ইউরোপীয় সংসদ এবার সাখারভ পুরস্কারের পঁচিশতম বর্ষের উৎসব করল। সাখারভ পুরস্কার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এ পর্যন্ত মুক্তচিন্তার জন্য সাখারভ পুরস্কার পেয়েছে বিভিন্ন দেশের মানুষ, বসনিয়া, হারজেগোভিনা, কসভো, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিয়ানমার, আলজেরিয়া, তুরস্ক, সুদান, নাইজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, কিউবা, চীন, পূর্ব তিমুর, স্পেন, ফ্রান্স, বেলারুশ, লিবিয়া, তিউনেশিয়া আর বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আমি। কুড়ি বছর আগে পেয়েছি পুরস্কার।
এ বছর পেল পাকিস্তানের মালালা। পাওয়ার কথা ছিল হুইসেলব্লোয়ার অ্যাওয়ার্ড স্নোডেনের, শেষ মুহূর্তে মালালাকে পছন্দ করা হয়েছে। নভেম্বরের কুড়ি তারিখ ছিল শিশু অধিকার দিবস। ওই দিনই মালালাকে পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় সংসদ। আর এদিকে সাখারভ পুরস্কারপ্রাপ্তদের সতেরো তারিখ থেকেই মানবাধিকার বিষয়ে সেমিনারে অংশ নিতে হচ্ছে।
কুড়ি তারিখে শিশু অধিকার নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান হলো। কথা ছিল ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেবে মালালা। কিন্তু মালালা কোনো অনুষ্ঠানেই বলতে গেলে যোগ দেয়নি। শুধু এসেছে, পুরস্কার নিয়েছে, ভাষণ দিয়েছে, আমাদের সঙ্গে একটা গ্রুপ ছবি তুলেছে, চলে গেছে। পত্রপত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন হাঁ করে দাঁড়িয়ে ছিল, মালালা কোনো সাক্ষাৎকার দেয়নি।
দেবে না, আগে থেকেই মালালার বাবা জানিয়ে দিয়েছিলেন অবশ্য। আমি সংসদকে বলেছিলাম, মালালার সঙ্গে আমার একটা মিটিংয়ের ব্যবস্থা করতে। আমাকে পরদিন সংসদ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কারও সঙ্গেই কোনো কথা বলবে না মালালা। মালালা সংসদে পুরস্কার নিতে আসার পর দেখলাম সত্যিই কারও সঙ্গেই কথা বলছে না। ছবি তোলার পর আমি অভিনন্দন জানালাম।
ভাবলেশহীন মুখ মালালার। আমার পাশে ছিল বলে না হয় আমি অভিনন্দনটুকু জানাতে পেরেছি, কিন্তু সাখারভ লরিয়েটদের বেশির ভাগের পক্ষে সেটুকু জানানোও সম্ভব হয়নি। সাখারভ পুরস্কার যারা পায়, তাদের সম্মানে ইউরোপীয় সংসদের প্রেসিডেন্ট রাজকীয় ডিনারের ব্যবস্থা করেন। সেই ডিনারেও মালালা ছিল না। মালালা কী করবে না করবে, কোথায় যাবে, কার সঙ্গে কথা বলবে, কি বলবে অথবা কী বলবে না, বললে কতটুকু বলবে, সবই, যতদূর শুনেছি, তার বাবা বলে দেন।
মালালার পেছনে এখন গোটা পৃথিবী, সরকার তো আছেই, আছে পৃথিবীর প্রায় সব রাজনীতির জগৎ, গ্ল্যামার জগৎ, সিনেমা, সংগীত, বাণিজ্য, ফ্যাশন সব জগৎ। তালিবান প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে মালালা। সুসংবাদ বটে। তবে রেডিও-টিভিতে সাক্ষাৎকার না দিক, সাখারভ লরিয়েটদের যারা বিশ্বের নানা জায়গায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করছে, তাদের সঙ্গে কথা বলা এবং ইউরোপীয় প্রেসিডেন্টের ডাকা সাখারভ ডিনারে যোগ দেওয়া, আমি মনে করি, মালালার উচিত ছিল। এ তো বড় সুযোগ ছিল মালালার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করার!
