অভিবাসীদের দেশপ্রেম, পরবাসে রাজনীতি ও বাঙালি প্রজন্ম
ফ কি র ই লি য়া স
========================================
মাঝে মাঝে কিছু দুঃসংবাদ আমাকে খুব আক্রান্ত করে। মর্মাহত হই। মুষড়ে পড়ি। তেমনি একটি সংবাদ আমাকে আবারও ভারাক্রান্ত করল। তারেক মাসুদ সড়ক দুর্ঘটনায় চিরবিদায় নিয়েছেন।
তারেক একসময় যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী ছিলেন। লাখো তরুণ যখন সুখী জীবনের জন্য বিদেশে আসছিল, নব্বইয়ের দশকে তারেক মাসুদ তখন দেশকে ভালোবেসে, দেশের জন্য কাজ করার প্রত্যয় নিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছিলেন। বলেছিলেন, আমি এই মাটির ঋণ শোধ করতে চাই। তারেক বিদেশে আমাদের স্বজন ছিলেন। কত প্রাণবন্ত তার আড্ডা।
বিদেশের প্রাচুর্য পিছু ফেলে দেশে গিয়েছিলেন তিনি। আজ ঘাতক বাস তাকেই হত্যা করল। হত্যা করল গুণী চিত্রগ্রাহক, মিডিয়াব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীরকে। মুহূর্তেই আমার মনে পড়ে যায়, শাহ এএমএস কিবরিয়ার কথা। তাকে খুনিরা হত্যা করেছে হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে।
তিনিও দীর্ঘদিন নিউইয়র্কে ছিলেন।
চাইলে তিনিও তো বিদেশেই শেষ জীবনটা কাটাতে পারতেন। মনে পড়ে, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরী যেদিন সিলেটে গ্রেনেড হামলার শিকার হলেন, কী মারাত্মক তাণ্ডব! নিজ জন্মভূমিতেই আহত হলেন এই কৃতী বাঙালি সন্তান। অটিজম বিষয়ে একটি সেমিনারে যোগ দিতে সম্প্রতি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন সায়েমা ওয়াজেদ হোসেন। তিনি অটিজম সংক্রান্ত বাংলাদেশ জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির প্রধান।
তার আরেকটি পরিচয় আছে, তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা। অটিজম বিষয়ে উচ্চতর লেখাপড়া করেছেন উত্তর আমেরিকায়। বাংলাদেশের মানুষ এই প্রথম বড় ক্যানভাসে সায়েমা হোসেনকে দেখলেন। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, রাজনীতি আমার রক্তে। আমি বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে চাই।
আমি চাই আমার সাধ্য, মেধা দিয়ে জাতির পাশে থাকতে। কিছুদিন আগে আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখেছি, সজীব ওয়াজেদ জয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেছেন। তিনি যে রাজনীতিতে আসছেন, তা প্রায় নিশ্চিত। তারও একটা বিশেষ পরিচয় আছে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দৌহিত্র।
শেখ হাসিনা তনয়। তিনি মার্কিন অভিবাসী। তার এই যোগদানের সংবাদে প্রবাসী বাঙালিদের অনেকেই বেশ খুশি। আবার অনেকে এই সংবাদকে পুঁজি করে বিদেশে বাংলাদেশের রাজনীতিকে চাঙ্গা করার কাজেও ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন। লক্ষ্য করেছি, বেড়ে যাচ্ছে বিদেশে বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি।
অথচ বাংলাদেশ সরকার বলছে, নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী বিদেশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোন শাখা থাকতে পারবে না।
আইন করে বিদেশে বাংলাদেশের রাজনীতি কি বন্ধ করা সম্ভব? এ নিয়ে দেশে-বিদেশে এখন তুমুল বিতর্ক হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রবাসবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও চেয়েছে আইন করে বিদেশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করা হোক। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় বলছে, বিদেশে রাজনীতির নামে কোন্দল বাড়ছে। এছাড়াও বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ‘বিনষ্ট’ করার জন্যও সরকারের মতে কিছু প্রবাসী দায়ী, যা তারা মুখ খুলে বলছে না কিংবা বলতে পারছে না।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ-কানাডায় বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের সরকারের অপকর্ম সম্পর্কে রিপোর্ট ছাপা হওয়ার পর সরকারকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক শুনানি অনুষ্ঠিত হয় প্রায় প্রতিবছরই। আর এসব শুনানির নেপথ্যে থাকেন বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগের সমর্থক প্রবাসী বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও নেতারা।
