বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতকের ইউরোপীয় সমাজে বিস্ময়কর নবজাগরণের কারণ কি? যে কোনও সামাজিক পালাবদলের পিছনে নানাবিধ কারণ সক্রিয় থাকে, নবজাগরণের পিছনেও বিবিধ কারণ বিদ্যমান ছিল, এর মধ্যে বাইজান্টিয়াম বা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যে গ্রিকভাষী পন্ডিত-শিল্পীদের ভূমিকা একটি। বাইজান্টিয়াম বা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যে গ্রিকভাষী পন্ডিত-শিল্পীদের মধ্যে প্রাচীন গ্রিকদর্শন ও শিল্পকলার চর্চা ছিল। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি - অর্থাৎ ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যেটি অটোমান তুর্কিদের দ্বারা অধিকৃত হয়ে গেলে গ্রিকভাষী পন্ডিত- শিল্পীরা নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে পশ্চিম ইউরোপে পাড়ি জমায়।
এদের সঙ্গে ছিল ধ্রুপদি গ্রিক জ্ঞানবিজ্ঞান, যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে ইউরোপ লাভ করে নবজাগরণের উদ্দীপনা।
তবে এই যুগান্তকারী ঘটনারও প্রায় দুশো বছর আগে ইউরোপে আরও একটি গুরুত্বপূর্ন ঘটনা ঘটেছিল -যে ঘটনার সঙ্গে স্পেনের প্রথাবিরোধী মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং যে ঘটনাটি সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষন করলে ইউরোপীয় রেনেসাঁয় ইবনে রুশদ এর প্রত্যক্ষ ভূমিকাটি সুস্পস্ট হয়ে ওঠে।
ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, ইতালিতে সামন্ততন্ত্র ক্ষয়ের যুগে পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীতে বিকশিত নতুন পুঁজিবাদী সমাজ সৃষ্টির সহায়ক প্রগতিশীল চিন্তাধারার উদ্ভব হয়েছিল। এটি মূলত মার্কসবাদী ব্যাখ্যা। এখন প্রশ্ন হল, এই প্রগতিশীল চিন্তাধারার উদ্ভব হল কেন? হল এই কারণে যে-দ্বাদশ শতকে আরব অনুবাদের মাধ্যমে অ্যারিস্টটলের দর্শনের সঙ্গে ইউরোপের চিন্তাবিদদের পরিচয় ঘটে গেছে।
আমরা যাকে আরব অনুবাদ বলছি, তাকে ইবনে রুশদ-এর দর্শন মনে করাই শ্রেয়। ইউরোপে প্রগতিশীল চিন্তাধারার উদ্ভবের পিছনে আরবকৃত গ্রিক অনুবাদ নয়- রুশদ এর অ্যারিস্টটলের দর্শনের ব্যাখ্যাই ছিল সক্রিয়। সে কথায় পরে আসছি।
এবার বলি অ্যারিস্টটলের দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ইউরোপের মনোজগতে কী পরিবর্তন ঘটল। ইউরোপে তখন রক্ষণশীল খ্রিস্টীয় সমাজ- বদ্ধ সমাজ ... ইউরোপের চিন্তার জগৎটি ছিল অনেকটা গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর ভাববাদী ধারনার মতোই আচ্ছন্ন।
