আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অজানায় যাত্রা

জীবন মানেই, অনিশ্চয়তায় গা ভাসিয়ে নিশ্চিন্তে পথ চলা। অনেক দিন হলো বাসায় যাই না। বাসায় যাবার জন্য মনটা ছটফট করছে খুব। কিন্তু কিছুই করার নেই, কালকে যে সারাদেশে কারফিউ। আর্মিদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মারামারি করেছে, এমনিতেই আর্মি মানেই তাদের ক্ষমতার শেষ নাই, তারপরেও দেশে চলছে সামরিক শাশন।

ক্ষমতার চেয়ে ওদের ভাবটা বেশি, ওদের ভাবটা দেখলে মাঝে মাঝে পড়াশুনা বাদ দিয়ে আর্মিতে ঢুকে যেতে ইচ্ছা করে। আমার আব্বুর অবশ্য ইচ্ছা ছিল আমি যেন আর্মিতে যাই, তার একটা সঙ্গত কারনও ছিল, আব্বু ছিলেন আর্মি অফিসার, সব বাপই চায় ছেলেকে তার নিজের পেশায় ঢুকাতে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খুব ইচ্ছা। ছোটবেলা থেকেই টিভিতে আর পেপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এতো নাম শুনতাম যে তখন মনে হত বাংলাদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় এটি। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলাপাইনগুলাই আর্মিদের সাথে মারামারি করে আমার বাসায় যাউয়া বন্ধ করে রেখেছে ভাবতে খারাপই লাগছে।

ঢাকায় এসেছি বেশিদিন হয়নি। কিছুদিন আগেই এইচ এস সি পরিক্ষা শেষ করলাম, ভর্তি পরিক্ষার জন্য কোচিং করতে এসেছি মাস তিনেক হল। ঢাকায় আত্মিয় স্বজন বলতে তেমন নেই, শুধু আছেন আমার দুরসম্পর্কের এক দাদা। দাদা খুবই ভালো মানুষ, আমি প্রথম যখন হোস্টেল খুজতে ঢাকায় আসলাম তখন উনি নিজেই বললেন, আমার এত বড় বাড়ি থাকতে তুই হোস্টেলে থাকবি কেন, আমার এখানেই থাক। আমারও থাকতে কোন আপত্তি ছিল না, কারন তখন মাথা গোজার একটা ঠাই পেলেই আমি বাচি।

তারপর থেকে উনার বাসায়ই আছি, বাসার লোকজন সবাই খুবি ভাল, তাই আমার থাকতে কোন সমস্যাই হচ্ছে না। ঢাকা শহরে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কার্ফিউ দেওয়া হয়েছে, দেশের অবস্থা খুবই খারাপ, এদিকে কালকেই আমার এইচ এস সি পরিক্ষার রেজাল্ট দেবার কথা, তাই আমার আর মন মানছে না। বাসায় আমাকে যেতেই হবে, যে করেই হোক। চাচ্চুকে বাসায় যাবার বাপারটা বললাম, উনি বললেন, কারফিউ তো শুধুমাত্র ঢাকায়, তাছারা কারফিউ কার্যকর হবে সকাল ৮ টা থেকে, তুই যদি সকাল ৮ টার মধ্যে ঢাকা ছাড়তে পারিস তাহলে বাসায় যেতে পারবি। চাচ্চুর কথায় আমি আস্বস্ত হলাম।

যাই হোক অবশেষে আমি বাসায় যেতে পারব, আম্মু আব্বু ভাই বোন সবার সাথে দেখা হবে, এই ভাবনা ভাবতে ভাবতে সারারাত ঠিকমত ঘুমাতেই পারলাম না। খুব ভোরে উঠলাম ঘুম থেকে, নামায পড়লাম, নাস্তা করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে এই ভেবে সকালের নাস্তা না করেই বেরিয়ে পরলাম বাসা থেকে, ঢাকা শহরে সবাই দেরি করে ঘুম থেকে উঠে, তাই কাউকে বলেও বেরুতে পারলাম না। বাসার সামনে থেকে একটা রিক্সা নিয়ে ফার্মগেটের উদ্দেশ্যে রউনা হলাম। রাস্তা পুরাই ফাকা, দুই একজন কে মাঝে মাঝে দেখা গেল মর্নিং ওয়াক করতে বের হয়েছে। শীতকাল আসতে এখনো অনেকদিন বাকি, কিন্তু হাল্কা কুয়াশা দেখা যাচ্ছে চারদিকে, ঢাকা শহরের এমন নির্জিব পরিবেশটা ভালোই লাগছে, মনে হচ্ছে মফস্বল কোন শহরে চলে এসেছি।

