বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
উদ। অত্যন্ত নকশাদার কাঠের তৈরি মধ্যপ্রাচ্যের একটি বাদ্যযন্ত্র। সব মিলিয়ে বারোটি তার, অবশ্য তারের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে; যাহোক, উদ-এর আকার নাশপাতির মতো, বেহালার মতো ফ্রেটলেস, অর্থাৎ বাদ্যযন্ত্রটির নেক-এ ফ্রেট বা পর্দা থাকে না।
উদ বাজাতে হয় ঈগলের পালক দিয়ে কিংবা জল-মহিষের শিং-এর তৈরি ‘পিক’ দিয়ে। যদিও উদ-এর উদ্ভব প্রাচীন মিশরে এবং পরবর্তীকালে তা পারসিকদের দ্বারা পরিমার্জিত হয়; তথাপি খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক থেকে এটি প্রধান আরবি বাদ্যযন্ত্র হয়ে ওঠে এবং সপ্তম/অস্টম শতকে স্পেনের মুসলিমদের মাধ্যমে পৌঁছে যায় ইউরোপে এবং তার পর ইউরোপীয় রেঁনেসার ভিত রচনায় রাখে গভীর অবদান ...
উদ
মুসলিম দার্শনিক আল ফারাবির মতে উদ আবিস্কার করেছেন আদম এর (ষষ্ট) বংশধর লামেখ। কথিত আছে লামেখ এর ছেলে মারা গেলে লামেখ তাকে গাছে ঝুলিয়ে রাখে। মৃত পুত্রের ফ্যাকাশে কঙ্কালের আকার দেখে অনুপ্রাণিত বোধ করে উদ তৈরি করেন লামেখ । অবশ্য এসব হল নিছকই বাইবেলিয় গল্প-গাঁথা।
ঐতিহাসিকেরা বলেন: উদ এর উদ্ভব প্রাচীন মিশরে; সেই ফারাও যুগে । সে সময় এটির নাম ছিল ‘নেফের’। তারপর পারসিকরা মিশর আক্রমন করল; তারা নেফের নিয়ে গেল পারস্যে এবং নেফের-এর নতুন নাম দিল: বারবেট। পারস্য থেকে এটি গেল উত্তরের রাশিয়ায়; সেখানে এটির নাম হল: ‘বালালাইকা’; রাশিয়া থেকে গেল পুবের চিনে, সেখানে এটির নাম হল পিপা; জাপানেও গেল; সেখানে এটির নাম হল: বিওয়া।
মনে রাখতে হবে উদ-এর প্রকারভেদ রয়েছে।
যেমন ইয়েমেন, সৌদি আরব, সিরিয়া, তুরস্ক -এসব দেশের উদ এর আকার একরকম নয়। কেননা, বাদ্যযন্ত্রের ওপর আঞ্চলিক প্রভাব পড়তেই পারে। উদ এর তার নিয়েও রকমফের রয়েছে। উদ-এ এক জোড়া এক জোড়া করে ৬টি তার থাকে। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে বারোটি তার থাকে উদ-এ।
তবে সবচে নীচের তারটি সিঙ্গেল হতে পারে আবার নাও হতে পারে।
পঞ্চম শতকে পারস্যের মাধ্যমে এটি এল আরবে । আরবে এর নাম হল: উদ। এর মানে কাঠ। ইউরোপের বাদ্যযন্ত্র ‘লুট’ শব্দের উৎসও এটি ।
অবশ্য বর্তমানকালের এক গবেষক মনে করেন, আরবরা বাদ্যযন্ত্রটির নাম রাখার জন্য ধার করেছিল পারসিক শব্দ ‘রুদ’। এই পারসিক শব্দ ‘রুদ’ মানে তার কিংবা তারযন্ত্র।
ইউরোপের ব্যরক যুগের শিল্পী মিচেলএ্যঞ্জেলো মেরিসি দ্য কারাভাজ্জিও-র আঁকা ‘দ্য লুট প্লেয়ার’। ইউরোপের বাদ্যযন্ত্র ‘লুট’ শব্দের উৎস উদ কিংবা রুদ। আমরা পূর্ব-পশ্চিমের মিলন দেখতে পাচ্ছি!