অ্যারিস্টটলের ভাবনার জগতটি ঠিক সেরকমের নয়- প্লেটোর ছাত্র হলেও মৌলিক বিচারে অ্যারিস্টটলের অবস্থান প্লেটোর বিপরীত। প্লেটো মূলত ভাববাদী, তাঁর মনোভূমিটি ভাব-অনুভাবের অপার্থিব জগৎ। পক্ষান্তরে, ২৫০০ বছর পূর্বেও অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিল বিস্ময়করভাবে প্রাগ্রসর ও বৈজ্ঞানিক। ভৌত জগতকে অ্যারিস্টটল যেখানে বাস্তবসম্মত পদ্ধতিতে বিচারবিশ্লেষন করেছেন, প্লেটো মানুষের মনকে পৃথিবী ছাড়িয়ে সুদূর বিমূর্ত অজানালোকে নিয়ে গিয়েছিলেন। অ্যারিস্টটল মানুষকে বাস্তব পৃথিবীতে তাকাতে বললেন।
প্রাচীন গ্রিসের এই দুজন দার্শনিকের মানসজগতের এই যে পার্থক্য - তা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। যে কারণে, অ্যারিস্টটলই ঝিম মেরে থাকা ইউরোপীয় স্থবির মনকে বদলে দেওয়ার মূল কারিগর-প্লেটো নয়। (প্লেটো রঙ্গমঞ্চে উঠে আসবেন আরও পরে। সে ব্যাপারে পরে আলোচনা করব। ) তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, ইউরোপীয় স্থবির মনকে বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলের সুযোগ্য ব্যাখ্যাকার ইবনে রুশদের ভূমিকাও কিন্তু কম নয়।
যা হোক। বলছিলাম। দ্বাদশ শতকে আরব অনুবাদের মাধ্যমে অ্যারিস্টটলের দর্শনের সঙ্গে ইউরোপের চিন্তাবিদদের পরিচয় ঘটেছে। এখন প্রশ্ন হল: ইউরোপ এতকাল গ্রিক দর্শন থেকে কেন বঞ্চিত ছিল? অনুবাদের মাধ্যমেই কেন ইউরোপকে গ্রিক দর্শন গ্রহন করতে হল?
‘টেরর অভ হিস্ট্রি’ বা ইতিহাসের সন্ত্রাস বলে ইউরোপের ইতিহাসে একটি কথা আছে। তো এই ‘টেরর অভ হিস্ট্রি’ কি? ‘টেরর অভ হিস্ট্রি’ হল: ইউরোপের প্রতি এক রোমান সম্রাটের জঘন্য অবিচার, যে অবিচারের ফলে ইউরোপজুড়ে জ্ঞানবিজ্ঞান বিবর্জিত এক ভয়ানক অন্ধকার কাল-এর সৃষ্টি হয়েছিল ।
এই অন্ধকার যুগের সূচনাকাল ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে -এই কারণে যে- রোমান সম্রাট জাস্টিয়ান ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে এক আদেশ জারী করে রোমান সাম্রাজ্যের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দর্শনশাস্ত্রের পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ করেন। স্বাধীন চিন্তাভাবনার ওপর আক্রমন অবশ্য আরও আগে থেকেই সংঘটিত হচ্ছিল। ৩৯০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারটি ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশপ থিওফিলাস । ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে নব্যপ্লেটোবাদী দার্শনিক ও জ্যোর্তিবিদ হাইপাশিয়াকে প্রকাশ্যে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে ধর্মান্ধ খ্রিস্টানগন । তবে ৫২৯ খ্রিস্টাব্দের পরই গ্রিক দর্শন ইউরোপ থেকে সম্পূর্নরুপে অবলুপ্ত হয়ে পড়ে।
গ্রিক দর্শন আশ্রয় পায় প্রাচ্যে।
প্রাচ্যের পারস্যে। পারস্য ছিল উদার। খ্রিস্টীয় একেশ্বরবাদের গোঁড়ামিকে পারস্য পাত্তা দেয়নি। উপরোন্তউচ্চমার্গীয় দর্শনচর্চা বিদ্যমান ছিল পারস্যে ।
