গেদু চাচার খোলা চিঠি।
গেদু চাচা,
আমার এই চিঠি পেয়ে আপনি নিঃশ্চয় খুব অবাক হচ্ছেন। আমি সরাসরি না যেয়ে কেন চিঠি দিলাম?মা এর কাছে যাবার আমার একদমই উপায় নাই। আমাদের অবস্থা আর আগের মত নাই চাচা...আমরা খুব খারাপ অবস্থার মাঝে দিন কাটাচ্ছি। এই অবস্থার মাঝে দিন গেলে আমাদের আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকবে না।
আমাদের আজকাল একরকম পালায় পালায় দিন কাটাতে হয়....কোন বেলা খাই কোন বেলা না। যা হোক সেসব কথা চাচা; মাকে যেন এগুলা আবার না বলে দেন...মা আমার কষ্টেই মরে যাবে।
চাচা,
সৃষ্টিকর্তার কোন সৃষ্টিই অকারণ না। তার পেছনে কোন না কোনা ঘটনা থেকেই যায়। মা’র কোল আলো করে যখন এই আমি আসছিলাম...চাঁদের একটা আলোতে নাকি সারা ঘর ভরে গেছিল।
আপনারা সারাদিনই আমাকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকতেন... এই হিমেল আমি প্রথম কি শব্দ করলাম...সেটা ‘’মা’’ নাকি ‘’বাবা’’;আবার চাঁদের হাসি দিয়ে কি বুঝাতে চাইলাম...হাত নাড়া দিয়ে কাকে ডাক দিলাম?আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেবার সময় হয়ে গেল...এল একটা নতুন খুশির মাত্রা। ঠিক কিছুদিন পরেই যেন সৃষ্টিকর্তার অমোঘ লেখন শুরু হয়ে গেল... আমি কারো সাথে খেলতে চাইতাম না... আমার সমস্যা প্রকট হতে শুরু করে দিল... আমি ছেলেদের সাথে খেলতে চাইতাম না...সারাদিন একা একা বসে থালতাম...মাকে না দেখলে অস্থির হয়ে যেতাম। এর কিছুদিন পর আমি বায়না ধরলাম আমাকে রান্নাবাটির খেলনা কিনে দিতে হবে...আব্বা শুনে বেদম মারধর করলো আমাকে। মা হয়ে কি আমাকে ফেলে দিতে পারে?...চোখের পানি দিয়ে আমাকে বুকে জড়ায় ধরে রাখল। মাঝেমাঝে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠতাম... ‘মা...মা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে মা...আমি যাব না...আমাকে তুমি যেতে দিয়ে দিওনা’।
হঠাত দেখা আলো যেন হঠাতই নিভে গেল আপনাদের সামনে।
চাচা,
এর কিছুদিন পরই আমি খালি চলে যেতে চাইতাম...বলতাম... ‘মা,আমার জায়গা এটা না...আমাদের আলাদা জায়গা আছে। আমি সবার সাথে থাকতে পারব না...আমাকে সবাই অপমান করবে...তাতে তোমার কষ্ট হবে’। এর বেশ কিছুদিন পর ওরা দল বেঁধে আসলো...ওদের বেশভুশা দেখে আমরা হাসাহাসি করতে পারি কিন্তু ওদের মানবতা আমাকে ছুঁয়ে গেল। ওরা আমার মাকে বুকে জড়ায় ধরে রেখেছিল পরম মমতায়...চোখেরর পানিতে মনের ব্যাথা ধুয়ে সাথে নিয়ে গেছিল আমাকে।
আমাকে আমার আব্বা বিদায় করে দিতে পারলেই যেন বেঁচে যাচ্ছিলেন...বড় অমানুষ লোকটা। আমাকে দেখতে পারতেন্না উনি, তার সব খেয়াল ছিল আমার আর সব ভাই বোনের দিকে...তারা তাদের শিশুসুলভ ভুলের জন্যে ক্ষমা পাইলেও আমি পাইতাম না। চাচা, সৃষ্টিকর্তা আমাকে এমনভাবে বানালে আমার কি দোষ বলেন?
চাচা,
আমার কি এখানে এসে থাকতে ইচ্ছা করতো? আমাকে আমার সর্দার রানী খুব আদর করতেন,এটা ওটা কিনে দিতেন কিন্তু আমার মন খালি আমার মা এর কাছে পরে থাকত...কত কাঁদছি চাচা...মা মা বলে চেচাইছি...মা এর জন্যে দৌড় দিছি। চাচাগো,যাদের মা নাই তারা কেঁদে মরে আর আমার মা থেকেও আমি বারো বছর বয়স থেকে মাওর...আমার কি ভাল লাগে বলেন? বলেন চাচা, আমার বুকটা ফেটে যায়না চাচা? চাচাগো, আমার মা এর শাড়ির গন্ধ নিতে ইচ্ছা করেনা? মা এর হাতে খাইতে ইচ্ছা করেনা? মা এর কোলের মধ্যে মুরগীর বাচ্চার মত থাকতে ইচ্ছা করেনা? চাচাগো, হাজার টাকার বিরিয়ানি কি মা এর হাতের ভাতের দলার মত? চাচাগো...আমার আব্বাকে আপনি দূরে কোথাও নিয়ে যাবেন...আমি আমার মা এর কাছে যাব...আমার মা এর কোলের মধ্যে মুরগীর বাচ্চা হয়ে থাকবো চাচা...মার গায়ের গন্ধ নিব চাচা। চাচা,আমি মাকে জড়ায় ধরে রাখব...মা মা বলে ডেকে পাগল করে দিব।
আমাকে আমার মা এর কাছে আপনারা যেতে দিবেন্না চাচা?