আরব বেদূঈনরা ছিল কবিতা-কাসিদার সমঝদার ; তারা কবিতার পাশাপাশি উদ বাজাত।
ইসলামের অভ্যূদয় ও সম্পসারণের সঙ্গে সঙ্গে উদ নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
কোপুয।
প্রাচীন তুর্কিদের উদ এর মতো দেখতে একটি বাদ্যযন্ত্র ছিল। বাদ্যযন্ত্রটির নাম কোপুয। প্রাচীন তুর্কিসমাজে কোপুয-এর তারগুলিকে যাদুকরী মনে করা হত।
তুর্কি সংগীতত্ত্ববিদরা মনে করেন বর্তমানকালের উদ এর উদ্ভব এই কোপুয থেকেই। তবে বর্তমানকালের আরবি উদ এবং তুর্কি কোপুয এর বাদনশৈলী এবং গঠন সম্পূর্নই পৃথক।
ইরাক বরাবরই ছিল উদ বাজিয়েদের তীর্থ; এখন মৌলবাদীদের হুমকির কারণে উদ বাজিয়েরা জন্মভূমি থেকে উৎখাত হয়ে যাচ্ছে ...
খলিফা হারুন আল রশিদের আমলে বাগদাদ-কেন্দ্রিক আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে উদের কদর ছিল। এই সময়ে বাদ্যযন্ত্রটির সংস্কার করেন আবুল হাসান আলী ইবনে নাফি (৭৮৯-৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ) নামে একজন অসাধারণ প্রতিভাবান গায়ক, কবি ও সংগীতজ্ঞ । যেমন, পঞ্চম জোড়া তার সংযোজন এবং ‘পিক’ হিসেবে ঈগলের পালক ব্যবহার।
আব্বাসীয় খেলাফতের সময় মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ছিল;নাফি অ্যারিস্টটল-এর রসিকতার স্মরণে উদ-এর চারটি তার রঞ্জিত করেন এবং পঞ্চম তারটি মানবাত্মার প্রতীক হিসেবে ঘোষনা করেন। যা হোক। নাফির এবং সাংগীতিক নিরীক্ষায় তাঁর সংগীতগুরু ইশাগ আল মাওসিলি ভারি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। তিনি খলিফার দরবারের অন্যান্য সংগীত শিল্পীদের নিয়ে নাফির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন এবং নাফিকে আন্দালুসিয়ায় নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে বাধ্য করেন। অবশ্য এই অনাকাঙ্খিত ঘটনাটি পরিনামে সংগীতবিশ্বের জন্য অত্যন্ত শুভ হয়েছিল।
মুসলিম স্পেনের মানচিত্র। নাফি যখন স্পেনে পৌঁছলেন সে সময় স্পেনের কর্ডোবা, সেভিল, গ্রানাডা-এসব নগর ছিল ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ট শিক্ষাসংস্কৃতির কেন্দ্র। মনে রাখতে হবে, কেবল সংগীত নয়- সুফিপ্রভাবিত স্পেনের নগরসমূহ মধ্যযুগের ইউরোপের চিন্তাশীল মানুষকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
নাফি যখন স্পেনে পৌঁছলেন -স্পেনে তখন উমাইয়া বংশের শাসন। তখতে খলিফা ২য় আবদুর রহমান।
নাফি কর্ডোবায় পাকাপাকি ভাবেই বাস করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। কর্ডোবার রসিক লোকজন নাফির নাম দিল ‘জেরিয়াব’ বা ‘কালোপাখি’। কেননা, নাফির গায়ের রং ছিল কালো। আর ছিল অসাধারণ মাধুর্যময় কন্ঠস্বর।
(আমি আবুল হাসান আলী ইবনে নাফির সঙ্গে বিশিষ্ট সুফি সাধক ও কবি হযরত আমীর খসরুর (১২৫৩/১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ) প্রচুর সাদৃশ্য পাই।
ভারতবর্ষের লোকে হযরত আমীর খসরু কে ভালোবেসে বলত ‘বুলবুল-ই-হিন্দ’। নাফি যেমন উদ এর সংস্কার করেছেন, হযরত আমীর খসরু তেমনি সেতারের বর্তমান রূপটি দিয়েছেন। প্রতিভাবান সংগীত সাধক হযরত আমীর খসরু রাগ ইমন এর স্রষ্টা। )
যা হোক, জেরিয়াব গ্রিক, পারসিক ও আরবি সংগীতের উপাদানের মিশ্রনে নতুন এক সংগীতধারা (জনরা) সৃষ্টি করলেন । কালক্রমে সে সংগীতই হয়ে উঠল ইউরোপীয় ক্লাসিকাল মিউজিকের ভিত্তি!