ফার্মগেটে চলে এসেছি, রাস্তায় সবে মাত্র দুই একটা বাস চলতে শুরু করেছে, আমি যাব গাবতলী, তাই গাবতলীগামী বাসের আশায় কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে আছি, অনেক্ষন হয়ে গেল বাসের কোন খবর নেই। ততক্ষনে বাসের আসায় দারিয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগল। এক সাথে কয়েকজন মানুষ দেখে আমিও আশ্বস্ত হলাম, এতক্ষন ভয় পাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল আমি দুনিয়ার সবচেয়ে বোকা মানুষ, যে দেশের এই খারাপ অবস্থার মাঝেও রাস্তায় বের হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে আমার দলেও অনেক মানুষ আছে। বাস এলো অনেক্ষন পরে, ততক্ষনে ভালই রোদ উঠে গেছে, সকালের রোদটা কেন যেন আমার কক্ষনই ভাল লাগে না, গায়ে কাটার মত বিধে, তারপরে আবার রাতে ভাল ঘুম হয়নি, তাই রোদটা একদমি সহ্য হচ্ছিল না।

বাসে উঠলাম ঠেলাঠেলি করে, ঊঠে দেখি বাসের ভেতরে মোটামটি ফাকা, সামনের দিকে কয়েকজন ফরমাল পোশাক পড়া লোক বসে আছে, দেখে মনে হচ্ছে তারা সবাই একই অফিসে চাকরি করে, আমার মত সাধারন মানুষও আছে কিছু। শেষের দিকের সাড়িতে কয়েকজন হুজুর বসে আছেন, মাঝের দিকে এত্তগুলা ছিট ফাকা রেখে একদম পিছনে গিয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকার মর্তবা আমি ঠিক বুঝলাম না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা তাবলিগ জামাতের লোক, পিছনে গিয়ে বসাটা হয়তবা তাদের কোন নিয়মের মাঝেও থাকতে পারে। যাই হোক না কেন এতো বোঝার সময় নাই, বাস পেয়েছি এতেই আমি মহা খুশি। বাস চলতে শুরু করেছে, আমি বসেছি এক পাঞ্জাবীওয়ালার পাশে, লোকটির বয়স বেশি নয়, আমাদের চেয়ে তিন চার বছরের বড় হবে হয়ত, কিন্তু তার চোখমুখে এতটাই চিন্তার আভা দেখা যাচ্ছে যে মনে হচ্ছে ডাক্তার তাকে তিন মাসের বেশি বেচে থাকার গ্যারান্টি দিতে পারছে না।

তার ডানহাতে ছোটখাট একটা ব্যান্ডেজ, মনে হয় গতকাল আর্মির সাথে ছাত্রদের মারামারির সময় সেও হয়ত সেখানে উপস্থিত ছিল, এবং কয়েকটা মার সেও হজম করেছে। বাসটি মানিক মিয়া এভিনিউ সবে পার হয়েছে, আসাদ গেট পাবার আগেই আড়ং এর সামনে দেখি অনেকগুলো আর্মি এবং র্যা ব দারিয়ে আছে, দেখেই আমার মনের মধ্যে ছ্যাত করে উঠল। তারা সব বাস থামিয়ে কি যেন চেক করছে, যথারিতী আমাদের বাসও থামানো হল। এক আর্মি উঠে সব যাত্রীদের একে একে নেমে আসতে বলল। তার কথামত সবাই আস্তে আস্তে নামতে শুরু করল, আমি আর আমার পাশের পাঞ্জাবীওয়ালা নামলাম সবার শেষে।

