বাঙালি ফ্রী পেলে আলকাতরা খায় চাচা,
আমার সালাম নেবেন। আশা করি ভালো আছেন। আমি আপনার পেজের একজন চুপচাপ সদস্য যেমনটা আমি বাস্তব জিবনেও হয়ে গেছি। মানুষের নির্লজ্য স্বার্থপরতা দেখতে দেখতে আমি নিজেকে ঘর বন্দী করে ফেলেছি। আজকে আপনাকে খুব বেশি লেখতে ইচ্ছা করল কারণ আগামীকাল আমার একটা বিশেষ দিন তাই...আমি চিঠির পরের অংশে সব বলব।
চাচা,
আমরা ছয় ভাই বোন। আমি সবার ছোট। ক্লাস টু তে যখন পড়ি তখন বাবা কি জিনিষ কিইবা সেই ব্যাক্তিটার গুরুত্ব বুঝে ওঠার আগেই দুম করে মারা গেলো। বাবাকে খুব বেশি মনে পরে না শুধু মাঝেমাঝে অনেক দিন পরপর আমার বোহেমিয়ান আব্বা আসতেন আমরা ছোট দুই ভাই বাবার বুকে লুটোপুটি খেলতাম...বাবা বলতেন তার আসার প্রথম চারদিন আমাদের ছুটি...এরপর শুরু হবে তার বিদ্যা দান পর্ব। আজকালের ছেলেমেয়েরা এগুলা পড়ে কিনা জানিনা আমার আব্বা একদিন আমাকে ধরে বসলেন তোমার বাংলা বইয়ের লেখকের নাম কি?আমি বল্লাম জানিনা...আব্বা আমাকে ধমক দিয়ে বল্লেন কে বই লিখছে জানোনা তাহলে শিখছো কি?অনেক দিন হয়ে গেলেও আব্বার সেই কথা আজো ভুলিনি।
আব্বা বড্ড ভালো মানুষ ছিলেন। একদিন আমাকে স্কুল থেকে নিতে গেছেন...আব্বার মুখ ভর্তি দাঁড়ি গোঁফ...ফিরতে ফিরতে আব্বাকে বল্লাম,‘আব্বা আপনি আর আমাকে নিতে আসবেন না...আব্বা বল্লেন কেনো?আমি বল্লাম আমার এক ক্লাসমেট বলেছে এইটা তোর দাদা নাকি?আব্বা হাসতে হাসতে বল্লেন মানুষের পরিচ্ছদই আসল না...আসল সে মানুষ কি না?। আজো যখন পনেরো বিশ দিন দাঁড়ি কাটিনা তখন তার কথাটা বেশি মনে হয়। আব্বার জন্যে পুকুর থেকে মিনার কার্প মাছ ধরে অপেক্ষা করছি...আব্বা হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে মাছ দিয়ে ভাত খাবেন...আব্বাটা বেজায় বোহেমিয়ান...আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন চিরতরে। কে জানি আমার থেমে যাওয়া কান্না দেখে বলেছিলেন তুমি কাঁদো না কেন?ছোট্ট আমি বিজ্ঞের মত বলেছিলাম কেঁদে কি হবে?আব্বা কি তাতে সাড়া দিবেন?১৯৯০ সালের কথা...জার্মানীর কাছে হেরে বিশ্বকাপ হারালো আর্জেন্টনা আর আব্বা আমাদের ছেড়ে গেলেন হৃদরোগের কাছে হেরে।
চাচা,
ছাত্র হিসেবে খুব খারাপ ছিলাম না কিন্তু আমি চিরদিনের ফাঁকিবাজ...অর্থাৎ পরীক্ষা সামনে না আসলে পড়তাম না। কিভাবে কিভাবে জানি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে গেলাম। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় হলো আমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। আপনি কখনো গেছেন কিনা জানিনা...এইটা হলো এত টুকুন একটা বিশ্ববিদ্যালয় যার প্রতিটা ছাত্র-ছাত্রী সবাই সবাইকে চিনে। বরাবরের মতনই আমি ঠোট কাটা গ্রপের সদস্য তো ছাত্র শিবিরের গোপন লীলাখেলা আমার পছন্দ ছিলো না আর তাই তাদের গোপন টার্গেটে পরে গেলাম ফলাফল সাজানো নাটকে আমার ছয় মাসের শাস্তি।
মেনে নিতে পারলাম না...তাই করে বসলাম আত্মহত্যার চেষ্টা। ফলাফল মরলাম তো নাই...উপরন্তু ষোল দিনের হাসপাতাল বাসের পর বাসায় ফিরলাম...সাথে চিনলাম কে আমার কাছে বন্ধু আর কে দুরের মানুষ। যাই হোক দাতে দড়ি লাগায় পড়া শুরু করে দিলাম এবং শেষ পর্যন্ত্য প্রথম শ্রেণীতে পাস করে বের হলাম। একজনের সাথে সম্পর্ক ছিলো যাকে পাগলের মত ভালোবাসতাম। মেয়েটা ফাইনাল পরীক্ষার আগ দিয়ে আমার সাথে চরম দুর্ব্যবহার শুরু করে দিলো...আমি তাকে বুঝালাম আমার ফাইনাল পরীক্ষা চলতেছে এমন করো না...পরীক্ষা শেষ হলে আমি সব নিয়ে আলোচনা করব।