৫২৯ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যে দর্শনচর্চা নিষিদ্ধ হওয়ার আগে ৫২১ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের সাসানিদ বংশের ১ম খসরু নৌসেরবান (নতুন শাহ) উপাধি ধারণ করে পারস্যের সিংহাসনে আরোহন করেন। অসাধারন মানুষ ছিলেন সম্রাট ১ম খসরু। ইরানি ঐতিহাসিকরা আজও সম্রাট ১ম খসরুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রোমান সাম্রাজ্যে দর্শনচর্চা নিষিদ্ধ হওয়ার পরপরই সাত জন গ্রিক দার্শনিক এথেন্স থেকে হাতে প্রাণ নিয়ে কোনওমতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সম্রাট ১ম খসরুর এঁদের আশ্রয় দেন।
এর কারণ হয়তো সম্রাট ১ম খসরুর সঙ্গে রোমান সম্রাট জাস্টিয়ান এর বিরোধ। (আজকের ইরান-পাশ্চাত্য সঙ্কট নতুন কিছু নয়। ) সে যাই হোক। ৫৪৯ খ্রিষ্টাব্দে সংগঠিত এক যুদ্ধে সম্রাট ১ম খসরুর অধীন পারসিক সেনাবাহিনী রোমানদের সম্পূর্নরুপে পরাস্ত করে। পরাজিত রোমান সম্রাট কে সম্রাট ১ম খসরু কয়েকটি শর্ত আরোপ করেন।
এর মধ্যে অন্যতম হল: রোমান সম্রাট জাস্টিয়ান তাঁর সাম্রাজ্যে দার্শনিকদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করবেন।
যা হোক। পারস্যে গ্রিক দার্শনিকগনের বসবাসের সুবাদে পারসিক ভাষায় গ্রিক দর্শনের অনুবাদ সম্পন্ন হয়। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে আরবরা পারস্যে জয় করে। বিজিত রাজ্যের শিল্পসাহিত্য আরবরা ধ্বংস করে দিলে মানবসভ্যতা আজ এতদূর এগোত না।
কার্যত সেরকম হয়নি। ৭০৪ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আরবি ভাষায় গ্রিক দর্শনের (প্রধানত প্লেটো, আরিস্টটল ও পিথাগোরাসের দর্শন) অনুবাদ সম্পন্ন হয়। আল কিন্দি (৮০০-৮৭০), আল ফারাবি (৮৭০-৯৫০), ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) ও ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮) গ্রিক দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আরিস্টটলের দর্শনের গুরুত্ব অনুভব করে আরিস্টটলের দর্শনের নিজস্ব ব্যাখ্যা করার তাগিদ বোধ করেন। আল ফারাবি আরিস্টটলের টীকাভাষ্য রচনা করলেও তাঁর ব্যাখ্যায় নব্যপ্লোটোবাদী ( আলেকজান্দ্রিয় মরমীবাদ) প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
তবে এক্ষেত্রে ইবনে রুশদ অবশ্যই ব্যাতিক্রমী। তাঁর দর্শনে স্বাধীন চিন্তার স্ফূরণ লক্ষ করা যায়। তাঁর দর্শনের দুটি সিদ্ধান্ত ... (১) জগৎ শ্বাশত, জগৎ ঈশ্বরদ্বারা সৃষ্ট নয় । (২) আত্মা অমর নয়। কাজেই মৃত্যুর পর ব্যাক্তিগত পুনুরুর্জ্জীবন অসম্ভব।
রুশদের রচনাবলী প্রথমে হিব্রু ও পরে লাতিন ভাষায় অনুদিত হয়ে দ্বাদশ শতকে ইউরোপ পৌঁছে যায় । রেনেসাঁর সহায়ক প্রগতিশীল চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটিয়েছিল।
ত্রয়োদশ শতকে লাতিন ভাষায় রুশদ রচনাবলী অনুবাদ করেন প্রখ্যাত পন্ডিত মাইকেল স্কট । এরপর ইউরোপের বিদগ্ধ মহলে সাড়া পড়ে যায়। পরবর্তী শতকগুলিতে ইউরোপের ভাবজগতে রুশদ-এর বক্তব্য গভীর প্রভাব ফেলতে থাকে ।