পুরস্কার হাতে নেওয়ার পর মালালা তার লিখিত বক্তব্য যখন পড়ছিল, আমি তার খুব কাছে বসেছিলাম।
সংসদের প্রথম সারিতে বসানো হয় সাখারভ পুরস্কারপ্রাপ্তদের। চমকে উঠেছিলাম মালালার শুরুটা শুনে। মালালা শুরু করেছে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, পরম করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি বলে। ধর্মনিরপেক্ষ ইউরোপীয় সংসদে কেউ ঈশ্বর, আল্লাহ বা ভগবানের নামে ভাষণ শুরু করে না। তামাম মুসলিম জগৎ, বিশেষ করে পাকিস্তানিরা মালালার ইসলাম ভক্তি নিশ্চয়ই খুব পছন্দ করছে।
আর মালালা তো বলেছেই যে, পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায় সে, রাজনীতি করতে চায়। কোনো একদিন মালালা হয়তো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট হবে। অথবা হবে না। মালালা যেখানে আছে, সেখানেই থাকবে, মৌলবাদ বিরোধিতার প্রতীক হয়ে থাকবে। এটিই কি কিছু কম! মালালার বক্তব্যে নতুন কিছু ছিল না, প্রায় ওই একই ভাষণ যা সে দিয়েছিল জাতিসংঘে এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে।
বই আর কলম চাই। বই আর কলমই পৃথিবী বদলাতে পারে। তা ঠিক। তবে সব বই-ই পৃথিবী বদলায় না। তালেবানরাও বই পড়ে।
ধর্মগ্রন্থই বারবার পড়ে। বিজ্ঞান পড়ে না, ইতিহাস-ভূগোল পড়ে না, কলম দিয়ে তালেবানরা নাম লেখে কাকে কাকে জবাই করবে। সুতরাং কী ধরনের বই চাই এবং কী ধরনের লেখা কলম দিয়ে লিখতে চাই- সেসব উল্লেখ না করলে ব্যাপারটা বোধগম্য হয় না। ভারতীয় উপমহাদেশে নারী শিক্ষা কয়েকশ বছর আগেই শুরু হয়েছে, এই শিক্ষা মালালা শুরু করেছে ভাবলে ভুল ভাবা হবে। আফগানিস্তানে মেয়েদের স্কুল ছিল বলেই তালেবানরা সেসব পোড়াতে পেরেছে।
পাকিস্তানের সোয়াত ভ্যালি থেকে আসা একটা কিশোরী ওড়নায় মাথা ঢাকতেই পারে, বিশ্বাস করতেই পারে তার ধর্মে। বুদ্ধিসুদ্ধি আছে বলেই যে মাথার কাপড় ফেলে দেবে, নাস্তিক হয়ে উঠবে রাতারাতি, এরকমটা নাও হতে পারে। আমি মনে মনে চাইলেও জানি, এ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। জানি না ইংল্যান্ডের স্কুল-কলেজে পড়ে মালালা তার কিশোরী বয়সের প্রতিজ্ঞাকে ভবিষ্যতে কতটুকু মনে রাখবে বা মূল্য দেবে! বা আদৌ তার পক্ষে সম্ভব হবে কি না পাকিস্তানে কোনো দিন যাওয়ার, পাকিস্তানে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার, স্বপ্ন হয়তো স্বপ্নই রয়ে যাবে। মালালা সত্যি সত্যি এখন সোনার কাঠি ছুঁইয়ে জগৎ বদলে ফেলবে, শিক্ষার হার একলাফে আকাশে উঠে যাবে এ আমি মনে করি না।
কিছুই করার হয়তো আর প্রয়োজন নেই তার। মালালা মুখ বুঝে বসে থাকলেও মালালাকে দেখে প্রেরণা পাবে পৃথিবীর শত কোটি শিশু। কোনো নারী-বিরোধী শিক্ষা-বিরোধী মূর্খ কূপমণ্ডূকদের বাধা মানতে চাইবে না, প্রতিবাদ করবে, ইস্কুলে যাবে, বড় হবে। এখানেই মালালার সার্থকতা। গ্ল্যামার জগৎ ততদিন থাকবে, যতদিন মালালা মিডিয়ায় থাকবে।
এরপর যারা ভুলে যাওয়ার যাবে। বেশির ভাগই ভুলে যাবে। এর মধ্যেই 'মামলা ফান্ড' হৃষ্টপুষ্ট হলে পাকিস্তানি মেয়েদের শিক্ষার পেছনে খরচ করবে। আপাতত শুভ কামনা এর মধ্যে, এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক।
