস শব্দে।
মোমেনা গদ গদ হয়ে বলছে
- ছাড় হাশেম ভাই, একদিনও একা থাকতে পারে না যেন; ফিসফিস করে হাশেমও উত্তর দেয়
- একা থাকলে ভয় হয়, পরীর ভয়
- এখন না আরো পরে, আমার বর এখানো মনে হয় জাগনা
- আরে তোর বর তো কানা; তার জাগা আর ঘুমানি তো একই। তন্দ্রার মাঝে চমকে উঠে সবদেল। এই গলার সাথে অনেক পুরান গলার মিল খুঁজে পাচ্ছে সে। এ মুহূর্তে ছেলে বেলার সেই হুজুরের গলার সাথে হাশেমের গলা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। প্রাণটা ছটফটিয়ে উঠে সবদেলের।
এত কষ্ট কেন এই ছোট্ট জীবনে-- ভাবতেই তার চোখের কোটর থেকে ফোটা ফোটা জল গড়িয়ে এসে মিশে যায় তেল চিট চিটে বালিশে। ঘুম হয় না আর। তারপরও বেঘোর ঘুমের ভান করে সকাল পর্যন্ত শুয়ে থাকল সবদেল। পরবর্তীতে রাতের ঘুম শত্রু হয়ে ওঠে সবদেলের। প্রায় আসে, মোমেনার দূর সম্পর্কের ভাই হাশেম আলী; মধ্যরাতে জমে উঠে ফিসফিস আলাপ।
মধ্যরাতে হাশেমের কণ্ঠস্বর মিলে যায় সবদেলের ছেলে বেলার সেই হুজুরের সুমিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের সাথে। চোখের কোটর থেকে লোনা জল এসে ভিজিয়ে দেয় তেলচিটে বালিস। ঘুমহীন নিথর পড়ে থেকে প্রাণপনে সবদেল ভোরের প্রতিক্ষা করে। ... এভাবে একের পর এক নির্ঘুম রাত কাটতে থাকে সবদেলের। চারদিকে অন্ধকার নিয়েও অন্তরে যে আলো জ্বলত তাও ধীরে ধীরে নিভে আসতে থাকে সবদেলের।
আবার এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় ফকির বাড়ীতে আসর বসে গানের। প্রাণ খুলে গান গেয়ে নিজে কেঁদে আর লোককে কাঁদিয়ে ঘরে ফেরে সবদেল। রাতে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে সে। পাশে শুয়ে মোমেনা বলে উঠে;
- আজ আপনের গান শুনলাম; কানা মানষের গলায় এ্যত সুর আসে কুত্থেকি?
- কেনে, কানাদের কি গলায় সুর থাকতি নেই? একটু ঝাঁঝের সাথে জিজ্ঞেস করে সবদেল। মোমেনা বলে উঠে,
- না তা না, ত্যাবে, মানষের চোখ ছাড়া আছেই বা কি?
হঠাৎ সবদেলের ভিতরটা তেতে উঠে।
অনেক দিনের বঞ্চনা আর উপেক্ষার দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। কানা সবদেলের ভিতরের সবকটা পুরুষ সিংহ এক সাথে হুংকার দিয়ে উঠে হঠাৎ। সবদেল এক ঝটকায় মোমেনার শরীরের উপর উঠে বসে। তারপর ব্যস্ত হয়ে উঠে সে। ঘটনার আকস্মিকতায় মোমেনা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়; প্রথমে সামান্য আপত্তি ও বাধা তৈরি করলেও, সবদেলের পৌরুষের কাছে সবকিছুই থেমে যায় এক সময়।
সবদেল এক অন্য দুনিয়ায় প্রবেশ করে। ঘামে ভিজে উঠে দুহটো শরীর; এক সময় সবদেল শিথিল হয়ে যায়। ঘামে ভেজা শরীরে আবার সে একরাশ বকুলের গন্ধ পেতে থাকে। তারপর দারুন এক অনুভূতি আর অবসন্ন শরীরে নেমে আসে তন্দ্রা দু’জনেরই।
সবদেল আর মোমেনার জীবন দু'মেরুর বাসিন্দা হয়েই কাটতে থাকে।
একদিন দুপুরে মোমেনা রান্নার পানি আনতে গিয়ে কুয়ার পাড়ে গড়িয়ে পড়ে গেল। ভর দুপুরে এহেন একটা ঘটনা! ফকির বাড়ীর সকলে একেবারে ছুটে আসল কুয়ার কাছে। সবদেল তখন ঘরে। চিৎকার শুনে সেও এগিয়ে যায় ফকির বাড়ীর উঠানে- ততক্ষনে মোমেনা কে ঘরে নিয়েছে মহিলারা। সন্ধ্যায় সকল মহিলারা সবদেলের কাছে মিষ্টি খেতে চায়।
বলে,
- ও গাতক, আমাদের মিঠাই খাওয়াও
সবদেল বলে উঠে,
- বউ মরছে আমার, আর মিঠাই খাবা তুমরা- এতো দেখি ভাল বিচার।
মহিলারা বলে উঠে,
- মরণ, গাতক দেখি কিছুই বোঝে না; ওগো তুমি বাপ হতি যাচ্ছ গো...