দুইজন আর্মি এসে সবাইকে সার্চ করা শুরু করল, এবং সবাইকে যার যার পরিচয় পত্র বের করতে বলল। আমার কাছে আছে কলেজের পরিচয়পত্র, আমি সেটাই বের করলাম। আমার পরিচয় পত্র দেখার আগেই আমাকে একজন জিজ্ঞাসা করল, কি করেন, আমি বললাম, আমি ছাত্র, সে আবার বলল, কোথায় যাবেন, আমি বললাম, গাবতলী যাব, ওখান থেকে বাসে করে বাসায় যাব। তারপর সে আমাকে একপাশে গিয়ে দারাতে বলল, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, একটু পরে পাঞ্জাবীওয়ালাও আমার পাশে এসে দাড়াল। আমি ভেবেছিলাম, আমি ছাত্র এই কথা বললে হয়ত আমাকে ছেড়ে দিবে কিছুই বলবে না, কিন্তু ঘটলো তার উলটা।

অন্য সবাইকে ছেড়ে দিয়ে শুধু আমাদের দুইজনকেই রাখা হলো। অদুরে আর্মির বিশাল বহর, আমাদের দুইজনকে নিয়ে যাউয়া হল সেখানে। যে আর্মি দুইজন আমাদের ধরে নিয়ে গেছে, তাদের একজন ওখানে দারিয়ে থাকা অন্য এক আর্মি অফিসারকে বলল, স্যার এই দুইজন ছাত্র। আর্মি অফিসারটি আমাদের কাছে চলে আসল, জিজ্ঞাসা করল, কোথাকার ছাত্র, আমি বললাম, আমি কলেজ ছাত্র, এইবার এইচ এস সি পরিক্ষা দিয়েছি, এখন বাসায় যাচ্ছি। আমাকে আবার বলল, তোর বাপ কি করে, আমি বললাম, আমার বাবা আর্মি অফিসার, কাদিরাবাদ ক্যান্ট্রন্মেন্টে আছেন।

সে ধমকের সুরে বলল, আর্মি অফিসারের পোলা হয়ে মারামারি করতে লজ্জা করে না, জানস না আর্মিদের ক্ষমতা কত, আমরা ইচ্ছা করলেই পুরা দেশ দখল করে বসে থাকতে পারি। তার কথা শুনে আমি নির্জিবের মত মাথা নিচু করে দারিয়ে থাকলাম। আমি মনে মনে বলছিলাম, মারামারি তো আর আমরা করি নাই, আমার তো কোন দোষ নাই, যারা করছে তাদের ধরেন গিয়া। আমার পাশের পাঞ্জাবীওয়ালাও দাঁড়িয়ে আছে নির্জিবের মতো, তাকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হলো, কিন্তু কোন উত্তর নেই। তার শরির চেক করে বের করা হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরিচয়পত্র।

পরিচয়পত্র পাওয়ামাত্রই শুরু হলো বেদম লাঠিপেটা, মনে হচ্ছিল, অফিসারটি তার সারাজিবনের জমানো সব শক্তি দিয়ে তার জনম জনমের কোন এক শত্রুকে মারছে। পাঞ্জাবীওয়ালার গা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পরা শুরু হলো। আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম, ভাবলাম আজকেই বুঝি জীবনের শেষ দিন। পাঞ্জাবিওয়ালাকে মারা শেষ হলো, এবার আমার পালা। স্কুলে থাকতে স্যারদের হাতের অনেক মাইর খেয়েছি, স্কুল পালানো আর পড়া না করার জন্য নিয়মিতই মাইর খেতে হত আমাকে।