কুড়ি নভেম্বরের ডিনারে মালালার থাকার কথা ছিল, কিন্তু আগেই বলেছি যে, মালালা ছিল না।
ডিনারের এক একটা টেবিল ছিল একজন সাখারভ পুরস্কারপ্রাপ্তর। এক একজন পুরস্কারপ্রাপ্তকে ঘিরে টেবিলজুড়ে ইউরোপীয় সংসদ সদস্য আর কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি। ইরানি সাখারভ লরিয়েটের টেবিলের নাম তেহরান। আমার টেবিলের নাম ছিল ঢাকা। এ অবশ্য নতুন নয়।
পৃথিবীর অনেক দেশে যেখানে আমি ভাষণ দিয়েছি, সম্মানিত হয়েছি, আমার জন্য ওড়ানো হয়েছে বাংলাদেশের পতাকা। ডিনারে আমার পাশে বসেছিলেন জেন লাম্বার্ট। ওর সঙ্গেই খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল। জেন ইউরোপীয় সংসদে দক্ষিণ এশিয়ার দায়িত্বে আছেন। দক্ষিণ এশিয়া রীতিমতো তার নখদর্পণে।
বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বললেন, 'ইউরোপের সংসদে বিএনপির লবি ভীষণ ব্যস্ত'। আমি প্রশ্ন করলাম, 'আপনি কি জানেন বিএনপি একা নয়, সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী আছে?' 'নিশ্চয়ই জানি', জেন বললেন। তাহলে কি ইউরোপের উচিত ধর্মীয় মৌলবাদী কোনো দলকে সমর্থন করা? জেন হাসলেন। গত মে মাসে যখন আমি ইউরোপীয় সংসদের প্লেনারি সেশনে বক্তৃতা করছিলাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জামায়াতে ইসলামীর তাণ্ডব, নাস্তিক ব্লগারদের জেলে ভরা, জামায়াতিকে নির্বাচনের অনুমতি না দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে... অনেক সদস্যই সেদিন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে বলেছেন। ওদের সঙ্গে তর্কে আমি পেরে উঠিনি।
জামায়াতে ইসলামী সত্যিকার রাজনৈতিক দল নয়, এটি নিতান্তই একটা সন্ত্রাসী সংগঠন, সুতরাং ওদের নিষিদ্ধ করা যায়। না, আমার এই যুক্তি ওরা মানবেন না। নিষেধাজ্ঞায় ওরা বিশ্বাসী নন। চূড়ান্ত গণতান্ত্রিক হলে যা হয়! ইট-পাথরের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়েও পথে নামবেন।
ইউরোপের মানবাধিকারের আদালত দেখলাম এবার।
ওখানে সাখারভ পুরস্কারপ্রাপ্তদের সম্মান জানানো হলো। দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল ওখানে। খেতে খেতে মানবাধিকার আদালতের বিচারকের সঙ্গে গল্প করছিলাম। বাংলাদেশের আইনের অবস্থা নিয়ে বললাম, আমার উদাহরণ দিয়েই বললাম, কিছু ধর্মীয় মৌলবাদী আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছে, মাথার দাম ঘোষণা করেছে, ওই ফতোয়াবাজদের জেলে ভরার বদলে ওদের মাথায় তুলে নেচেছে, ওদের নির্বাচন করার সুযোগ দিয়েছে, সংসদের সদস্যও করেছে। আমার বইগুলো একের পর এক নিষিদ্ধ করেছে।
আমি বাংলাদেশের নাগরিক, তারপরও আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না আমার নিজের দেশে। মানবাধিকার কাকে বলে, জিনিসটা কী, খায় না মাথায় দেয়, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ আজও জানে না। বিচারক খুব দুঃখ করলেন। আমিও।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।
(বাংলাদেশ প্রতিদিন- এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। )
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।