সে কথা শুনেনা...এদিকে আমি একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে পরীক্ষা দিলাম এবং আল্লাহ্ পাকের অশেষ কৃপায় ভালো রেজাল্ট করে বের হলাম।
চাচা,
একদিকে আমার নতুন জিবন আরেক দিকে তার বাজে ব্যবহার তাই বিশ্ববিদ্যালয় জিবন শেষ করেই ঢাকা দৌড়ালাম আমাকে একটা চাকরি পেতেই হবে কারণ একটা চাকরি পেলে আমি ওকে ঘরে আনতে পারব। পেলাম না...সবাই একই অজুহাত দেখায় আপনে কেবল পাস করেছেন তাই ভালো প্রস্তাব পেলে আমাদের এখানে থাকবেন না..আমার জমানো টাকা শেষ হয়ে গেল শেষে আমি আবার ঢাকার বাসায় ফিরে আসলাম। এদিকে আমার প্রেমিকার গোপন মোহ ভেঙ্গে গেছে...তাই সে আবার ফিরে আসল...এবং আমি তাকে আবার গ্রহন করলাম। ও খুব সুন্দরী ছিলো তাই সবাই ওকে ভোগ করার সুযোগ টা ছাড়ত না আর সাথে ছিলো তার জিবনে বড় হবার স্বপ্ন।
আমি তাকে বুঝাতাম জিবনে বড় হতে হলে খারাপ পথে যাবা এটা কোন যুক্তি না। আমি ওকে হাতে কলমে কম্পিঊটার,ইন্টারনেট ব্যাবহার শিখালাম...যেন ও ভালো কোথাও চাকরি পায়। নিজে চাকরীর জন্যে পড়তাম আর ওর জন্য বিডি জবসে এপ্লাই করে দিতাম। এমনই একটা ভালো কোম্পানীতে তার চাকরী হয়ে গেলো। ভালোই চলছিলো সব কিছু।
আমি নিজ চেষ্টায় বাসার নীচে একটা বুটিক্সের দোকান দিলাম...আমার মায়ের তা পছন্দ হলো না। তার কথা তোকে এ এস পি হতে হবে...তাই কিছুদিন চেষ্টা করে দোকান ছেড়ে দিলাম...আর দোকানের প্রায় এক লক্ষ টাকার মালামাল ওর মামাতো ভাইয়ের কাছে দিয়ে দিলাম যে, তুমি বিক্রি করে আমাকে আসল টাকাটা ফেরত দিবা...যেন আমি পাওণাদার দের টাকা শোধ দিয়ে দিতে পারি।
চাচা,
আমার কপালে আল্লাহ্ পাক খুব বেশিদিন সুখ রাখেন্না। ও একদিন আমাকে বল্ল জরুরী প্রয়োজনে ওকে বাসায় যেতে হবে...আমি ওকে বাসে তুলে দিয়ে আসলাম। দশ দিন হয়ে যায় সে আর আসেনা...এদিকে ওর মামাতো ভাই আমাকে কিসব উলটা পালটা কথা বলা শুরু করে দিলো...'আমার বোন গেলে কি হয়েছে আরেকজন আসবে'।
আমি ফোন দিলাম ওকে...ধরে না...শেষে ধরলো ওর আব্বা...আমি ওকে চাইলে তিনি দিলেন...আমি জিজ্ঞেস করলাম তুমি আসছো না তোমার তো চাকরি চলে যাবে। ও বল্ল চাকরী সে করবে না কারণ তার বিয়ে হয়ে গেছে...মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরল আমার। আমি আবার মরে যেতে চাইলাম...আমার মা আমাকে সে যাত্রায় আবার ফিরায় আনলো। আমার জিবন টা একদম ছন্নছাড়া হয়ে গেল...আমি ওর মামাতো ভাইকে ফোন দিলাম যা হবার হয়েছে টাকা গুলা দাও আমি শোধ দিয়ে দেই...সে অবাক করে দিয়ে বল্ল কিসের টাকা?চাচা, আমি ওকে এখনও ভালোবাসি...জানিনা কি আছে ওর মাঝে। আমি জানেন চাচা, সদর ঘাটে যেয়ে বসে থাকতাম একটা বিশেষ রুটের লঞ্চের দিকে তাকিয়ে থেকে;কত মানুষ যায় আসে আমার সে আসেনা।
