বাবা যুদ্ধাপরাধী আত্মগোপনে থাকা প্রয়াত সাবেক প্রতিমন্ত্রী রাজাকার সৈয়দ মহিবুল হাসান। কন্যা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশবাদী হয়েও বাবার '৭১-এর অন্ধকার জীবনের ছায়ায় হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের ইতিহাস আড়াল করেই ঢাকায় ওঠাবসা করেন সুশীলদের সঙ্গে। ওপরতলার মানুষের সঙ্গেই চলেন-ফেরেন। টিভি টকশোয় বড় বড় কথা বলেন পরিবেশ রক্ষার নামে। সেমিনার, গোলটেবিলে আকর্ষণীয় এই বেলার সুন্দরী নেত্রী মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন।
বলেন না শুধু হবিগঞ্জের চুনারুঘাট-বাহুবলের কুখ্যাত রাজাকার তার বাবা সৈয়দ মহিবুল হাসানের কলঙ্কিত জীবনের কথা। একাত্তরে নিজ এলাকার ত্রাস, পরিবেশ দূষণকারী মহিবুল হাসান পাক হানাদার বাহিনীর দোসর হওয়ায় স্বাধীনতার পর আত্মগোপনে চলে যান। যুদ্ধাপরাধের মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। '৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে তিনি বের হন। সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিএনপির এমপি-মন্ত্রী হন।
১৯৮৬ সালে এরশাদের জাপায় যোগ দিয়ে আবার '৯০-এর পতনে আত্মগোপনে চলে যান। ভাতিজা সৈয়দ লিয়াকত হাসান এখন চুনারুঘাট উপজেলা বিএনপির সভাপতি। আর সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এলাকায় মাঝেমধ্যে গোপনে যাওয়া-আসা করেন। ঢাকায় প্রথম আলো সিন্ডিকেট থেকে তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড চালান। সম্প্রতি এলাকায় সরেজমিন ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
অভিযোগ রয়েছে, আদর্শগত কারণে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সবার অগোচরে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সঙ্গেই। পরিবেশবাদী আইনজীবী হলেও গ্রেফতার হওয়াদের আইনি সহযোগিতা করতে তাদের উপদেষ্টা আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন রিজওয়ানা।
নরপতি গ্রামের কয়েকজন জানান, রিজওয়ানা তার আপন চাচাত ভাই চুনারুঘাটের ৬ নম্বর ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ লিয়াকত হাসানের মাধ্যমে নিজ এলাকায় তার বাবাসহ নিজের আদর্শ বাস্তবায়ন করতে পরোক্ষ মদদ দিয়ে যাচ্ছেন। পরিবারের সমর্থন নিয়েই লিয়াকত একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছেন নির্দ্বিধায়। শাহ্জানুর রহমান ওরফে ডালিম নামের এক ভাগ্নেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম আসামি 'মেজর ডালিম' নামেই গর্বের সঙ্গে ডাকেন রিজওয়ানা।
সৈয়দ মহিবুল হাসান গংয়ের দ্বারা নির্যাতিত পরিবারের অনেকেই রিজওয়ানা ও তার চাচাত ভাই লিয়াকতের ভয়ে কথা বলতে চাননি। আবার অনেকে কথা বললেও রাজি হননি নিজেদের নাম প্রকাশ করতে।
জানা গেছে, '৬৪-এর তৎকালীন প্রাদেশিক নির্বাচনে ফুল প্রতীক নিয়ে মুসলিম লীগের হয়ে পার্লামেন্ট মেম্বার নির্বাচিত হন চুনারুঘাট-বাহুবল আসনে। এরপরই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মহিবুল হাসান। স্বাধীনতাপন্থিদের ওপর নীরবে স্টিমরোলার চালাতে শুরু করেন।
একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় হবিগঞ্জের শান্তি কমিটির আহ্বায়ক হন মহিবুল হাসান। তার দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী হত্যা, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগ, ধর্ষণসহ নানা ধরনের নারকীয় তাণ্ডব চালান হবিগঞ্জ শান্তি কমিটির সেকেন্ড ইন কমান্ড সৈয়দ কায়সার আহমেদ।
চুনারুঘাটের ১ নম্বর ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর খান বলেন, স্থানীয় রাজাকারদের তথ্যানুযায়ী সৈয়দ মহিবুল হাসান ও সৈয়দ কায়সারের নির্দেশে পাকবাহিনী আমার ভাই শহীদ আবদুল কুদ্দুস খান ওরফে অনু মিয়াকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আমার ভাই তৎকালীন ৯ নম্বর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন আগে ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন তিনি।
