সাপের শরীর হয়ে আঁধারের গাছ/ কুয়াশার বন্যায় ডুবো দেবী মাছ! প্রথমবারের মত ভারতে গিয়েছি। ইচ্ছে ছিল মুর্শিদাবাদের হাজার দুয়ারী দেখতে যাবার। মালদায় ছিলাম আমরা। মুর্শিদাবাদ পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। বড়দিনের আগের দিন।
বেশির ভাগ দোকান, ফুটপাতে ই ক্রিসমাস বুড়োর ছবি, পুতুল। টুকটাক নাস্তা সেরে বিশাল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। কিছুতেই তর সইছিল না। ডানে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি একের পর এক দরজা। এসব দরজা সবগুলো নাকি সত্যি নয়।
কিছু ফাঁকি বাজি দরজাও আছে। ধারনা করা হয় ৯০০ দরজা সত্য।
উইকি থেকে তুলে দিলাম। হাজার দুয়ারী সম্পর্কে;
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের মুর্শিদাবাদে অবস্থিত একটি রাজপ্রাসাদ ৷ এই প্রাসাদে অনেক দরজা আছে ৷ তার থেকেই প্রাসাদের এই নামকরন হয়েছে ৷ অবশ্য সব দরজা সত্য নয়, অনেক নকল দরজাও রয়েছে ৷ ১১৪ টা ঘর রয়েছে।
১৭শ শতাব্দী থেকে ইংরেজ শাসনের আগে পর্যন্ত সুবা বাংলা, বিহার ও ওড়িষার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ শহর ৷ এখানে রাজত্ব করতেন নবাবরা ৷ এখানকার নবাব হুমায়ুন জা ইউরোপিয় স্থপতি দিয়ে এই প্রাসাদ বানান ৷ অনেকে ভুল করে ভাবেন যে, এই প্রাসাদ বুঝি নবাব সিরাজুদৌলার তৈরি ৷ কিন্তু সিরাজের প্রাসাদের নাম ছিল হীরা ঝিল প্রাসাদ ৷ তা এখন ভাগীরথী নদীতে তলিয়ে গেছে ৷
হাজার দুয়ারী প্যালেসের প্রকান্ড সিঁড়ির পাশে এ কামান রাখা।
এই প্রাসাদ ইউরোপিয় ধাঁচে বানানো ৷ ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত ৷ তিনতলায় বেগম ও নবাবদের থাকার ঘর, দোতলায় দরবার হল, পাঠাগার, অতিথিশালা এবং একতলায় নানা অফিসঘর ও গাড়ি রাখার জায়গা আছে ৷
হাজার দুয়ারী প্যালেসের মধ্যস্থিত বাগান।
বর্তমানে ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষন এখানে একটা মিউজিয়াম বানিয়েছেন ৷ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটলাম। আমরা প্রচন্ড ভিড় ঠেলে ভেতরে এগিয়ে যেতে থাকলাম। মিউজিয়াম যেমন হয়, একেকটা ঘরে যাই আর মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। কখনো নিজেকে মনে হয় সেই রাজত্বের অংশ।
সিরাজউদ্দৌলার এবং তাঁর দাদার ব্যবহৃত তলোয়ার, নবাবদের বড় বড় পোট্রেট, এছাড়াও আরও অনেক কিছু দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম।
একদম সামনে থেকে।
ভেতরে সেই বিখ্যাত আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে খুব মজা পেলাম। আয়নাটি ৯০ ডিগ্রী এঙ্গেলে এমন ভাবে বানানো যে সামনে দাঁড়ালে আমি আমার মাথা দেখতে পাবোনা। মনে হবে গলাকাটা এক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।
পাশে দাঁড়ানো মানুষটি আমার মাথা দেখবে শুধু , শরীর দেখবেনা।
বের হয়ে সামনে ইমামবাড়া। কথিত আছে নবাব প্রতি রাতে একজন ভার্জিন কে বিবাহ করতেন এবং ইমামবাড়ায় রাত কাটাতেন।
ইমামবাড়ার ছবি।
দুপুরের খাবার সারলাম হোটেলে।
তারপর একটা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বসলাম। চুক্তিটা ছিল নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে এখানকার সমস্ত দর্শনীয় জায়গায় সে নিয়ে যাবে।
সব জায়গায়তেই ২ রুপি ৫ রুপির বিনিময়ে একজন গাইড নিতে হয়।
প্রথমেই আজিমুন্নেসা বেগামের কবরে গেলাম। মুর্শিদ কুলি খানের কন্যা ছিলেন তিনি।
কথিত আছে একবার তিনি ভীষন অসুখে পড়লে হাকিমের পরামর্শে বাচ্চা ছেলের ফ্রেশ কলিজা থেকে ওষুধ প্রস্তুত করে খেয়েছিলেন। কিন্তু সুস্থ্য হবার পরও তার প্রতিদিন কলিজা খাওয়ার অভ্যাস হয়ে যায়।