কিন্তু স্যারদের মাইরের মাঝে এত নিষ্ঠুরতা ছিল না, ছিল গাধা পিটিয়ে মানুষ বানানোর মন্ত্র। কিন্তু আজ এমন একদল হায়েনার সম্মুক্ষিন হয়েছি যে নিজেকে হরিনের মতই অসহায় মনে হচ্ছিল। কয়েকটা লাঠির বারি হজম করলাম নিমেশের মদ্ধেই। অফিসারটি বলল, বাচতে চাইলে দৌড় দে এক্ষুনি নইলে কিন্তু মেরেই ফেলব। এই কথা শুনে আমি দিলাম একটা ভো দৌর, এত জোড়ে দৌর আমি জিবনেও দেইনি, স্কুল কলেজে আথলেটিক্সে কখনো হিটেই টিকতাম না, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে উসাইন বোল্টও আজ আমার সাথে দৌর দিয়ে পারবে না।

আমার হাতে একটা ব্যাগ, ব্যাগে কাপড় চোপড় আর বই দিয়ে ভর্তি, এই ভাড়ি ব্যাগটাকে এখন আমার কাছে তুলার বস্তার মতই পাতলা মনে হচ্ছে। নিজের উপরে খুবি রাগ হচ্ছে, আজকে কি না বের হলেই হতো না, কতদিনই তো হল আর দুই একটা দিন পরে গেলে কি খুব ক্ষতি ছি্ল। আমার মত নির্বোধের তো মাইর খাওয়া উচিত। দৌর দিয়ে ডুকলাম একটা গলির ভেতর, খেয়াল করলাম আমার পিছনে পিছনে পাঞ্জাবীওয়ালাও দৌরে আসছে। চারিদিকে কোন মানুষজন নেই, নেই কোন কোলাহল, নির্জিব পরিবেশটাকে পুরপুরি রাতের বেলার শ্বসান বা কবরস্তানের মতই লাগছে।

ফাকা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এবার খেয়াল করলাম, হায়েনাগুলার লাঠির বারিতে আমার হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে, আমার সাদা টি-সার্টের কয়েকটি জায়গায় ছোপ ছোপ রক্ত, পৃষ্ঠদেশে কয়েকটা জায়গায় ফুলে উঠেছে, ব্যাথা করছে চরম। কিন্তু ব্যাথাটাকে আমি কেন যেন পাত্তাই দিচ্ছি না। কারন সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত, এখন কই যাব কি করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। পিছে পাঞ্জাবীওয়ালাকে দেখে একটু সাহস পাচ্ছি।

ভাবছি এই ভয়াবহতার মাঝে আমি একা নই আমার মত আরেক পাবলিক আছে। অনেক্ষন ধরেই আমরা বিপদের সাথী অথচ এখনও তার পরিচয় জানা হয়নি। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাইয়া খুব কি বেশি লেগেছে? প্রশ্ন করার পর ভাবলাম এই প্রস্ন করা ঠিক হল কিনা? এত্ত মাইর খাওয়ার পর খুব বেশি লাগাটাই স্বাভাবিক, আমি খেয়াল করলাম উনি একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছেন, হয়ত পায়ে অনেক বেশি লেগেছে। পাঞ্জাবীওয়ালা মোলায়েম সুরে উত্তর করলো, নাহ তেমন লাগেনি, তবে পায়ের এইদিকে একটু কেটে গেছে মনে হয়। আমি বললাম, জানে বেচে এসেছি এই তো অনেক।

তারপর আমি তাকে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলাম, লোকটি তার পরিচয় বলল, কিন্তু সে আমার কোন কিছুই জিজ্ঞাসা করল না, তাই আমি নিজেই নিজের ঢোল পেটানো শুরু করলাম। পাঞ্জাবীওয়ালার ব্যাপারে যা জানলাম তা হলো, উনার নাম মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসে পড়েন, জহুরুল হক হলে থাকেন, বাড়ি দিনাজপুর। গতকাল মারামারির সময় তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ছিলেন, খুবি তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে কোন্দলের সুত্রপাত, তারপর বিশাল মারামারি। ওখান থেকে বের হবার সময় দেয়াল টপকাতে গিয়ে তার ডানহাত ছিলে গেছে তাই তিনি হাতে ব্যান্ডেজ লাগিয়েছেন। এবার দুইজন মিলে আলাপ করতে লাগলাম কই যাওয়া যায় এখন? মামুন ভাই বললেন, আমরা যদি কোনরকমে গাবতলী পৌছাতে পারি তাহলেই বাড়ি চলে যেতে পারব, কারন ঢাকার বাইরে কারফিউ নেই, বাস অবশ্যই চলবে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো যাব কিভাবে? রাস্তা দিয়ে তো যেতে পারব না, আর্মি দেখলেই আর রক্ষা নেই। এই এলাকায়ও পরিচিত কেউ নেই, তাহলে কি করা যায়। চিন্তা করে কোন কুল করতে পারলাম না। আমরা দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার পাশের একটি ছোট্ট চিপায়, যেন রাস্তা থেকে আমাদের দেখা না যায় এমন ভাবে দুজনকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। এমন সময় হঠাত রাস্তা থেকে হনহন করে হেটে চলা কিছু পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম, আর্মি ভেবে আমরা দুজন আরও গুটিশুটি মেরে বসে পড়লাম।

