বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা... দুই.
আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস কৈবর্ত সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাসে হয় কৈবর্তদের প্রধান দুই পূজা। মা-গঙ্গা পূজা ও মা-মনসা পূজা। মা-গঙ্গা হল কৈবর্তদের অন্নদাত্রী। আর মা-মনসা হল কৈবর্তদের রক্ষাকর্ত্রী।
মা-গঙ্গা হল মৎস্যের দেবী। মা-গঙ্গার ইচ্ছায় জলের মৎস্যরা চলাফেরা করে। আর এই মৎস্য হল কৈবর্তদের প্রধান জলশস্য। তাই মা-গঙ্গাকে কৈবর্তরা খুব ভক্তি করেন। মা-মনসা হল সর্পের দেবী।
সর্প হল জলের হিংস্র প্রাণী। কৈবর্তরা জলচর তাই সর্পের সাথে তাদের কোনো বিরোধ নেই। মা-মনসা তাই কৈবর্তদের রক্ষাদাত্রী। সাধারনত আষাঢ় মাসে হয় মা-গঙ্গা পূজা আর শ্রাবণ মাসে হয় মা-মনসা পূজা।
চট্টগ্রামের কৈবর্তরা প্রধানত দুই ধরনের।
সমুদ্র নির্ভর জেলে আর নদী নির্ভর জেলে। যুধিষ্টির কৈবর্তদের পূর্ব পুরুষরা বহু প্রাচীনকাল আগে থেকেই চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে মিরসরাই পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের উপকূলজুড়ে বসবাস করছে। পূজা-পার্বণ আর চৈত্র সংক্রান্তি হল কৈবর্তদের সবচেয়ে বড় উৎসব। আষাঢ় মাসের প্রথম দিন মা-গঙ্গা পূজা উপলক্ষে শৈলীরানী'র বাবা হরিদাস কৈবর্ত চন্দ্রমনিদের উত্তর পতেঙ্গার জেলেপল্লীর বাড়িতে এসেছে। উদ্দেশ্য মেয়ের বাড়ি মা-গঙ্গা পূজা শেষ হলে মেয়ে জামাইকে সাথে করে কৈবল্যধামে নিজের বাড়িতে যাবেন।
সাধারণত আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে কৈবর্ত সমাজে চলে মা-গঙ্গা পূজা। একমাত্র পুত্রবধূর বাবা বেড়াতে আসায় তাই চন্দ্রমনি'র বাবা যুধিষ্টির কৈবর্ত বেজায় খুশি। এবার তাই মা-গঙ্গা পূজায় যুধিষ্ঠির কৈবর্তের একটু বেশি খরচ করারও ইচ্ছে মনে মনে। অশোক বাবু'র কাছ থেকে নৌকা আর জালের জন্য যে দাদন নিয়েছিল সেই দাদনের টাকা আরেকটু বাড়ানোর জন্য তাই সন্ধ্যার পর যুধিষ্টির কৈবর্ত অশোক বাবু'র দারস্থ হলেন। প্রতি হাজারে ২০০ টাকা দাদন গুনতে হয় যুধিষ্টির কৈবর্তকে।
জাল নৌকার জন্যে এ বছর তিন হাজার টাকা আগেই ধার করা হয়েছে। অতিরিক্ত পাঁচশো টাকা নিলে দাদনের পরিমাণ বেড়ে দাড়াবে ৭০০ টাকা। কিন্তু অশোক বাবু বেঁকে বসলেন। হাজারে না নিলে পাঁচশোতে দাদন পড়বে ১২০ টাকা। উপায় নেই গোলাম হোসেন।
যুধিষ্টির কৈবর্ত তবু দোমনা দোমনা করে রাজী হলেন। সেই সুযোগে অশোক বাবু আবদার করলেন, আর মাছের হিসাব নিকাশ কি হবে?
এই এক নতুন মুশকিল এখন কৈবর্ত সমাজে আষ্টেপিষ্ঠে ধরেছে। এমনিতে হাজারে ২০০ টাকা দাদন। এছাড়া আবার মাছ যা ধরা পড়ে তার উপর একটা খবরদারী দাদনদারদের। জেলের ধরা মাছের দাম হাঁকাবেন দাদনদার।
সেই দামেই ঘাটে বসেই দাদনদারদের ভাড়াটে লোকদের কাছে মাছ বিক্রি করতে হয়। এমনিতে সমুদ্রে যেখানে কৈবর্তরা জাল ফেলে মাছ ধরে তার আয়তন দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। কৈবর্ত ছাড়াও এখন দাদনদাররা মুসলমানদের মাছ ধরায় উৎসাহিত করছে। এখন কৈকর্তদের চেয়ে মুসলমানরা দাদনদারদের কাছে সুলভে দাদন পায়। সেই দাদনের টাকায় তারা কৈবর্তদের 'পাতা'র সামনে জাল ফেলে।
পাতা হল কৈবর্তরা সমুদ্রে যেখানে জাল ফেলে সেই ঘেরের নাম। তো জোয়ারের সময় সমুদ্রের মাছ যখন দৌড়ছাপ করে, সেই মাছেরা কৈবর্তদের জালে ধরা পড়ার আগেই এখন মুসলমানদের সামনে পাতা জালে ধরা পরছে। ফলে কৈবর্তরা তীরে ফিরছে কম মাছ নিয়ে নতুবা কখনো একেবারে খালি হাতে। তবু দাদনের টাকা ছাড়া জলে নামার জো নেই যুধিষ্টিরদের।