সবদেলের গোটা দুনিয়াটা এক কথায় দুলে উঠে। বাপ হিসাবে নিজেকে ভাবতে ভারি অদ্ভুত লাগে তার। পরমুহুর্তে গর্ভবতী বউটার লাজুক মুখটা দেখতে ইচ্ছা হয়।
এর মাঝেই শ্রাবণ শেষ হয়ে গড়িয়ে গেল আর কিছুটা সময়।
সারাদিনের কাজের মধ্যে সবদেলের মাথায় শুধুতার অনাগত ভবিষ্যতের কথা ঘুরপাক খায়। এই ভাবনায় সে তার নিজের কাজেও ভুল করে বসে। দিনের শেষে রাতে সবদেল স্বপ্ন দেখে, একটা ন্যাংটা শিশু সারা উঠান দৌড়ে বেড়াচ্ছে; বাড়ীর পাতিহাস গুলোকে একটা পাঠকাঠি দিয়ে মারতে যাচ্ছে; হাস গুলো প্যাক প্যাক শব্দ করে সারা বাড়ীময় ছুটে বেড়াচ্ছে। - হঠাৎ শেষ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় সবদেলের। মোমেনা কাতরাচ্ছে।
সবদেল চিৎকার করে উঠে,
- ফকির বাবা, বউ আমার কেমন করে গো ...
ফকির বাড়ী থেকে অনেকই দৌড়ে আসে। এক বউ বলে উঠে,
- মোমেনার বিদনা উঠেছে গো, ধাই ডাক্
একটা জ্বলন্ত হারিকেন আর একটা লাঠি নিয়ে একজন দৌড় দেয় পাশের গ্রামে ধাই ডাকতে। কেউ একজন চুলা জ্বালাতে বসে; গরম পানি লাগবে। শেষ রাতে ফকির বাড়ী হঠাৎ ই জমে উঠে। তবে কথার চেয়ে কাজ বেশী হতে থাকে।
অজানা আশংকায় গুমোট হয়ে উঠে বাড়ীর পরিবেশ। আর এই পরিবেশকে ভয়াবহ করে আশংকা ছড়িয়ে দেয় মোমেনার শরীর জল করা চিৎকার।
ধাই যখন এসে পৌঁছাল, তখন সব জোগাড় সম্পন্ন হয়েছে আর মোমেনা ও শিকড় উপড়ানো লাউয়ের ডগার মত নেতিয়ে পড়েছে। ধাই সময় নষ্ট না করে গম্ভীর মুখে মোমেনার ঘরে ঢোকে। নিরাপদ দুরত্বে বিচ্ছিন্ন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে পুরুষেরা।
এদিকে কোন কাজ না পেয়ে ওজু সেরে নামাজে দাঁড়িয়ে যায় সবদেল। তার মনে পড়ে, অনেক দিন নামাজ পড়া হয়ে ওঠেনি তার। মোনাজাতে পরম করুনাময়ের কাছে দু’হাত তুলে, সবদেল কিছুই চাইতে পারে না। এর মাঝেই ধাই এর গলা শোনা যায়;
- ওরে সবদেলের খোকা হয়েছে
সাথে সাথে স্বস্তি আর গুনজন ছড়িয়ে পড়ে ফকির বাড়ীর উঠানে। গুনজন অতিদ্রুত আনন্দ চিৎকারে রুপান্তরিত হতে থাকে।
সবকিছু ফেলে পরিমরি করে দৌড় দেয় সবদেল। ধাই এর সামনে গিয়ে, ধাই কে জড়িয়ে ধরে, চিৎকার করে উঠে সবদেল,
- ধাই, সত্যি বল, আমার খোকা হয়িচে?
- হ্যাঁ গো! তুমার খুকা আর তুমার বউ ...
বাঁকি কথা গুলো ঢেকে যায় সবদেলের চিৎকারে। সবদেল বলে উঠে,
- আমাকে তুরা বোল, আমার বিটার নয়ন আছে তো? ও দেখতি পাচ্ছি তো? ও ধাই? ধাই বলে উঠে,
- ও বাপ সব ঠিক আছে। তুই কোন চিন্তা করিস না
সবদেল আরও এগিয়ে আসে ধাই এর কাছে। তারপর দুটো খেজুরের কাঁটা হাতে নিয়ে বলে উঠে,
- ধাই, ওর চোখটা তুমি এই কাঁটা দিয়ে নষ্ট করে দাও; আমি কাউকে কিছু বলব না; তুমার পায়ে ধরি, চোখ দু'টো নষ্ট করে দাও।
আমার বাপ, আমার মানিক কানা হোক; অন্ধ হোক! অতি সুন্দর পাপময় এই পৃথিবী না দেখুক! বড় কষ্ট, বড় কষ্ট! বলেই, হতবাক নিস্তদ্ধতা কে খান খান করে সে ডুকরে কেঁদে উঠে। তখন দূরের মসজিদে আজান শুরু হয়েছে। সবদেল কেঁদেই চলে---
আগস্ট ১৩, ২০১১
শাশ্বত নিপ্পন
শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী
ও নাট্যজন।
মোবাইলঃ ০১৯১৬ ৬৮৯১৩৭
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।