হাত দিয়ে এখনো রক্ত পড়ছে, শরিরের ব্যাথাটাও চরম ভাবে গ্রাস করছে, তাই বসে পড়তে কষ্ট হচ্ছিল খুব, তবুও বসলাম। ঠিক এমন সময় আল্লাহ যেন তার ফেরেশ্তা পাঠালেন, বাসের পিছনের ছিটে বসে থাকা সেই তবলীগ জামাতের হুজুরেরা আমাদের সামনে দিয়েই হেটে গেলেন, আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আর্মিরা নিশ্চই হুজুরদের কিছু বলবে না, সুতরাং হুজুরদের সাথে যাওয়াটাই মনে হয় বেশি নিরাপদ হবে। মামুন ভাই কে বললাম, চলেন আমরা হুজুরদের সাথে যাই, এখানে বসে থাকার চেয়ে উনাদের সাথে যাওয়াটা মনে হয় ভাল হবে, মামুন ভাই কোন কথা না বলেই আমার সাথে বেড়িয়ে পরলেন। আমরা হুজুরদের সাথে মিশে গেলাম।

মামুন ভাইয়ের পরনে পাঞ্জাবী আছে দাড়িও আছে খোচা খোচা তাই উনাকে তবলীগের লোকই মনে হতে লাগল, আমার পড়নে জিন্স আর টি-শার্ট, আমাকে হুজুরদের মত লাগছে না তাই আমি ব্যাগ থেকে পুরনো একটা ঢিলাঢালা শার্ট বের করে টি-শার্টের উপরে পড়ে ফেললাম। হুজুরদের একজনের কাছে থেকে একটা টুপি নিয়ে মাথায় দিলাম। এবার আর কেউ আমাকে সহজে ছাত্র ভাব্বে না। হুজুরদের সাথে মিরপুর রোড দিয়ে হাটতে হাটতে কল্যানপুর চলে আসছি। রাস্তায় অনেক আর্মি র্যা ব পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কেউ আমাদের কিছু বলছে না।

ব্যাপারটা মজাই লাগছিল বেশ, ভাবছি বাসের ভেতরেই যদি এই হুজুরদের সাথে ভাব জমাতাম তাহলে আর মাইরগুলা খেতে হত না, যা হবার হয়ে গেছে, এখন সেটা চিন্তা করে লাভ নেই, পরবর্তীতে কি হবে এখন ওইটা নিয়ে চিনতা করতে হবে। হুজুররা কল্যানপুর বাসস্টান্ডে এসে থামল, এখানকার মসজিদে ঊঠবে তারা, আমরা দুইজনও তাদের সাথে মসজিদে উঠে গেলাম। মসজিদে উঠে সুবিধাই হলো, একটু বিশ্রাম নেয়া যাবে এখানে। পানি দিয়ে রক্ত ময়লা পরিস্কার করে একটু ফ্রেস হলাম। হুজুরদের মধ্যে কেউ কেউ শুয়ে পড়ল আবার কেউ কেউ নামায পড়া শুরু করল।