যখন নবাব তার কন্যা সম্পর্কে জানতে পারে তখন তাকে এবং তার স্বামী উভয়কে জীবিত দাফন করার হুকুম দেয়।
কলিজা খাকি আজিমুন্নেসা কবরের উপর দিয়ে সিঁড়ি করা হয়েছে। প্রচলিত যে তাকে অসম্মান জানানোর জন্য বুকের উপর দিয়ে উঠার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিশাল মাঠ রয়েছে, বাচ্চারা খেলছে । আমরাও একবার উঠলাম।
সিঁড়ির নিচের দরজার মত অংশটার পরেই তার এবং তার স্বামীর পাশাপাশি কবর।
এবার কাঠগোলা বাগানের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সেখানেও একজন গাইড নিলাম।
প্রথমে ঢুকতেই আমাদের টবের ভেতর কিছু কাঠগোলাপের গাছ দেখালেন তিনি যেখানে এমন ভাবে ভেতরে সংযোগ দেয়া এক গাছে পানি দেবার সাথে সাথে সব গাছে পানি চলে যায়। অবশ্য গাইডেরা অনেক মুখরোচক গল্প বলে।
মূল দালানের ছবি।
কাঠগোলা বাগানে একটা গোপন রাস্তা আছে। সোজা গঙ্গা চলে গেছে।
বিপদে রাজাদের পালিয়ে যাবার জন্য। পুকুর দেখলাম।
এই সেই পুকুর।
এখানে রানীরা গোসল করতো, চারপাশে খোজাদের পাহারায় রাখা হত।
(বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পড়েছিলাম একসময় খোজা দের পরিমান এত বেড়ে যায় যে বিদ্রোহ শুরু হয়।
সম্ভবত এগারো শতাব্দীর শেষ দিকে বিদ্রোহ হয় আর খোজাদের হাতে শাষনভার চলে যায়। সেসময় দেশে ভীষন অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল। এটা মনে হয় অনেক আগের ঘটনা। )
রাজা ধনপতি সিং দুগার এবং লক্ষীপতি সিং দুগার, আদিনাথ জৈন মন্দির টি তৈরী করেন ১৮৭৩ সালে হারেক চাঁদের মাধ্যমে।
এটি সেই আদিনাথ জৈন মন্দির।
ভেতরে রয়েছে পরেশনাথ মন্দির । সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরী। পরেশনাথের একটি মূর্তিও আছে সাদা মার্বেলের। লামচি প্রসাদ এটা খুঁজে পেয়েছিল।
জৈন ধর্মের উপাষক রা পশু হত্যা করতোনা।
তাই বড় বড় মাছদের মৃত্যু হলে কবর দিত। সে কবর হত আকৃতিতে তিনকোনা।
ডান্সিং ফ্লোর দেখলাম। কথিত আছে, এটির চারিদিক বেলজিয়াম কাঁচ দিয়ে ঢেকে দেয়া হত। নবাব দুগার প্রতি ৩০মিনিট নাচের জন্য ৫০০০ রূপি প্রদান করত।
লক্ষ্ণৌ থেকে বিখ্যাত বাঈদের নিয়ে আসা হত মনোরঞ্জনের জন্য। বিশ্বাস করা যায়!
এটি সেই ডান্সিং ফ্লোর।
বিকেল প্রায় শেষের পথে। কাটরা মসজিদে গিয়ে থামলো আমাদের ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়িতে চড়লে কেমন যেন নিজেকে রাজা বাদশার আমলের মানুষ মনে হয়।
এটি কাটরা মসজিদের একটি পিলার।
এক হাজার নামাজী নামাজ পড়তে পারে এমন করে বানানো হয়েছিল এ মসজিদ, এবং সামনের উন্মুক্ত অঞ্চল।
মুরশিদ কুলি খাঁ তার মৃত্যুর পরে তাকে সমাধিস্থ করার জন্য একটি প্রাসাদ বানিয়ে যান মসজিদের পাশে। তাঁর নামেই মুর্শিদাবাদ নামকরন করা হয়।
ফারাস খান কে সমাধিপ্রাসাদ বানানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।
। তিনি মন্দিরের আকৃতিতে সেই প্রাসাদ বানিয়েছিলেন। কথিত আছে তাঁর মৃত্যুর পর পায়ের ছাপ রাখা হয় সিঁড়িতে। তারপর তাকে সমাধিস্থ করা হয়। প্রাসাদের চূড়া প্রায় ৭০ ফুট উঁচু এবং সেখান থেকে মুর্শিদাবাদের বেশির ভাগ অংশ দেখা যায়।
অবশ্য সাধারন জনগনের সেখানে যাবার সুযোগ নেই।
কাটরা মসজিদ।
আরো দেখার জায়গা ছিল কিন্তু এনার্জি ছিল না। সন্ধ্যে প্রায় হব হব। বেরিয়ে আসলাম কিছুক্ষনের জন্য ঢুকে পড়া এক যাদুময় নগর থেকে।
কিছু স্মৃতি আর মন্ত্রমুগ্ধতা সাথী হয়ে রইলো আজীবনের জন্য। রাতের গাড়িতে ঘুমুতে ঘুমুতে মালদা ফিরে আসলাম।
আরেক দিন করবো বড় সোনামসজিদ ভ্রমনের গল্প।
এতক্ষন সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ সবাইকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।