এ প্রসঙ্গে বারট্রান্ড রাসেল লিখেছেন: ‘পেশাদার দর্শনের অধ্যাপক ছাড়াও বিশালসংখ্যক মুক্তচিন্তার অধীকারীদের বলা হল Averroists বা রুদশবাদী ; বিশেষ করে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে রুশদের অনুরাগীর সংখ্যা ছিল ব্যাপক। ’ (দ্র: হিস্ট্রি অভ ওয়েস্টার্ন ফিলসফি। পৃষ্ঠা, ৪২০)
রুশদের সবচে বেশি প্রভাব পড়েছিল ফ্রান্সিসকান স¤প্রদায়ের ওপর। সম্প্রদায়টির প্রবর্তক সাধু ফ্রান্সিস (১১৮২-১২২৬) ত্রয়োদশ শতকে বিলাসিতায় নিমজ্জ্বমান পোপ ও তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করেছিলেন।
খ্রিস্টীয় গোঁড়ারা অবশ্য রুশদবাদী দর্শনকে মানবতা থেকে বিচ্যুত বলেছেন।
কাজেই ধর্মতত্ত্বে রুশদদের অবস্থান ‘বিদ্রোহী’ হলেও ইউরোপজুড়ে স্বাধীন বুদ্ধিসম্পন্ন চিন্তাবিদেরা সমন্বয়ে অসংখ্য রুশদবাদী দার্শনিক দল গড়ে উঠেছিল। এই রকম একটি দলের নাম: ‘স্বাতন্ত্র্যের পুত্র। ’ এরা বিশ্বকেই ঈশ্বর ভাবতেন এবং ভাবতেন জগতের বস্তুসমূহ ঈশ্বরের অংশ। ক্যাথলিক খ্রিষ্টান চার্চের বিচারালয় থেকে দেওয়া হয় এদের জীবন্ত দগ্ধ করার আদেশ ; রুশদবাদীরাও নতজানু না-করে ঝাঁপ দিয়েছিলেন বিভেদের আগুনে । লক্ষ করুন, রুশদবাদী ‘স্বাতন্ত্র্যের পুত্র’ দলটিতে নারী সদস্যও ছিল! মাথা নত না-করে সে যুগের সত্য সন্ধানী নারীরাও অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলেন।
রুশদের এমনই প্রভাব! সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয় নবজাগরণ অবধি রুশদ-এর এই প্রভাব অব্যাহত ছিল। এরপর ইউরোপে রুশদ-এর প্রভাব হ্রাস পায়। যেহেতু তখন আরিস্টটলের প্রভাবই হ্রাস পাচ্ছিল। তখন বৈজ্ঞানিক যুগের সূচনা হয়েছে- আরিস্টটলের চিন্তাভাবনাকে বলা হচ্ছে যান্ত্রিক । আরিস্টটলের স্থলে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন প্লেটো।
প্লেটোর ইনট্রোভার্ট ভাবের জগৎটি আধুনিক ইউরোপীয় রোমান্টিকেরা আপন আপন কল্পনার অনুষঙ্গে আবিস্কার করে উদবেলিত হয়ে উঠছেন। এই কারণেই বাংলার রোমান্টিক-শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সাদৃশ্য প্লেটোর সঙ্গে -অ্যারিস্টটলের সঙ্গে নয়। বর্হিমূখি জগৎ অর্ন্তমূখী হয়েই তবে প্লেটোকে আবিস্কার করেছে। যে কারণে অস্টম-নবম শতকের আরব দার্শনিকেরা প্লেটোর গুরুত্ব উপলব্দি করতে পারেননি। কেননা, অস্টম-নবম শতক ছিল আরবদর্শনের প্রাথমিক যুগ।
দর্শনের প্রথম স্তরে মন থাকে বর্হিমূখী। যেমন গ্রিক দর্শনের জনক থালেসের সময় গ্রিক দর্শন ছিল প্রাথমিক স্তরে, যে কারণে থালেস ছিলেন বর্হিমূখী।