আমি আর মামুন ভাই দুজনে শুয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। মামুন ভাই বললেন চল দেখি বাইরে কি অবস্থা, এই তবলীগের সাথে আর কতক্ষন থাকব, তার চেয়ে দেখি অন্যকিছু করা যায় কিনা। হুজুরদের টুপি ফেরত দিয়ে আমরা দুজনেই চলে আসলাম বাইরে। এসেই খুব দ্রুত অভারব্রীজ দিয়ে রাস্তা ক্রস করলাম। রাস্তা ক্রস করে পরলাম আরেক বিপাকে, আমরা যখন মসজিদ থেকে বেরিয়েছি তখন দেখলাম রাস্তায় কোন আর্মি নেই, কিন্তু রাস্তা পার হয়ে যখন এইপাশে এসেছি কোথা থেকে যেন পংগপালের মত আর্মি এসে আমাদের ধাউয়া দিল।

আমরা দৌরে এসে ঢুকলাম একটা ফোন ফ্যাক্সের দোকানে, দোকানী আমাদেরকে ভেতরে রেখেই দোকানের ঝাপ নামিয়ে দিল। ফোন ফ্যাক্সের দোকানে ঢুকে লাভই হলো, আমি আমার ফোনে কিছু টাকা ভরে নিলাম। কারফিউএর কারনে নেটওয়ার্ক বন্ধ তবুও মাঝে মাঝে দুই একটা কল দেয়া যাচ্ছে। দোকান থেকে বেরিয়ে পরলাম, এসে ঢুকলাম একটা চিপা গলির ভেতর, আর যাই হোক আর্মি এই গলির সন্ধান পাবে না এই ভেবে স্বস্তিতে রাস্তার উপরেই বসে পরলাম। এবার কল্যানপুর এলাকায় বন্ধুবান্ধব কেউ আছে কিনা চিন্তা করছি, এমন সময় মনে হল সুজনের কথা, সুজন আমার ক্লাসমেট, ও কল্যানপুরেই থাকে, কিন্তু ওর বাসায় আগে কখনো আসা হয়নি, ঠিকানাটাও জানি না।

ওর ফোন নেই, তবে ওর বাবার নম্বর আমার কাছে আছে, ট্রাই মেরে দেখা যাক, কিন্তু ফোন করার পর জানলাম, ওরা এখন ওদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে। ধুর!!! বেড়াতে যাবার আর কোন সময় পাইল না। এই বিপদের সময়ই যেতে হবে। সুজনকে মনে মনে কিছু গালি দিলাম। আরো দুই একটা জায়গায় চেষ্টা করেও কোন লাভ হলো না, এখন আমি পুরাই হতাশ, সবকিছুই অনিশ্চিত, মাথা পুরাই হ্যাং হয়ে গেল।

মামুন ভাইয়ের ফোন নেই, কেন নেই তারও একটা সঙ্গত কারন আছে, মামুন ভাইয়ের বাবা মারা গেছেন ছোটবেলায়, অভাবের সংসারে বড় ছেলে তিনি, টিঊশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালান, মাঝে মাঝে বাড়িতেও টাকা পাঠান। তাই নিজের একটা ফোন কেনার কথা চিন্তা করেননি কখনো। আমি যখন আসে পাশের কারো খোজ বের করতে পারলাম না তখন মামুন ভাই বললেন, তোমার ফোনটা দাও দেখি আমি চেষ্টা করে কিছু করতে পারি কিনা। আমি ফোনটা দিলাম, উনি মানিব্যাগ থেকে একটা এডড্রেস বুক বের করে কয়েকটা নম্বরে ট্রাই করলেন, কিন্তু বেশির ভাগই ঢুকল না। নেটওয়ার্ক মনে হয় একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে।