২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন চলে তা বিদেশে ব্যাপক আলোচনার ঢেউ তোলে। ধর্ষিতা পূর্ণিমা রানীর ছবি পাশ্চাত্যের মিডিয়াগুলোতে ছাপা হয়।
এভাবে ক্রমশ হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, টেন্ডারবাজদের প্রকাশ্যে গোলাগুলি প্রভৃতি ঘটনা বিদেশে নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আর বিদেশে যারা সরকারবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তারা সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্নভাবে লবিং করেন। অবস্থা এভাবেই চরম নাজুক ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ওই সময়ের চারদলীয় জোট সরকার বিদেশে বাংলাদেশের রাজনীতি বন্ধ করার চেষ্টা শুরু করে। এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত আইন দেশের অভ্যন্তরে অন্য কোন দেশের রাজনীতি করার প্রথাকে কোনভাবেই গ্রাহ্য করে না। যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন চালাতে হলে স্টেট সরকারের অনুমোদন নিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে চালাতে হয়।
নিবন্ধন ছাড়া কোন নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন তাদের কার্যক্রম চালাতে পারে না। কিন্তু প্রকৃত সত্যটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের ‘যুক্তরাষ্ট্র শাখা’র কারোই এদেশের অঙ্গরাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় (স্টেট অথবা ফেডারেল) সরকারের সঙ্গে কোন রেজিস্ট্রেশন নেই রাজনৈতিক দলের নামে। পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় তারা অন্য নামে এখন রেজিস্ট্রেশন নিচ্ছেন কিংবা নিতে শুরু করেছেন। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম জামায়াতের নামে পরিচালিত করছে না। যুক্তরাষ্ট্রে তাদের দুটি সহযোগী সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে পুরোদমে।
এগুলো হচ্ছে মুসলিম উম্মাহ ইন আমেরিকা (মুনা) এবং ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকা (ইকনা)। সে হিসেবে জামায়াতই যে অত্যন্ত স্মার্ট হয়ে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইংল্যান্ডে ‘দাওয়াতুল ইসলাম’ নামে জামায়াত চালাচ্ছে তাদের কার্যক্রম।
বর্তমান সরকার বিদেশে বাংলাদেশের রাজনীতি বন্ধের কথা মুখে যতই বলুক না কেন, আসলে এ ব্যাপারে তারা কতটা আন্তরিক, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপির বর্তমান সিনিয়র সহ-সভাপতি খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান বর্তমানে ইংল্যান্ডে অবস্থান করছেন।
ফলে তাকে ঘিরে বিলাতে বিএনপির রাজনীতি বেশ জোরেশোরেই আবর্তিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে গঠিত হয়েছে ‘তারেক পরিষদ’। অথচ অতীতে বিভিন্ন সময়ে তারেক রহমান বলেছেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা যেন বিদেশে দলীয় কোন্দলে না জড়িয়ে সেইসব দেশের মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত হন। অন্যদিকে তারেক রহমান একসময় সবদেশে বিএনপির শাখাকে নিয়ে বছরে একটি সম্মেলন করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন এই নিউইয়র্কেই ২০০৫ সালে। যদিও তা হয়নি।
এই সময়েও তারেক রহমান বিভিন্ন টেলিকনফারেন্সে বিদেশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার সাহস জোগাচ্ছেন।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন কিংবা প্রবাসবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিদেশে বাংলাদেশের রাজনীতি বন্ধ করার প্রচেষ্টা আর তারেক রহমানের বিদেশে বিএনপির ‘ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান’- দুটি বিষয় কি বিপরীতধর্মী হয়ে যাচ্ছে না? একই কথা আওয়ামী লীগের বেলায়ও প্রযোজ্য। তারাও দলীয় ব্যানারেই মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপি- সবাইকে নিয়েই সভা-সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানে আরেকটি বিষয় খুব সঙ্গতভাবে আলোচনায় আসছে তা হচ্ছে, বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির বেশকিছু কেন্দ্রীয় নেতাই মূলত বিদেশের বিভিন্ন দেশে দলীয় শাখার গ্র“পিং, কোন্দল জিইয়ে রাখছেন। এমন অভিযোগ করছেন প্রবাসের নেতাকর্মীরাই।