আমার দিন কাটতো না। ও আমাকে কথা দিয়েছিলো ও আমাকেই বিয়ে করবে তাই ওকে আমার কাছে রাখতে দ্বিধা করিনি। স্বামী-স্ত্রীর মত ঘর কান্না শুরু করেছিলাম...আম্মা বলত ওর বাবাকে বল এভাবে থাকা যায়না(আম্মা আমাদের আরেক শহরের বাসায় থাকত এবং তাকে সবই জানাতাম)...আর ও নানান ছলাকলা করে কথাকে কাটাত। ওর বিয়ে হয়ে যাবার পর আমি প্রায় উন্মাদ হয়ে গেলাম...বাসায় টাকা পাঠায় নিজের চলার টাকায় মদ কিনে খেতাম ঘরে বসে...সারারাত চিৎকার করে কান্নাকাটি করতাম...বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করতাম। একদিন আবিস্কার করলাম আমি রান্নাঘরে ওর চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াক পাচ্ছি...কোন একদিন রাতে অন্ধকারে দেখি তার ছায়া...আমি স্পষ্টতই বুঝলাম মানসিক রোগের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি।
আমি বাইরে চলাফেরা শুরু করলাম,এখানে ওখানে চলে যেতাম...একদিন খুব ভোরে ওর গ্রামের বাড়িতে দরজার কাছাকাছি যেয়ে চলে আসলাম...যেন হাত বাড়ালেই ও দরজা খুলে দেবে। আমি মায়ের কাছে চলে আসলাম এবং আমার আর চাকরীর পড়া হলোনা। শেষমেষ গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম...আমাকে আমার মায়ের জন্যে কিছু করতেই হবে; তাই অনেক চেষ্টায় বিদেশের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা লোভনীয় প্রস্তাব পেলাম...এবং আপনাদের দোয়ায় সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী অক্টোবরে আমি চলে যাব। চাচা, ওর খুব শখ ছিলো দেশের বাইরে যাবে তাই সে কানাডিয়ান সিটিজেন কে বিয়ে করেছিলো; আমাকে ফেলে...কিন্তু সেই ছেলে তাকে পরে ডিভোর্স দেয়...আর আজকে আমি নিজেই যাচ্ছি বিদেশে...মাঝেমাঝে বাইরে যাবার কাগজ গুলো হাতে নিয়ে দেখি ভালোবাসার থেকে এইটার দাম কত বেশি ?
চাচা,
আমার ছয় ভাইবোন কিন্তু আমিই শুধু আমার মেয়ে মানে আমার মায়ের কাছে আছি। আমার মেয়েটাকে আমি খুবই ভালোবাসি...আমার মেয়েটা আমার হাতের বানানো চা ছাড়া খায়না...আর কোন কারণে না বানালে সে অভিমান করে চা নিজে বানায় খাবেনা।
চাচা,আপনি দোয়া করবেন আমি যেন আমার মেয়েটার সব স্বপ্ন পুরণ করতে পারি...আমি যেন আমার মেয়েকে একটা গাড়ি কিনে দিতে পারি...একটা দামি মোবাইল কিনে দিতে পারি...আমি তো বেকার তাই এখন যে আমি চাইলেও মেয়েটার মুখে হাসি ফুটাতে পারিনা। চাচা,আমার বাবা মারা যাবার পর আমার এই মেয়েটাই আমাকে মানুষ করেছে তাই আমি আমার মেয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ...তাকে আর কোন সন্তান না দেখুক আমি দেখব। চাচা,আগামীকাল(শুক্রবার)আমার বিয়ে...আমি বেছে নিয়েছি একজন অতি সাধারণ ঘরের মেয়েকে যে আমাকে তার ছবি দেখানর জন্যে কোন বিশেষ মেকআপ নেয়নি। আমার এই বেকার অবস্থায়। বিয়ের অন্যতম কারণ আমার মা কে দেখার কেউ নাই...।
আপনারা সবাই দোয়া করবেন যেন আমি তাকে আমার মায়ের পাশে সারাজিবন থাকার শিক্ষাটা দিতে পারি...সে যেন আমার মাকে আমারই মত ভালোবাসে। আমি তাকে শুধু একটা কথাই বলব আমি তোমাকে সব দিব...তুমি শুধু আমার মেয়েটার মনে কষ্ট দিবানা...আমি তোমার জন্যে সব এনে দিবো।
আপনি ভাল থাকবেন চাচা।
একজন বেকার ছেলে।
এই লেখাটি ফেসবুক পেজ Gedu Cacar Khola Cithi (গেদু চাচার খোলা চিঠি) থেকে নেয়া View this link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।