এই বিপদের সময় নেটওয়ার্ক না পাউয়ায় রাগে দুখে ফোনটাকে একটা আছাড় দিলাম, ফোনের ব্যাটারী খুলে পাশের ড্রেনের ভেতর পড়ে গেল। এতক্ষন তবুও সাথে একটা ফোন ছিল, এখন তাও নেই, নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে ছিরতে শুরু করলাম। পাগলই হয়ে গেলাম মনে হচ্ছে। এবার মামুন ভাই আমাকে সান্তনা দিবেন কি তা না, আমাকে ঝারি দিয়ে বললেন, এমন কেও করে এই বিপদের সময়। ভাই বললেন, আমার গ্রামের এক বড় ভাই থাকেন শুনেছি কল্যানপুরে, কিন্তু তার ঠিকানা তো জানি না, দেখা যাক কোথাও থেকে জোগার করতে পারি কিনা।

আমরা আবার চলে আসলাম সেই ফোন ফ্যাক্সের দোকানে, দোকানের আই এস ডি ফোন, এইটা দিয়ে নিশ্চই কথা বলা যাবে। মামুন ভাই কয়েক জায়গায় ট্রাই করার পর একটা ঠিকানা পেলেন, এইটা পেয়ে আমরা দুজনেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেল্লাম। কিন্তু মুল সমস্যা হলো, আমরা যাব কিভাবে? রাস্তায় তো র্যা ব পুলিশ আর আর্মির অভাব নেই, রাস্তায় বের হলেই আবার মাইর খেতে হবে নিশ্চিত। বসে পড়লাম দুইজন, ভাবতে ভাবতে হঠাত মাথায় এলো, আমরা কল্যানপুর বাজার থেকে কিছু কাচা বাজার করব, তারপর বাজারের ব্যাগের ভেতর জামা কাপর বই সব ঢুকাব, আর্মি ধরলে বলব বাজার করতে বের হইছিলাম, মামুন ভাইও আমার কথায় সায় দিলেন, ফোন ফ্যাক্সের দোকান থেকে কয়েক কদম এগুলেই কাচা বাজার। বাজারে গিয়ে আমরা আগে বড় দেখে দুইটা বাজারের ব্যাগ কিনলাম, তারপর আমাদের সাথে যা যা ছিল সব ঐ ব্যাগের ভেতর ভরলাম, বাজার থেকে কিছু আলু পটল, মাছ কিনে ভরে ফেললাম ব্যাগ।

বাসায় যাবার বাস ভাড়ার জন্য যে টাকা ছিল তার সিংহভাগই খরচ হয়ে গেলো এখানে। ব্যাপার না, বেচে থাকলে অনেক টাকা পাউয়া যাবে। এবার আমরা একটা রিক্সা নিয়ে মামুন ভাই এর গ্রাম্য আত্তিয়ের বাসার দিকে রউনা হলাম। উনার বাসা ঠিক কল্যানপুরে না, শ্যমলীর দিকে যেতে হবে, সুতরাং মিরপুর রোড দিয়ে যাউয়া ছারা আর উপায় নেই, কি আর করা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় দেখি অনেক আর্মি দারিয়ে টহল দিচ্ছে, তাদের চোখে মুখে শিকার ধরার লালসতা, তারা যেন হিংস্র ক্ষুধার্ত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিন দেখলেই ঝাপিয়ে পড়বে তার উপর। আমাদের দিকে তাদের কয়েকজন তাকিয়ে আছে, কিন্তু আমাদের হাতে বাজারের ব্যাগ থাকায় কিছু বলছে না, হয়ত ওরা ভাবছে, এই কারফিউ এর দিনেও এরা বাজার করতে বের হয়েছে, হয়ত বাসায় খাবার মত কিছুই নেই, তাছারা এত রিস্ক কে নিতে যায়।

আমরা মামুন ভাই এর আত্তিয়ের বাসায় পৌছে গেলাম। বাড়িওয়ালার নাম শফিক, একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে চাকুরী করেন তিনি, চিকন চাকন গড়ন তার, এতই বেশি ফর্সা যে মনে হচ্ছে চামরার মদ্ধে থেকে এখনি রক্ত বেরিয়ে পরবে, এত ফর্সা পুরুষ মানুস হতে পারে আমি আগে কখোনই ভাবতে পারিনি। বাসা বলতে দুই রুমের একটা ছোট্ট ফ্লাট, এখানে শফিক সাহেব তার স্ত্রী আর দুই পুত্রকে নিয়ে থাকেন। মামুন ভাইকে দেখেই তিনি চিনতে পারলেন, আমিও আমার পরিচয় দিলাম। তাদের কথাবার্তায় আমি বুঝতে পারলাম তারা একই গ্রামের মানুষ, কিন্তু তাদের সম্পর্কের দুরুত্বটা অনেক বেশি।