কারণ কিছু কেন্দ্রীয় নেতা চান, তারা ইউরোপ-আমেরিকায় এলে তাদের অনুগত নেতাকর্মীরা আদর-যত্ন করবেন। তারা চান বিদেশে তাদের একটা নিজস্ব গ্রুপ থাকবে। আর প্রবাসী নেতারা সে সুযোগ নিয়েই জড়িয়ে পড়েন দলীয় কোন্দল-গ্রুপিংয়ে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিদেশে যারা বাংলাদেশের রাজনীতি করছেন (বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায়) তারা অধিকাংশই কিন্তু ওসব দেশের অভিবাসন-নাগরিকত্ব নিয়েছেন। তাই বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তাদের রাজনীতি বন্ধের জন্য অনুরোধ করা যাবে না।
আর বিদেশে থেকে, বিদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে মাতৃভূমির রাজনীতি, গণতন্ত্র, অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থা নিয়ে উচ্চকণ্ঠে কথা বলার আগ্রহ-অধিকার একজন নাগরিকের থাকতেই পারে। তিনি যে দেশে থাকবেন, সে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতাকে তার বক্তব্যের পক্ষে প্রভাবিত করার অধিকারও তার আছে এবং থাকবে। যেমনটি যুক্তরাষ্ট্রে থেকে করছেন ফিলিস্তিনি-আমেরিকান, ইসরাইলি-আমেরিকান, মিসরি-আমেরিকান, লেবাননি আমেরিকান, ইরাকি-আমেরিকান, আফগান-আমেরিকানরা, তেমনি পারবেন বাংলাদেশী-আমেরিকানরাও। আর মধ্যপ্রাচ্যের মতো দেশগুলোতে, যেখানে রাজতন্ত্রের প্রথা পূর্ণাঙ্গরূপে বলবৎ, সেসব দেশের দোহাই দিয়ে বিদেশে রাজনীতি বন্ধের উদ্যোগ কতটা যুক্তিযুক্ত তাও প্রশ্ন হিসেবে থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রবাসে বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় বেড়ে ওঠা প্রজন্ম বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মোটেই কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
তারা ব্যস্ত প্রবাসে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে। সেই সঙ্গে তারা সম্ভব হলে সেসব দেশের মূলধারার রাজনীতি, অর্থনীতিতেই ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে। দুঃখজনক হচ্ছে, পরবাসে এসব নেতা দেশ, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রকৃত ঐতিহ্য ও কৃষ্টি-ইতিহাস প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে নানাভাবে কার্পণ্য করছেন, যা তারা আরও বৃহৎ পরিসরে করতে পারতেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালিদের মতে, বিদেশে বাংলাদেশের রাজনীতি বন্ধের উদ্যোগ না নিয়ে বর্তমান সরকার যদি বিদেশের পত্রপত্রিকায় নেতিবাচক সংবাদ শিরোনাম হওয়া থেকে বিরত থাকে, তবেই হতে পারে দেশ ও জাতির মঙ্গল।
আমাদের অনেক নেতাই বলেন, অভিবাসী মেধাবীরা দেশে আসুন।
কাজ করুন। যেতেও চান অনেকেই। কিন্তু দেশে কি কাজ করার সুযোগ-সুবিধা আছে? আমরা অভিবাসীরা তো একজন তারেক মাসুদকে হারাতে চাই না। একজন শাহ কিবরিয়াকে এভাবে খুন হতে দেখতে চাই না। চাই না আমাদের আনোয়ার চৌধুরীরা বাংলাদেশে গিয়ে আক্রান্ত হবেন।
যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারা তা ভাবেন? তারা দেশের মহাসড়কগুলোর উন্নয়নে উদার হতে পারেন না?
তারা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন না? কেন পারছেন না? আমাদের মানবিক বিবেকবোধ আর কত পদদলিত হবে? কথায় নয়, কাজেই প্রমাণ করতে হবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপক্ষ একটি পরিশুদ্ধ বাঙালি প্রজন্ম গড়ে তুলতে চায় দেশে-বিদেশে। আর এ জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে সব সৃজন ও সত্যের পক্ষে। দেশটিকে ভালোবাসার সড়ক তৈরি করতে হবে। যে সড়কে বিজয় নিশান উড়াবে মানবতা।
নিউইয়র্ক / ১৫ আগস্ট ২০১১
=========================================
দৈনিক যুগান্তর / ঢাকা / ১৬ আগস্ট ২০১১ মঙ্গলবার প্রকাশিত
ছবি- এলিসন ব্রাউন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।