আমি ক্ষত বিক্ষত............... বিশ্বের প্রাচীনতম বাহন নৌকা। সভ্যতার ঊষালগ্নে আমাদের পূর্ব পুরুষরা যখন সভ্য হয়েও ওঠেনি, তখন হয়তো তাদেরই কেউ গাছের গুঁড়ি খুঁড়ে খুঁড়ে খোল বানিয়ে পানিতে ভাসিয়ে তার ওপর চেপে বসে। সেই থেকে মনের খেয়ালে নিজের অজান্তেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাহন নির্মাণের সূচনা করেছিল আদিম মানুষেরা। কালের বিবর্তনে গাছের গুঁড়ির সেই খোলকে অধুনিকায়ন করে আমরা নৌকায় রূপ দিয়েছি। তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থলের এই পৃথিবীতে নৌকার ওপর ভর করেই গড়ে উঠেছে আজকের সভ্যতা।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শহর ও শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে নৌপথ ও নৌকাকে কেন্দ্র করে। প্রাচীনকাল থেকেই দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাতায়াত, ভ্রমণ-বিলাস. ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্য আনয়ন সবকিছুই ছিল নদী ও নৌকাকেন্দ্রিক। যুগে যুগে নৌকা বাঙালির সংস্কৃতিরই একটি অংশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু উজানে পার্শ্ববর্তী দেশের নির্বিচার বাঁধ নির্মাণ, সরকারের তত্পরতা ও সংস্কারের অভাবে নদীগুলো আপন রূপ হারিয়েছে অনেক আগেই। সেই সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রাচীন এই ঐতিহ্যবাহী বাহনটিও।
বিশ্বে ৮০ প্রকারের নৌকার মধ্যে বাংলাদেশে ১৫ প্রকারের নৌকার প্রচলনের কথা জানা যায়। সাধারণত কাঠ দিয়ে নির্মিত নৌকার মধ্যে ছই বা ছাউনী, হাল, দাঁড়, পাল, পালের দড়ি, মাস্তুল, নোঙর, খুঁটি, দড়ি, গলুই, বৈঠা, লগি, গুন ইত্যাদি উপকরণ রয়েছে। একেক এলাকায় একেক ধরনের নৌকার প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। তবে এসব নৌকার মধ্যে বেশিরভাগই আজ বিলুপ্তির পথে। জ্যোত্স্না রাতে পাল ছেড়ে দিয়ে মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়ার সুমধুর সুর এখন শোনা যায় না।
নৌকায় চেপে নদীতে ভাসতে ভাসতে কুল কুল রবে বয়ে যাওয়া পানির শব্দ সাধনা করেও মেলে না।
বাংলাদেশে প্রচলিত নানা ধরনের নৌকাগুলোর মধ্যে—
বাইচ : মুসলিম শাসনামলে প্রতিযোগিতার জন্য বাংলায় বাইচ নৌকার প্রচলন শুরু হয়। এখনও কিছু কিছু এলাকায় বাইচ নৌকা টিকে আছে। এগুলো সাধারণত সরু ও লম্বায় ১০০ থেকে ৩০০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রতিযোগিতার সময় ১০ থেকে ১০০ জন মাঝি নৌকাটি পরিচালনা করে।
ডিঙি : দেশের সব থেকে প্রচলিত নৌকাটি হচ্ছে ডিঙি। নদীর পাড়ে কিংবা জলাশয়ের খুব কাছাকাছি থাকা মানুষ প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের জন্য এটি ব্যবহার করে। এগুলো সাধারণত ৫ থেকে ৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা। একজন লোকই বৈঠার সাহায্যে ডিঙি চালাতে পারে। অনেক সময় পালও ব্যবহার করা হয়।