চাচা,
আমরা বাজারে যেতে পারিনা;মানুষে আমাদের দেখে টিটকারি করে...বাবার বয়সি লোক আমাদের দিকে অশ্লীল ভাবে তাকায়...নানান ইঙ্গিত করে। চাচা, বলেন সরকার আমাদের পেট চালানর জন্যে কিছু আইন বাদে কি করছে? আমাদের পড়ালেখার কোন ব্যাবস্থা করছে? আমাদের কাজ করে খাবার মত কোন ব্যাবস্থা রাখছে? মানুষে লাখ লাখ টাকা অস্ত্রের ভয়ে দিনের আলোয় দিয়ে দেয়...আমাদের দশ টাকা চাঁদা দিতে গায়েও হাত দেয় আবার সাংবাদিকদের অভিযোগও দেয়। আমরা কি করে পেট চালাব বলে দিতে পারেন চাচা?আপনাদের তিন বেলা খেতে হয়;আমাদের পেট কি পেট না?চাচা,জানেন আমাদের গণশৌচাগারে যেতে দেয় না লোকজন?আমাদের লাঠি দিয়ে পিটায়?আমরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যেতে পারিনা...কেন চাচা?আমাদের সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু নাই?আমাদের সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেন্নাই?
চাচা,
বিজ্ঞান নিয়ে এত কথা বলেন এইবার আপনারে আমার কিছু বলার আছে। আপনি কি জানেন সমাজের কিছু বিত্তশালী লোক টাকার বিনিময়ে ছেলে বা মেয়ে কে লিঙ্গান্তর করতেছে? তারা ঐ সব কৃত্রিম ছেলে মেয়েদের সমাজের নানান ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে ফেলছে? আমরা এখন কোন বাসায় নতুন বাচ্চা হলে যেতে পারিনা...আমাদের সবাই ভয় পায়। ওরা ভাবে আমরা ছিনতাই করবো,ডাকাতি করবো...তাহলে আমরা খাব কি?চাচা, সমাজের সুস্থ সবল মানুষ যদি টাকার জোরে হিজরাদের বেশ ধরতে চায় তাহলে যারা হিজরা হয়ে জন্ম নেবে তারা যাবে কোথায়? তারা কি করে খাবে? আজকে ওরা ছিনতাই করে,ডাকাতি করে,মাদকদ্রব্য বেচে...আর দোষ হয় আমাদের।
আমাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে অনেকেই বাধ্য হয়ে অপরাধ এর পথ বেছে নিচ্ছে। চাচা, ওদের টাকার জোর আছে, গাড়ি আছে,বাড়ি আছে...আছে অস্ত্রের জোর আর রাজনীতিবিদদের মদদ...তাই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ওদের খুঁজে পায়না। ওদের টাকার অভাব নাই...নাই খাবারের অভাব আর রাস্তায় বের হলে টিটকারি বা গায়ে হাত দেবার সাহস কারো নাই...আমাদের আছে। আমাদের মরা ছাড়া আর কোন পথের দেখা দেখায় দিতে পারবেন আপনি? চাচা, যেসব ডাক্তাররা এই সব কাজ করে বিজ্ঞানের আশীর্বাদ নিয়ে তাদের কি বলবেন? আমরা না হয় মানুষ না হিজরা আর তারা?
চাচাগো, আমাকে মাফ করবেন। ছোট মুখে অনেক কথা বলে ফেললাম।
আমাদের দেখার কেউ নাই...আমরা খাইলেও কারো যায় আসেনা...গায়ে হাত দিলেও পুলিশ ধরবেনা...নাচার নাম করে ধর্ষন করলেও কিছু যাবে আসবে না। আমাদের মেলা দোষ চাচা, কিন্তু একদিন আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে শেষে জানিনা কি হয়ে যাবে?...আমি মা এর কাছে যাব...আব্বাকে বলে দিবেন আমাকে যেন যেতে দেয়...না হলে বুকে অস্ত্র ঠেকায় জিজ্ঞাসা করবো, 'আমাকে এই পৃথিবীতে আনার জন্যে দায়ী কে?'ভাল থাকবেন।
আপনার হিমেল,
২৮-০৩-২০১১ ইং
***এটি কিছু তথ্য ও কিছু সত্য ঘটনার আলোকে লেখা। আপনারা যারা পড়বেন তারা আশা করি ওদের জন্যে কিছু করবেন***
গেদু মিয়াকে লেখা একজন কমন জেন্ডারের খোলা চিঠি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।