ইউরোপে রুশদের দর্শনকে কেন্দ্র করে নানারকম ব্যাখ্যাবিশ্লেষন চলছিল। অ্যারিস্টটলের সঙ্গে আরব সংশ্লিষ্টতা যেমন অনেক মুসলিম ধর্মবেত্তা (বিশেষ করে ইমাম আল গাজ্জ্বালী) মেনে নিতে পারেননি তেমনি অনেক ইউরোপীয় খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিকও মেনে নিতে পারেননি। এদের মধ্যে অন্যতম সেন্ট থমাস অ্যাকুইনাস (১২২৫-১২৭৪); তাঁর ২২ খন্ডে রচিত সুমমা থিওলজি গ্রন্থটি অ্যারিস্টটলের রচনাবলীর ওপর অ্যাকুইনাস এর নিজস্ব ব্যাখ্যা।
অ্যারিস্টটলের দর্শনের ওপর ভিত্তি করে লেখা বলেই ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপে প্রগতিশীল চিন্তাধারার উদ্ভবের পিছনে গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিল। তবে অ্যাকুইনাস রুশদের মতন সাহসী ছিলেন না। যে কারণে খ্রিস্টীয় বিশ্বাস বিরোধী বক্তব্য উপস্থিত করার সাহস পাননি অ্যাকুইনাস। এর অবশ্য কারণ ছিল। অ্যাকুইনাস ছিলেন স্কলাস্টিক দার্শনিক।
স্কলাস্টিক দার্শনিকগন ইউরোপের মধ্যযুগে খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে চার্চ ও অ্যারিস্টটলের দর্শনের সমন্বয় করেছেন। এই মতবাদে বিশ্বাসী দার্শনিকদের বলা হত স্কুলম্যান। স্কুল থেকেই স্কলাস্টিক।
ইবনে রুশদ এবং সেন্ট থমাস অ্যাকুইনাস এর অ্যারিস্টটল বিষয়ক লেখার কারণে দেখা গেল ক্রমে অন্যান্য ইউরোপীয় পন্ডিতেরা অ্যারিস্টটলের দর্শনকে কেন্দ্র করে আলোচনা-সমালোচনা শুরু করেন। শুধু পন্ডিতেরাই নয় অ্যারিস্টটলের দর্শন সাধারণ মানুষও পড়বার সুযোগ পাচ্ছে।
কাজেই অ্যারিস্টটলের দর্শন ঘিরে আলোচনা সমালোচনা অব্যাহত থাকে। সে যুগের সমস্যা সংক্রান্ত প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে-উত্তরও দেওয়া হতে থাকে অ্যারিস্টটলের দর্শনের আলোকেই...এবং অনিবার্যভাবেই রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের প্রশ্নটিও ওঠে। মানে, মানবীয় মননের ওপর চার্চ কর্তৃত্ব করার অধিকার রাখে কি না-এই প্রশ্নটিই বড় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, ইউরোপীয় সমাজ থেকে গীর্জের শাসন (ও শোষন) ক্রমেই শিথীল ও দূর্বল হয়ে পড়তে থাকে। ইউরোপ ধর্মসংস্কারে পথে যেতে থাকে...
এবং ...আশ্চর্য এই ...একইসঙ্গে চলতে থাকে আরব বিদ্বেষ।
তখন বলছিলাম। ...তবে রুশদের মতামত নিয়ে নানারকম ব্যাখ্যাবিশ্লেষন চলছিল। অ্যারিস্টটলের সঙ্গে আরব সংশ্লিষ্টতা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। এক শ্রেণির সংকীর্ণচেতা লেখক ইউরোপ থেকে আরব লেখনি তথা রুশদবাদ নির্মূল করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। পিদারক (১৩০৪-১৩৭৪) নামে একজন ইতালিও লেখক আরব তথা রুশদের চিন্তাভাবনা ইউরোপীয় পরিমন্ডল থেকে সমূলে উৎখাত করতে চাইলেন।
পিদারক লিখলেন: “আরবীরা শিল্প ও জ্ঞানের কোনও চর্চা করেনি, তারা কেবল গ্রিক শিল্প সংস্কৃতির কিছু কিছু অংশ রক্ষা করে চলেছিল। এবং আমি বিশ্বাস করি আরবের নিকট ভালো কিছু আশা করা যায় না ...”