হয়ত এলাকায় কেউ কারো সাথে কথাই বলেনি আগে, শুধু মুখের চেনাচিনি। কিন্তু এখন এই মুখের চেনাচেনির সম্পর্ক্টাই অনেক মধুর হয়ে গেছে। শুনেছি, পরবাসে নাকি নিজের দেশ থেকে আমদানি করা একটা কুকুর দেখলেও শান্তি লাগে। তাই হয়ত তাদের মনে শান্তি বিরাজ করছে। বাসায় ঢুকে আগে ফ্রেস হয়ে নিলাম, হাল্কা নাস্তা করে শুয়ে পড়লাম বিছানায়, এতই ক্লান্ত লাগছে যে মনে হচ্ছে এখনি ঘুমিয়ে পরব।

কিন্তু ঘুমাই না, ভাইয়াদের সাথে বিভিন্ন ধরনের গল্প করা সুরু করলাম। মামুন ভাই ধরলেন গতকালের মারামারির গল্প। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কি ঘটল কেন ঘটল, এইসব নিয়ে নানান কথাবার্তা। শফিক সাহেবের স্ত্রী আমাদের আনা বাজার দিয়ে রান্না বসিয়ে দিলেন, তারপর উনিও এসে যোগ দিলেন আমাদের সাথে। ভালই কাটছিল সময়, কিন্তু হঠাত টিভিতে একটা খবর দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম সবাই, মামুন ভাইকে দেখা যাচ্ছে টিভিতে, গতকালের মারামারির একটি দৃশ্য দেখানো হচ্ছে, মামুন ভাই এক আর্মিকে ধরে বেদম পেটাচ্ছেন, এখন তাকে খোজা হচ্ছে তন্ন তন্ন করে।

দুপুরের খাবার শেষ করেছি, এমন সময় টিভিতে খবর আসল, বিকেল চারটার পর থেকে কয়েক ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হবে। মনে মনে অনেক শান্তি পেলাম, এবার হয়ত বাসায় যেতে পারব। কিন্তু মামুন ভাইয়ের জন্য খারাপও লাগছে, আর্মি ধরতে পারলে তাকে না জানি কি করবে। বিকেল যখন চারটা, তখন আমি বললাম আমি কাঠালবাগান আমার দাদার বাসায় চলে যাই, এখন হয়ত যেতে পারব। মামুন ভাই বললেন চল তোমাকে বাসে তুলে দিয়ে আসি।

আমি বললাম থাক লাগবে না, আমি একাই চলে যেতে পারব তাছারা আপনার এখন বাইরে যাউয়া ঠিক হবে না, আর্মি ধরতে পারলে আপনার রেহাই নেই। মামুন ভাই তবুও আমার কথা শুনলেন না, আমার সাথে তিনিও বেরিয়ে আসলেন শফিক সাহেবের বাসা থেকে। শ্যামলী অভারব্রীজের নীচে দাড়ালাম দুইজন, এখন ভালই বাস চলাচল করছে, ফার্মগেটগামী একটা বাসে উঠে পড়লাম আমি, মামুন ভাই দাঁড়িয়ে রইলেন, আজকে উনি শফিক সাহেবের বাসায় থাকবেন, তারপর সুযোগ বুঝে ঢাকা ছারবেন, বাস সবে চলতে শুরু করেছে, হঠাত নিচে সোরগোল শোনা গেল, তাকিয়ে দেখি, দুই তিন জন র্যা ব মামুন ভাইকে ধরে ফেলেছে, নানান রকম গালাগালি সহকারে তাকে বেদম পেটাচ্ছে। ততক্ষনে আমার বাস জোরে চলতে শুরু করেছে। আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা আমি।

এবারও আমার বাসায় যাউয়া হল না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।