আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অ্যা জার্নি বাই ভেসপা

ভেসপা দেখলে আমার প্রীতি জিনতার কথা মনে হতো। সেটা গত সপ্তাহ পর্যন্ত। ভেসপাতে চড়ে প্রীতি একটা বিজ্ঞাপনে ছোটাছুটি করছিল। এখন ভেসপা দেখলেই মনির ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। এ পালসার, সিডিজেডের বাজারেও যিনি ভেসপা নিয়ে ঢাকার বাতাস দূষণ করে চলছেন নিয়মিত।

গত পরশু মনির ভাইয়ের ভেসপায় চড়ে একটা লং ড্রাইভ দেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। মনির ভাইয়ের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, তার কোন কিছুতেই সমস্যা নেই। রাস্তায় যে কেউ তার আগে চলে যায়। বাস, রিকশা, সিএনজি এমন কী পায়ে হাঁটা মানুষও আগে চলে যায়। এ ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি মিনিমাম তিন থেকে চার গাল হেসে বলেন, আরে যাক।

কোন সমস্যা নাই। এভাবে দ্রুত গতিতে সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পিছিয়ে পড়ে চলছিল আমাদের ভ্রমণপথে এগিয়ে যাওয়া। পিছিয়ে পড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরও সম্যস্যাও তো আসছিল আমাদের সঙ্গে। সুন্দর গাড়ির কালো ধোয়া। বড় গাড়ির আকাশ ফাটানো আর্তনাদ।

সঙ্গে ছোট গাড়ির নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় আমাদের ওপর এসে আছড়ে পড়া। এত সমস্যার মাঝে মনির ভাই ভদ্রলোক, এককথার মানুষ। বলেই চলেছেন, আরে ভাই কোন সমস্যা নাই। আমিও কথা বাড়াই না। চলন্ত অবস্থায় চালকের সঙ্গে আর এ বিষয়ে কথা বলি না।

আমরা ধীর পদেক্ষেপে যতই এগিয়ে যাচ্ছি, দীর্ঘ যানজটে আমাদের গন্তব্য ধানমণ্ডির দূরত্ব ক্রমেই যেন বেড়ে চলছে। বারবার মনে হচ্ছে, সেই কবে মতিঝিল থেকে রওনা হয়েছি, মাত্র পল্টন। কিন্তু পল্টন হলেও আমাদের মনোবল টনটন ছিল লক্ষে আমরা পৌঁছুবই। আমরা এগিয়ে চলছি। চারপাশে দেখছিলাম নয়নাভিরাম রূপসী বাংলার (হোটেলের) দৃশ্যপট।

আর মুগ্ধ হচ্ছি প্রতিনিয়ত। এরপর আবার আপাদমস্তক বাংলার (বাংলা মটরের) দৃশ্য দেখেও কম মুগ্ধ হয়নি। মুগ্ধ হতে হতে কারওয়ান বাজার, পান্থপথ পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম ধানমণ্ডি। আহ্, কাক্সিত ধানমণ্ডি। মনির ভাইয়ের ভেসপার গতি এবং রোজার মাসের এ অসহনীয় যানজটে এত কাছের ধানমণ্ডিও স্বপ্নের জায়গায় চলে গিয়েছিল।

ধানমণ্ডি আর আমেরিকার দূরত্ব প্রায় সমানুপাতিক হয়ে গিয়েছিল। কাজ শেষে এবার ফেরার পালা। আবার সেই জ্যাম। আবার সেই মনির ভাইয়ের কচ্ছপগতির ভেসপা। এবার মনির ভাইকে বললাম, ভাই গতি বাড়ান।

বাসায় গিয়া ইফতার করতে হইব। মনির ভাইয়ের সেই সহাস্য মুখ, কোন সমস্যা নাই। চলে যামু। আপনে খালি ওঠে বসেন। ভালোভাবে গেলেও আসার পথে পথিমধ্যে শেষদিকে শুরু হল সমস্যাবিহীন মনির ভাইয়ের সমস্যা।

তার দুই মিনিটের একটা কাজ এসে পড়ল পল্টনের। এতক্ষন ধরে নরমাল চালক হিসেবে থাকা মনির ভাই ভেসপা সাইড করে পার্কিং করতে গিয়ে ধুম করে একটা লোহার বস্তুর ওপর দিয়ে ফুটপাতে উঠিয়ে দিতে চাইলেন। যেমন ধুম করে তিনি উঠতে চাইলেন, তেমনি ধুম করে আটকে গেলেন। ঘটনা কোথায় কী হল বুঝতে পারলাম না। ভেসপা আর আগে বাড়ে না।

তিনি ভেসপা থেকে নেমে টানেন, ভেসপা আগে চলে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে মনির ভাই? তিনি বললেন, কোন সমস্যা নাই। এখানেই রাখি। আপনে একটু দাঁড়ান, কাজটা সেরে এসে সব ঠিক করছি। বললাম, জলদি যান।