রুশদের মতবাদের ওপর ইউরোপে দুইভাবে আক্রমন হয়েছিল। প্রথমত, ক্যাথলিক খ্রিষ্টান চার্চের বিচারালয় থেকে রুশদের অনুসারীদের দেওয়া হয় এদের জীবন্ত দগ্ধ করার আদেশ ; দ্বিতীয়ত, কতিপয় সংককীর্ণমনা লেখক আরব তথা রুশদকে উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে কলঙ্কিত করতে চেয়েছিল। লাভ হয়নি। ইতিহাস ইর্ষাকাতর বামনদের মনে রাখেনি, সভ্যতার জ্ঞানতীর্থে রুশদ তথা আরব অবদানকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ রেখেছে।
শুরুতে প্রশ্ন রেখেছিলাম। চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয় নবজাগরণ কারণ কি? নবজাগরণ পিছনে নানাবিধ কারণের কথা উল্লেখ করেছিলাম, বলেছিলাম ইউরোপীয়
নবজাগরণের পিছনে স্পেনের প্রথাবিরোধী মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ-এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ন! ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, রেনেসাঁ পূর্ব সময়ের ঘটনাবলী সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষন করলে ইউরোপীয় রেনেসাঁয় ইবনে রুশদ এর প্রত্যক্ষ ভূমিকাটি সুস্পস্ট হয়ে ওঠে। কেননা, রেনেসাঁর অন্যতম কারণ গ্রিক তথা অ্যারিস্টটলের দর্শন নয়- অ্যারিস্টটলের দর্শনের স্বাধীন ব্যাখ্যা। যে ব্যাখ্যার সন্ধান ইউরোপ রুশদের লেখায় পেয়েছে। তৈরি হয়েছে আলোরণ, বিস্ময় ও বিনম্র শ্রদ্ধা ।
যে ব্যাখ্যা দাবী করে ... জগৎ ঈশ্বর-দ্বারা সৃষ্ট নয়, জগৎ অনন্ত ও শ্বাশত । ( বিংশ শতাব্দীর জ্যোর্তিবিজ্ঞানী নার্লিকারের স্টেডি স্টেট থিউরি?) আত্মা অমর নয়- যে কারণে মৃত্যুর পর ব্যাক্তিগত পুনুরুর্জ্জীবন সম্ভব নয়; এসব প্রথাবিরোধী শাণিত বক্তব্যই দীর্ঘকাল ধরে স্থবির হয়ে থাকা ইউরোপীয় সমাজের ভিতে আঘাত করেছিল, তারপর ধর্মসংস্কার আন্দোলন ও রেনেসাঁর দিকে ধাবমান করেছিল।
রেনেসাঁর মূল শ্লোগান ছিল হিউম্যানিজম বা মানবতাবাদ। হিউম্যানিজম কি? স্বর্গীয় নির্দেশ নয়, মানবীয় কর্মকান্ডের মানবিক ব্যাখ্যাবিশ্লেষন । হিউম্যানিজম মানে ইবনে রুশদ, থমাস অ্যাকুইনাস বা ইমাম গাজ্জ্বালী নন।
রুশদ বলেছেন, ধর্ম কিংবা দার্শনিক মতবিরোধ থাকলেও নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিটি ধর্ম ও দার্শনিক মতই সত্য। এমন বলার সৎসাহস থমাস অ্যাকুইনাস বা ইমাম গাজ্জ্বালীর নেই। রুশদ বলেছেন: “ঈশ্বর নির্বিকার; কাজেই মানুষের কর্মকান্ডে ঈশ্বরের তথাকথিত স্বর্গীয় হস্তক্ষেপের প্রশ্নই আসে না। ”
এই হচ্ছে হিউম্যানিজম।
রুশদের স্বাধীন ও সাহসী বক্তব্য সেকালের খ্রিস্টবিশ্বাসী ইউরোপীয় সমাজে বিকল্প-ভাবনার দুয়ারটি খুলে দিয়েছিল।
এই ভেবে আমি প্রায়শ শিহরিত হই যে -ইউরোপীয় রেনেসাঁর মহৎ অনুপ্রেরণাটি এসেছিল প্রাচ্যভূমি থেকেই ...আর সেটাই তো স্বাভাবিক ...প্রাচ্য যে -হাজার বছরের পুরনো জ্ঞানসাধনার পবিত্র পীঠস্থান ...নৈলে সম্রাট ১ম খসরুর মতন জ্ঞানসাধক সম্রাটের জন্ম পারস্যে হয় কি করে-রোমানদের পরাজিত করে যিনি শর্তারোপ করেছিলেন: রোমান সম্রাট জাস্টিয়ান তাঁর সাম্রাজ্যে যেন দার্শনিকদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেন।
তথ্যসূত্র:
ক) রাহুল সাংকৃত্যায়ন : দর্শন দিগদর্শন (প্রথম খন্ড)
খ) বার্ট্রান্ড রাসেল :হিস্টরি অভ ওয়ের্স্টান ফিলসফি
গ) টি. জে লাভাইন: ফ্রম সক্রেটিস টু সার্ত্রে
ইবনে রুশদের জীবনী
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।