পরে যুদ্ধ হয়ে গেলে তিনি কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন।
তিনি আরও বলেন, ওই সময় মহিবুল হাসানদের দাপটের কারণে গ্রামের কেউ টুঁশব্দ করারও সাহস পায়নি। তবে বিজয়ের আগমুহূর্তে মহিবুল হাসান ও বিজয়ের পর বেশ কয়েকজন শান্তি কমিটির নেতা আত্মগোপনে চলে গেলেও রাজাকারদের দণ্ড দেন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হবিগঞ্জ জেলার ডেপুটি কমান্ডার ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌরপ্রসাদ রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্বাধীনতার আগে ও পরে মহিবুল হাসান যা করেছেন তা কখনো ভোলার নয়। ভালো অভিনেতা ছিলেন তিনি।
মুখে প্রায় সময়ই হাসি থাকলেও তার কাজ ছিল অত্যন্ত জঘন্য। তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন এসডিএম কোর্টে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মামলাও হয়েছিল।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হবিগঞ্জ জেলা কমান্ডার অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী পাঠান জানান, 'মহিবুল হাসানের রক্তই তো রিজওয়ানা হাসানের শরীরে প্রবহমান। এক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে সে কাজ করতেই পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক।
'
এদিকে, রিজওয়ানার মদদে এলাকায় নানা ধরনের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন তার চাচাত ভাই লিয়াকত হাসান। জঙ্গি-সম্পৃক্ততারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চেয়ারম্যান হওয়ার করণে ক্ষমতার দাপটে সব অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন তিনি। শাইলীরাজ গ্রামের হতদরিদ্র ৯০ বছর বয়সী মান্নানের মা রহিমা বিবি ১৪ বার বয়স্ক-ভাতা কার্ডের জন্য আবেদন করেও পাননি। ২০০৮ সালে লিয়াকতের সঙ্গে আপস না করার কারণে স্থানীয় কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের ভোটার তালিকায় নাম নিবন্ধনেও সাহস পাননি নিয়োগ পাওয়া মাঠকর্মী।
আবার জাল দলিল করে সিপাহ্সালার সৈয়দ নাসিরউদ্দীন (রহ.) মুড়ারবন্দ দরগাহ্ শরিফ দখলের অপচেষ্টা চালিয়েছিলেন লিয়াকত। পরে দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ওয়াক্ফ প্রশাসকের কার্যালয় আগের রেকর্ডকেই বহাল রাখে। ঐতিহাসিক মুড়ারবন্দ মাজার দখলের অপচেষ্টার বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়।
নরপতি গ্রামের অ্যাডভোকেট কুতুব উদ্দীন জানান, 'তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। ৯০ বছরের বৃদ্ধার সঙ্গেও তিনি প্রতারণা করেছেন।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পার হয়ে গেলেও লিয়াকতের মতো স্বাধীনতাবিরোধীরা এখনো তৎপর। পাঁচ-ছয়জন জঙ্গিবেশী অপরিচিত লোক সব সময় তার সঙ্গে থাকেন। তার চাচা মহিবুল হাসানের স্বাক্ষর ছাড়া পাকিস্তান আমলে কেউ আইডি কার্ডও পেত না।
মুড়ারবন্দ মাজারের মোতাওয়ালি্ল পীরজাদা সৈয়দ সফিক আহমদ (সফি) বলেন, 'ভালো মানুষের লেবাস পরে একের পর এক অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন লিয়াকত। পবিত্র মুড়ারবন্দ মাজারের পাঁচ একর জায়গা নিজের দখলে নেওয়ার জন্য তাদের পারিবারিক মসজিদে প্রায়ই অপরিচিত জঙ্গিদের আনাগোনা লক্ষ্য করা গেছে।
'
তিনি আরও বলেন, 'আমি নিজে সিপাহ্সালার নাসিরউদ্দীন শাহ্র ১৭তম বংশধর হিসেবে সৈয়দ পরিবারের সন্তান। লিয়াকত আমাদের পরিবারের আগে সৈয়দ না লিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে লেখায় তাদের পরিবার প্রকৃতপক্ষেই সৈয়দ কি না এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। '
এদিকে, সৈয়দ লিয়াকত হাসান তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, 'কিছু দুষ্টু লোক হীনউদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এসব ভিত্তিহীন।
'
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।