ইফতার ধরতে হবে। কোন সমস্য নাই বলে মনির ভাই হুটহাট কাকে যেন ফোন করে বিল্ডিং শনাক্ত করে উঠে গেলেন। মনির ভাই কোন সমস্যা নাই বলে গেছেন। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তাকে আর তার ভেসপাকে আমার একই রকম মনে হয়।

আমি এসব ভাবতে ভাবতে যখন মিনিট দশেক সময় পার করে ফেললাম, তখন মনির ভাই এক বিল্ডিং থেকে নেমে হাসি দিলেন, সরি। ভুল বিল্ডিংয়ে ঢুকে গেছিলাম। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চরম হতাশ হয়ে মনির ভাইকে বললাম, যান ভাই, জলদি যান। আবার মনির ভাই নিখোঁজ। আবারও পনেরো মিনিট পর কাকে যেন গালাগালি করতে করতে নামলেন।

বুঝলাম, তার কাজ হয়নি। এবার শুরু হল আসল যন্ত্রণা। সেই অবস্থা। ভেসপা স্টার্ট নিচ্ছে কিন্তু চলছে না। মনির ভাই টানেন।

ভেসপা নড়ে না। ভেসপাকে ডানে-বায়ে কাত-চিত করে আরও মিনিট পনেরো পর তিনি আবিষ্কার করলেন, সাইলেন্সার পাইপের সঙ্গে চাকা আটকে গেছে। শুরু হল সেটা বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা। প্রথমে এক লোহার খণ্ড, পরে ইট এবং সব শেষে স্থানীয় ফুটপাতের দোকান থেকে ওজন মাপার বাটখাড়া নিয়ে মনির ভাইয়ের সে কি প্রাণান্তকর চেষ্টা। অন্যদিকে আমার চেষ্টা বাড়ি গিয়ে ইফতার করার সম্ভাবনা ক্রমেই বিলীন হতে দেখলাম।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখেও অন্ধকার। মনির ভাইয়ের জবাব এই তো ভাই, আরেকটু। কোন সমস্যা নাই। ঠিক হয়ে যাবে। একদিকে ভেসপায় মনির ভাইয়ের ঠুশ ঠাশ আঘাত এবং মানুষের মুখ চেপে হাসাহাসি দেখে আমি মুখ গোমড়া করে ফেলছিলাম, মনির ভাই তখন ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে বললেন, ভাই, ঠিক হয়ে গেছে।

শুনে আমারও একটা ভুবন ভোলানো হাসি দেয়ার প্রস্তুতিলগ্নে মনির ভাই বললেন, কোন সমস্যা নাই, তবে এইবার একটু সমস্যা আছে। আমি বললাম, সেটা কি? মনির ভাই জানালেন আঘাতে আঘাতে সাইলেন্সার পাইপ ফেটে গেছে। এখন একটু শব্দ হবে। আমি বললাম, যাই হোক ভাই চলেন, আমাদের জার্নির ইতি টানানো দরকার। মনির ভাই বললেন, চলেন।

কোন সমস্যা নাই। পুনশ্চ : আসলেও আমাদের কোন সমস্যা ছিল না। মনির ভাইয়ের ভেসপা যে সাউন্ডে এগিয়ে চলছিল, বাকি পথ তাতে এলাকায় মুহূর্তেই ব্যাপক চাঞ্চচল্যের সৃষ্টি হয়ে গেল। সামনের বাস থেকে লোকজন যে যেভাবে পারছে দেখার চেষ্টা করছে, এত বিভৎস শব্দ করে কী যায়। কেউ কেউ আতঙ্কে রাস্তা থেকে ফুটপাতে উঠে গিয়ে দেখতে লাগল সড়কপথে স্টিমার এল কোত্থেকে? পল্টন ময়দানে একটা ছোট সভাকেও ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে দেখলাম এ শব্দের কারণে।

মোটামুটি রাস্তায় একটা তোলপাড় সৃষ্টি করে চলল মনির ভাইয়ের ভেসপা। একটা সময় গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। আমি থামলাম। ভেসপা থামল কিন্তু ভেসপার শব্দ আর থামে না। মনির ভাই আমাকে বিদায় দিয়ে বললেন, আপনি যান আমি এটাকে ঠিক করে নিয়ে আসি।

আমি বাসায় যাওয়ার জন্য বাসে উঠলাম। মনির ভাইও অমনক দূর চলে গেল। কিন্তু ভেসপার সেই তীব্র শব্দ একটুও দূরে সরল না। আমার ধারণা, আমাদের দূরত্ব এক কিমি. হয়ে যাওয়ার পরও আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে আমার কানে এসে ধাক্কা মারছিল মনির ভাইয়ের ভেসপার শব্দমালা, যা স্টিমারের শব্দের সমানুপাতিক ছিল। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.