পাতাম : পাতাম নামের এক ধরনের লোহার কাঁটা দিয়ে কয়েকটি কাঠকে জোড়া লাগিয়ে এই নৌকা তৈরি করা হয়। মালবাহী এ নৌকাগুলো ১২ থেকে ২০ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। ২ থেকে ৫ জন মাঝি এগুলো পরিচালনা করে। নৌকা চালাতে দুটি বৈঠার সঙ্গে একটি পালও ব্যবহৃত হয়। সাধারণত সিলেট ও কিশোরগঞ্জ এলাকায় এ নৌকার প্রচলন ছিল।
তবে নৌকাটি এখন বিলুপ্ত প্রায়।
কোষা : ৬ থেকে ১০ মিটার লম্বা কোষা নৌকাটি দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই দেখা যায়। বর্ষাকালে চরাঞ্চলের মানুষের নিত্যসঙ্গী কোষা। ৪ থেকে ৮ জন চরতে পারে এই নৌকায়। বৈঠা ও লগির সাহায্যে একজন মাঝিই নৌকাটি চালাতে পারে।
বিক : ১২ থেকে ১৭ মিটার লম্বার বিক নামের এই নৌকাটি ২৫ থেকে ৩২ টন পর্যন্ত পণ্য বহন করতে পারে। মালবাহী এই নৌকাটি সাধারণত ফরিদপুর অঞ্চলেই দেখা যেত। তবে ২৫/৩০ বছর আগেই নৌকাটি বিলুপ্তির খাতায় নাম লেখায়। এটি পরিচালনায় ৬ জন মাঝির প্রয়োজন হতো। এছাড়া দুটি পাল ছিল এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
দুই পালের মাঝখানটা একটি বাঁশের সঙ্গে লাগোয়া। নৌকার ছইটি থাকে পেছনের দিকে এবং আকারে অনেক ছোট।
সাম্পান : সমুদ্র এলাকার নৌকা সাম্পান। এই সম্পান নিয়ে কত জনপ্রিয় গান রচিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সাম্পানের সামনের দিকটা বাঁকানো চাঁদের মতো যাতে সমুদ্রের ঢেউ কেটে সামনের দিকে যেতে পারে।
আর পেছনের দিকটা একরকম সোজা বলা যায়। দেখতে অনেকটা হাঁসের মতো। বাংলাদেশে দুই ধরনের সাম্পান আছে। সমুদ্র উপকূলের আশপাশে চলার জন্য ছোট সাম্পান আর সমুদ্রে চলাচলের জন্য বড় সাম্পান। এসব সাম্পান দৈর্ঘ্যে ৬ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়।
গয়না : চমকপ্রদ এই নামের অধিকারী গয়না নামের এই যাত্রীবাহী নৌকাটি অনেক আগেই বিলুপ্তি হয়েছে। ৮ থেকে ১৪ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২ থেকে সাড়ে ৩ মিটার প্রস্থ নৌকাটি রাজশাহী ও কিশোরগঞ্জ এলাকায় প্রচলন ছিল। ৩০ থেকে ৫০ জন যাত্রী এই নৌকাটিতে বহন করা হতো।
ময়ূরপঙ্ক্ষী: রূপকথার গল্পের রাজ্যের এক অন্যতম উপাদান ময়ূরপঙ্ক্ষী নাও। প্রাচীনকালে রাজা বাদশাহরা এই নৌকায় চড়ে ভ্রমণ করত।
১১ থেকে ১৩ মিটার লম্বা এই নৌকাগুলো তুলনামূলক একটু বেশি চওড়া ছিল। এর সামনের দিকটা ছিল ময়ূরের অবয়ব। বাস্তবে না থাকলে কিছু কিছু পার্কে ময়ূরপঙ্ক্ষীর আদলে নির্মিত নৌকা দেখতে পাওয়া যায়।