বামুনঠাকুর পঞ্জিকা খুলে তিথি-নক্ষত্র দেখে মা-গঙ্গা পূজার দিনক্ষণ ঠিক করলেন।
সকাল থেকে তাই কাজরী বামুনঠাকুর পূজার আয়োজন নিয়ে মহাব্যস্ত। চন্দ্রমনি, চন্দ্রমনি'র বন্ধু নিখিল, দুই পিসি'র তিন ছেলে অমল, বিমল আর সুবল কাজরী ঠাকুরকে সহায়তা করছেন। জেলেপল্লীর চৌদ্দ পনেরো বছরের বালকরাও চন্দ্রমনিদের এটা ওটা ফাই ফরমায়েস খাটছে। যুধিষ্টির কৈবর্তদের উত্তর পতেঙ্গার জেলেপল্লী'র একেবারে বঙ্গোপসাগরের তীরের পাশেই চলছে এই পূজার আয়োজন। উত্তরমুখী করে তৈরি করা হয়েছে উঁচু মাটির একটি বেদি।
সেই বেদির উপর বসানো হয়েছে জলভর্তি মাটির একটি ঘট। ঘটের উপরে বসানো হয়েছে ডাঁটাসহ গোটা একটি নারকেল। আর নারকেলের চারপাশে আমের পাতা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বেদির ঠিক পেছনে একটি কচি কলাগাছ লাগানো হয়েছে। আর ঘটের সামনে নৈবদ্য দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।
কাজরী ঠাকুরের পরামর্শে ঢাঁকের বাজনা শুরু হল। সেই সঙ্গে জ্বালানো হল ধূপ আর মোমবাতি।
মা-গঙ্গা'র পূজার বেদী থেকে অল্প দূরে সারি সারি করে বাঁধা হয়েছে নৌকা। নৌকার গায়ে নতুন করে আলকাতরা মারার মসৃণ চিন্থ। নৌকাগুলোর আগা ও গোড়ায় নানা রঙের পাতা আর ফলের ছবি আঁকা হয়েছে।
নৌকাগুলোর আগার একেবারে বাইরের অংশে আঁকা হয়েছে দুটো করে মানুষের চোখ। জনশ্রুতি রয়েছে যে, নৌকার এই চোখজোড়াই গভীর সমুদ্রে রাতের আঁধারে নিজ মালিকদের জাল খুঁজতে কৈবর্তদের সাহায্য করে থাকে। কাজরী ঠাকুরের ইসারায় পূজা শুরু হল।
গোটা এলাকায় তখন কৈবর্তদের জেলেপল্লীর প্রায় সবাই উপস্থিত। কৃষ্ণ বৈরাগী'র পঞ্চ বাদক দল ধুমছে বাজনা শুরু করলো।
কৈবর্ত নারীরা সমস্বরে উলুধ্বনি দিল। এভাবে তিনবার পূজা করার পর কৈবর্ত নারীরা কূলায় পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে সারি সারি বাঁধা নৌকাগুলোর কাছে গেল। উলুধ্বনী দিতে দিতে তারা সিঁদুরের কৌটা থেকে ডানহাতের মধ্যমা দিয়ে সিঁদুর তুলে নৌকাগুলোর আগায় আগায় সিঁদুরের টিপ লাগাতে লাগলেন। আর মনে মনে কৈবর্ত নারীরা মা-গঙ্গার কাছে প্রার্থণা করলেন- 'তুমিই আমাদের দেবী। আমাদের জীবন-মরণ সব তোমার হাতে।
তুমি আমার স্বামী-পুত্রদের বেশি বেশি মাছ দিও। নইলে স্বামী সন্তান নিয়ে আমরা উপাস থাকবো। তুমি দয়া করো মা। আর আশির্বাদ করো যেনো আগামী বছর আবার তোমায় এভাবে পূজা দিতে পারি। '
চন্দ্রমনি'র বড় পিসি সরলাদেবীর ছেলে সুবল আগের রাতে উপোস ছিল।
কারণ, যুধিষ্টির কৈবর্ত মামার কেনা পাঁঠা বলি দেবে সুবল। বলির আগের রাতে বলিদানকারীর শুদ্ধচারী থাকার নিয়ম। তাই সুবল শাস্ত্রের সেই নিয়ম পালন করছে উপবাসী থেকে। পাঁঠা বলি'র সময়ে আবারো কৈবর্ত নারীরা সমস্বরে উলুধ্বনি দিল। গোটা জেলেপল্লী আজ যেনো নতুন সাজে সেজেছে।
সবাই নতুন জামাকাপড় পড়েছে। সবার মনে আজ ভারী আনন্দ। শত্রুতা ভুলে আজ সবাই একসঙ্গে কৃষ্ণ বৈরাগী'র পঞ্চ বাদকের ঢোকলের তালে তালে নৃত্য করছে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। ঢাঁক আর কাঁসার বাদ্যের তালে তালে গোটা বঙ্গোপসাগরেও যেনো আজ মাতম করা ঢেউয়ের নাচন।
পূজা শেষে কাজরী ঠাকুর পঞ্জিকা দেখে ঘোষণা করলেন, ৩রা আষাঢ় রাত্রি ৩টা ১৯ মিনিটে সমুদ্র যাত্রা শুভ। যুধিষ্টিরের সঙ্গে এবার সমুদ্রে মাছ ধরতে গেল বড় বোন সরলাদেবীর বড় পুত্র সুবল। আর পরদিন সকালে হরিপদ কৈবর্তের সঙ্গে কৈবল্যধামে রওনা হল চন্দ্রমনি আর তার প্রিয়াতমা নববধূ শৈলীরানী।
....................চলবে............................
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।