শিল্পীর চোখে আবুল হাসান আলী ইবনে নাফি।
অসম্ভব প্রতিভাবান একজন পলিম্যাথ। সভ্যতার প্রথম টুথপেস্ট এবং আর্মপিট ডিওডেরান্ট তৈরির কৃতিত্ব এঁরই। কর্ডোবা শহরে তৈরি করেছিলেন ‘স্কুল অভ মিউজিক। ’
ইউরোপীয় ছাত্ররা আসত সে স্কুলে।
দু’ ভাবে ইউরোপে পৌঁছেছিল উদ।
প্রথমত, ক্রসেডের সময় নাইট টেম্পলাররা (ইউরোপীয় খ্রিস্টান সৈন্য) এসেছিল জেরুজালেমে। তারা যখন পবিত্র ভূমি থেকে ইউরোপে ফিরে গেল, সেসময় তারা উদ নিয়ে গেল। উদ যথা সময়ে পৌঁছল ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে । এলিজাবেথিয় আমলে উদ রূপান্তরিত হল ইউরোপীয়ান লুট-এ। ফ্রান্সে উদকে বলা হল লুথ, জার্মানে লাউটি, ইতালিতে লিইওটো, হল্যান্ডে লুইট, স্পেনে লাউড, পর্তুগালে আলাউডি।
দ্বিতীয়ত: দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সকে বলা হয় প্রোভেন্স । প্রোভেন্স -এর ত্রুবাদূররাও উদকে ইউরোপে পৌঁছে দেয়।
গুস্তাফ ড্যোর-এর আঁকা ত্রুবাদূররা । মধ্যযুগের গীতিকবিতার সুরকার/গায়কদের বলা হত ত্রুবাদূররা। একথায় ত্রুবাদূররা হল ইউরোপের চারণকবি।
বাংলায় যেমন বাউলগন ...
মুসলিম স্পেন থেকে উদ ফ্রান্সের ত্রুবাদূরদের কাছে পৌঁছনোর পর যুগান্তকারী এক ঘটনা ঘটল। ‘জেরিয়াব’ কর্তৃক পরিমার্জিত উদের ধ্বনি মাধুর্যে ইউরোপের পূর্বতন রোম্যানটিক সুরের ধরনটি আমূল বদলে গেল। তারপর সে রোম্যান্টিক গীতিকবিতা, সুরেলা গান ও গভীর আবেগময়তা তৈরি করল রেঁনেসার মননের ভিত।
ইউরোপীয়ান লুট। উদ এর সঙ্গে পার্থক্য ইউরোপীয়ান লুট এ ফ্রেট বসানো।
আর উদ হল ফ্রেটলেস এবং উদ এর নেক ইউরোপীয়ান লুট এর নেক এর চেয়ে ছোট।
উদ আজও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে অসম্ভব জনপ্রিয়। উদকে বাদ্যযন্ত্রের রানী বলা হয়।
পিটার ডোরিয়ান এর বাজানো উদ
উৎসর্গ: এ লেখাটি মধ্যযুগের প্রতিভাবান সংগীতজ্ঞ জেরিয়াব কে উৎসর্গ করা হল। তিনি শুধু সংগীতজ্ঞ ছিলেন না ছিলেন কবি, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, জ্যোর্তিবিদ, ভুগোলবিদ এবং ফ্যাশন ডিজাইনার।
জেরিয়াব-এর করা নকশা। যা আজও মধ্যপ্রাচ্যে ও মধ্যএশিয়ায় তুমুল জনপ্রিয়।
ছবি ও তথ্য: ইন্টারনেট।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।