বালার : কুষ্টিয়া অঞ্চলে প্রচলিত মালবাহী নৌকা বালার। ১৫ থেকে ১৮ মিটার দৈর্ঘের এই নৌকা চালাতে ১০/১২ জন মাঝির প্রয়োজন হয়।
এই নৌকা আকার অনুযায়ী ১৫ থেকে ৫৫ টন পর্যন্ত মালামাল বহনে সক্ষম। বৈঠা, লগির সঙ্গে জোড়া পাল টানিয়ে কখনও গুন টেনে এগুলো চালানো হয়। নৌকাটির প্রচলন কমে গেলেও এখনও বিলুপ্ত হয়নি।
বাতনাই বা পদি : ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য খুলনা অঞ্চলে যে মালবাহী নৌকাটির প্রচলন ছিল তার নাম বাতনাই বা পদি। ১৪০ থেকে ১৫০ টন পর্যন্ত মালামাল বহন করা হতো দৈত্যাকার এই নৌকাটিতে।
১৬/১৭ জন মাঝি লাগত নৌকাটি চালানোর জন্য। অনেক আগেই বাংলার ঐতিহ্য থেকে বিদায় নিয়েছে এই নৌকাটি।
মাছ ধরার নৌকা : মাছে ভাতে বাঙালির প্রিয় খাদ্য মাছ ধরতে নৌকার বিকল্প নেই। খাল, বিল, পুকুর, জলাশয় থেকে শুরু করে সমুদ্রের অথৈ জলে নৌকায় ভেসে ভেসে জেলেরা মাছ ধরে। একেক এলাকায় একেক ধরনের নৌকায় মাছ ধরা হয়।
৭ থেকে ৯ মিটার দৈর্ঘ্যের নৌকায় চেপে নদীতে মাছ ধরে জেলেরা। আবার চট্টগ্রাম এলাকায় এলে দেখা যাবে ১৮ থেকে ২০ মিটার দৈর্ঘ্যের সাম্পান আকৃতির বিশাল নৌকায় উত্তাল সাগর থেকে মাছ শিকার করছে জেলেরা।
বজরা : ১৩/১৪ মিটার লম্বা বজরা ছিল শৌখিন মানুষের ভ্রমণবিলাস। পরিবার পরিজন নিয়ে দীর্ঘ নৌ-ভ্রমণের জন্য বজরার তুলনা নেই। নৌকার বডির ওপর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হতো বিশেষ ধরনের ঘর।
রান্নাবান্না করার ব্যবস্থাও থাকত। ঠিক যেন ভাসমান বাড়ি। ১৫/২০ বছর আগেও পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় এই নৌকাগুলোর ব্যাপক প্রচলন ছিল। তবে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
জোড়া নৌকা : দুটি নৌকা পাশাপাশি রেখে বাঁশ দিয়ে জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হয় জোড়া নৌকা।
সাধারণত রাজশাহী অঞ্চলে পণ্য বহনে জোড়া নৌকা ব্যবহৃত হয়। এই নৌকাগুলো চালাতে ৪/৬ জন মাঝির প্রয়োজন হয়।
তালো ডোঙা : আস্ত তালগাছের গুঁড়ি খুঁড়ে খোল বানিয়ে বিশেষভাবে তৈরি নৌকার নাম তালো ডোঙা। চরাঞ্চলের দরিদ্র জেলেরা এখনও মাছ ধরার কাজে এই বিশেষ ডোঙাটি ব্যবহার করে। মাঝি ও যাত্রী যাই হোক না কেন একজনই চরতে পারে এই ডোঙায়।
ভেলা : গ্রাম বাংলার চিরচেনা একটি জলযানের নাম ভেলা। ভাসমান যে কোনো গাছের কয়েকটি অংশ একত্র করে এই ভেলা বানানো হয়। বর্ষাকালে খালে-বিলে গ্রামের দুরন্ত বালকদের কলার ভেলায় চড়ে উল্লাস বাংলার চিরচেনা রুপের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভেলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ডুবে যাওয়ার কোনো ভয় থাকে না। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।